দিনাজপুর বালুবাড়ী পাওয়ার হাউজের নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড নেস্কো টু এর গুদাম ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

বুধবার (৫ মার্চ) বিকাল ৫টার দিকে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ী পাওয়ার হাউজ নর্দান আঞ্চলিক কারখানার গুদামে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিটের প্রায় ১ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

আগুনের নীলিমায় শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে গুদাম ঘরের চারপাশে বসবাসরত সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পাওয়ার হাউজের গুদাম ঘরে রাখা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, তেলের ট্যাংকি, ট্রান্সমিটারসহ বিভিন্ন ধরনের পরিত্যক্ত ট্রান্সফর্মিটারের তেল ফুটতে থাকে। এতে আগুনের তীব্রতা আরো বাড়ে। মানুষ চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করে। খবর পেয়ে দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টর বজলুর রশিদ জানান, দিনাজপুর পাওয়ার হাউসে আগুন লাগার সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তিনটি ইউনিট প্রথমে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে আগুনের ভয়াবহতা তীব্র হওয়ার কারণে আরও তিনটি ইউনিট মোট ৬টি ইউনিট পাওয়ার হাউজের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। 

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে শর্ট সার্কিট থেকে পাওয়ার হাউজের গুদাম ঘরেই এই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকার মালামাল পুড়ে গিয়েছে। তবে আগুনে পাওয়ার হাউজের মূল কেন্দ্রে কোনো ক্ষতি হয়নি।

ঢাকা/মোসলেম/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গ দ ম ঘর ইউন ট

এছাড়াও পড়ুন:

জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমার শিক্ষকের কাছে চিঠি

স্যার,

সারা পৃথিবী আপনাকে চেনে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বা জেআরসি নামে। আপনাকে একজন বিশিষ্ট শিক্ষক, প্রকৌশলী, দূরদর্শী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে সবাই জানে। যদিও আমার কাছে আপনি আরও অনেক বেশি আপন একজন।

বছরখানেক আগে (এই লেখা ২০২১ সালে লিখিত) আপনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আপনার যাওয়ার পরে মানব ইতিহাসের পথ পরিবর্তন করা দুটি বড় ঘটনা ঘটেছে। নতুন এক ভাইরাস বিশ্বকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ রাস্তায় নামে ন্যায়বিচারের দাবিতে। এমন দুটি বড় ঘটনা নিয়ে আমার ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, তা জানতে আমি যদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম! এমন পরিস্থিতিতে দেশের জটিল সব সমস্যা সমাধান করতে ন্যায়ের পক্ষেই আপনি দাঁড়াতেন।

২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর শেষবারের মতো আপনার বাড়িতে আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। কারিশমা (জামিলুর রেজা চৌধুরীর মেয়ে) ও তাঁর ছেলেও তখন সেখানে ছিল। আমার দুই সন্তানকে নিয়ে গিয়েছি। তাদের একজন কলেজে ভর্তি হয়েছে আর একজন সদ্য কলেজ স্নাতক। আপনিও তাদের দেখতে চেয়েছেন। আমিই চেয়েছি আমার সন্তানেরা আপনার সঙ্গে দেখা করুক। তারা আপনার সম্পর্কে অনেক শুনেছে আমার কাছে। নিজের বাবার রোল মডেল হিসেবে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছে তারা।

আমি ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি। আসার পর থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ফেব্রুয়ারির মধ্যে এখানে মহামারির মাত্রা বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা জানতে পারি, নন-মেডিকেল ধরনের মাস্ক আসলে মানুষের জন্য কাজ করবে না। একজন প্রকৌশলী হিসেবে আমি তখন আরও জানতে চাই। আমার ছাত্রদের দিয়ে পরবর্তী আট সপ্তাহের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা শুরু করি আমি। আমরা টি-শার্ট দিয়ে দুই স্তরের তৈরি মাস্ক করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ব্যবহার করি। এসব মাস্ক মেডিকেল মাস্কের মতোই ভালো কাজ করে। আমরা ২৪ এপ্রিল গবেষণাপত্রটি জমা দিয়েছিলাম। আমি আপনার সঙ্গে গবেষণার ফলাফল শেয়ার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কে জানত আমার হাতে আর তিন দিন মাত্র বাকি। এই আফসোস আমাকে অনেক দিন নাড়া দিয়েছে। আমার জন্য একটি ছোট সান্ত্বনা ছিল আমার অনুরোধে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সেই গবেষণার গল্প প্রকাশ করে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য গবেষণা উপকারে আসবে বলে সেটি প্রকাশ করা হয়। মাস্কের গল্পের ঠিক ওপরে আপনার ছবিসহ আপনাকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। কী কাকতালীয় আমার জন্য! মনে হচ্ছিল যেন আপনি আমার গবেষণার ফলাফল দেখছেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকা যাই। সেই সময় আপনি আমাকে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমিতে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ডিসেম্বর আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব ভোরে ঢাকায় পৌঁছাই। বক্তৃতা ছিল সেদিন বিকেলে। আপনি একাডেমির অনেক সদস্যকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানান। আপনার সামনে বক্তৃতা দেওয়া আমার জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমি অত্যন্ত যত্নসহকারে বক্তৃতা প্রস্তুত করেছিলাম। আমি যেন আপনার যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি, সেভাবে প্রস্তুতি নিই। বুয়েট থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার ৩৪ বছর পর আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম, তখন আপনি বিদায় জানাতে হাত নাড়ছিলেন। আমাকে তখন বলেছিলেন, তোমার তো জ্বর, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমি বিস্মিত হয়ে আবেগতাড়িত হয়েছিলাম। আপনি যেন আমার জন্য সব সময়ের এক মহান অভিভাবক ছিলেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনীবাংলাদেশের প্রখ্যাত পুরকৌশলী, অধ্যাপক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। বাংলাদেশের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ সাল থেকে মৃত্যু অবধি তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের সিলেটে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবিদ রেজা চৌধুরী (১৯০৫-৯১) ছিলেন প্রখ্যাত পুরকৌশলী (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার)। তাঁর মা হায়াতুন নেসা চৌধুরী (১৯২২-২০১০) ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি সেন্ট গ্রেগরী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরী ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বুয়েট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ফল নিয়ে পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে স্ট্র্যাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলাফল প্রকাশের পর তিনি সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (ইপিইউইটি) শিক্ষক হিসেবে ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৭৬ সালে পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ করার জন্য নুফিল্ড বৃত্তি লাভ করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি বুয়েটে থেকে অবসরে আসেন। তিনি প্রায় ১০ বছর কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (বিএফএফ) ট্রাস্টি এবং পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ প্রদান করে এবং ২০১৮ সালে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে। ২০১৮ সালে তিনি জাপান সরকারের ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান’ (গোল্ড রে ও নেক রিবন) পদক লাভ করেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বুয়েটের পুরকৌশল ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পুরকৌশল ভবন’ রাখা হয়। গ্রন্থনা: জাহিদ হোসাইন খান

১৯৮৩ সালে বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ার সময় আপনি আমাদের স্ট্রাকচারাল মেকানিকস ও সংখ্যাসূচক পদ্ধতি শিখিয়েছেন। আপনি বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন। আমরা মেইনফ্রেম কম্পিউটার ব্যবহার করতে পাঞ্চ কার্ড ও কাগজের প্রিন্টআউট ব্যবহার করতাম। জাতীয়ভাবে তখন আমরা একটি জটিল সময়ে অবস্থান করছিলাম। তখন একদিকে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা। রাজপথে চলছিল গণতন্ত্রের দাবি, বাতাসে ছিল সংগ্রাম ও প্রত্যাশার আভাস। তখন কম্পিউটার সেন্টার আমাদের জন্য বলা যায় উত্তেজনাকর এক অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। আপনি আমার বিএসসি থিসিসের উপদেষ্টা ছিলেন। আপনি আমাকে উঁচু দালানের শিয়ার দেয়াল নিয়ে গবেষণা করতে বলেছেন। ফোরর্ট্রানে কোড লিখে বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ করতে বলেন, থিসিস সংকলন করতে বলেন এক বছরের কম সময়ের মধ্যে। আপনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, কিন্তু আমি বেঁচে গেলাম। আপনি আমার আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছেন।

তত দিনে আপনি আমার মায়ের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন জামিল স্যার নামে। আমার মায়ের কাছে আপনি ছিলেন আমার অভিভাবক ও ত্রাণকর্তা। ১৯৮৪ সালে আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁর অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার ধরা পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দীর্ঘদিন। আমি ১৯৮৪ সালের আগস্টে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। আপনার সবচেয়ে জুনিয়র সহকর্মী ছিলাম আমি। আপনি প্রায়ই আমার বাবা ও পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। আপনি আমাদের ধানমন্ডির বাসাতেও গিয়েছেন। আমি আপনাকে অভিভাবক ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে দেখতে শুরু করি।

আমার বাবা ১৯৮৬ সালের জুন মাসে মারা গেলেন। দুই মাস পরে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আমার এমএস শেষ করার পর কর্নেলে পিএইচডি শুরু করার জন্য নিউইয়র্কের ইথাকাতে চলে আসি। পিএইচডি করার সময় আমাকে একাধিক বিষয় পছন্দ করতে দেওয়া হয়। যদিও আমি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। সে কারণে ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঠান্ডা রোদেলা এক সকালে আমি আপনাকে কল করি। আপনি আমাকে ফ্র্যাকচার মেকানিকস বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমার সব প্রস্তুত ছিল। আপনাকে দেওয়া সেই ফোন কল আমার থিসিসকে জানতে সহায়তা করেছিল। সেই কল আমার কর্মজীবনের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করেছে।

আমি যখন ১৯৯৩ সালে পিএইচডি শেষ করছিলাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প খাতে চাকরি খুঁজছিলাম। তখন আমার ভাগ্য ভালো ছিল না বলে কোনো সুযোগ পাইনি। মরিয়া হয়ে আমি পোস্ট-ডক্টরাল পদের কাজ খোঁজ করি। তখন আমি তিনটি অফার পেয়েছি। তার মধ্যে একটি এমইএমএস (মাইক্রো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস) নিয়ে কাজ করার জন্য কর্নেলের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে খুব কম বেতনের অফার পাই। শব্দটি তখন বেশ অপরিচিত। ক্ষেত্রটি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল ও ভবিষ্যৎ আছে বলে মনে হচ্ছিল না। আপনি আমাকে এমইএমএস বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। আমি সব শুরু করি, আমার পুরো পেশাজীবন সেই পথে গেছে। এরপর গবেষণা করি বায়োহাইব্রিড রোবোটিকস ও বায়োমেকানিকসসহ বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে। মেকানিকস ও মাইক্রো-ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করি। আমি ১৯৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আরবানা-শ্যাম্পেইনে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যোগ দিই।

আমি যখনই বাংলাদেশে যেতাম, তখনই আপনার সঙ্গে দেখা করতাম। আপনি ভীষণ ব্যস্ত সময়সূচি সত্ত্বেও আমাকে সময় দিয়েছেন। যতবার আমি দেখা করতে চেয়েছি, ততবার সময় দিয়েছেন। আমি বুঝতে পারতাম, আমার কাছে আপনার অনেক প্রত্যাশা ছিল।

ভাগ্যক্রমে ২০০৭ সালে আমরা ন্যানো স্কেলে ধাতুর একধরনের স্মৃতির বিষয় আবিষ্কার করি। প্লাস্টিকের মতো বিকৃত ধাতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। আপনি গবেষণার ফলাফল জেনে রোমাঞ্চিত হন। আপনি বিভিন্ন ফোরামে একাধিক অনুষ্ঠানে সেই গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে বলতেন। আমি একটি মাইলফলক অর্জন করেছিলাম, যা আপনাকে ভীষণ গর্বিত করেছিল। ২০১৪ সালে আমার ল্যাব একটি ক্ষুদ্র জীবন্ত রোবট তৈরি করে। একটি সাঁতারু রোবট, যা হৃৎপিণ্ডের কোষ দিয়ে চলতে পারে। এই উদ্ভাবন এমইএমএসকে জীবন দিয়েছিল। আবারও আপনি আমাকে নিয়ে রোমাঞ্চিত ও গর্বিত হয়েছিলেন। অনেক সাক্ষাৎকারে আমার কাজের কথা উল্লেখ করেছেন আপনি।

আমার কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য আপনি অনুপ্রাণিত করেছেন। কঠিন সময়ে আপনার নির্দেশনা ও সান্ত্বনা পেয়েছি। আমার মা ২০১০ সালে শ্যাম্পেইন, ইলিনয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করার সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহার শুরু করেন। এমন দৃশ্য আমাকে আপনার বাড়িতে হুইলচেয়ারে আপনার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আমি যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, তখন আপনার মা প্রায়ই আমাকে শুভেচ্ছা জানাতেন। আপনি ও আপনার পরিবার বছরের পর বছর ধরে তাঁর যত্ন নিয়েছেন। এবার আমার পালা। আমার স্ত্রী ও আমি, আমাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সাহায্যে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বাড়িতে মায়ের যত্ন নিয়েছি। আমার মায়ের চলে যাওয়ার পরে আপনার ই–মেইল ছিল আমার সান্ত্বনার উৎস।

আমার মা চলে যাওয়ার পর থেকে আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বা ফোনে প্রায়ই কথা বলতাম। আমি শিখতে শুরু করেছি কীভাবে চিন্তা ও যুক্তির স্বচ্ছতা আমাদের মুক্ত ও নির্ভীক করতে পারে। কুসংস্কার ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে ন্যায়ের জন্য আমাদের আওয়াজ তুলতে আপনার মতো কীভাবে নির্ভীক হওয়া যায়। হলে বুয়েটের এক ছাত্র নিহত হওয়ার পর আমরা আপনাকে অবস্থান নিতে দেখেছি। আপনি ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি দাবি করেছেন। আপনি আপনার পেশাদার, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শক্তি দিয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর এল ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল অন্য সব দিনের মতো। যদিও অন্যান্য দিনের মতো নয় দিনটি। দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়কে খুব ভোরে স্থির করে দেয়। আমরা যেন একটি সুন্দর স্বপ্ন থেকে হঠাৎ করে জেগে উঠলাম, আমরা যেন একটি বড় গাছের ছায়া হারালাম।

আজ আমি আপনার মতো ভয়হীন ও অনুপ্রেরণার উৎস হতে চাই। আমার বুঝতে হবে, কীভাবে আপনি অন্যদের কথা এত মনোযোগসহকারে শুনতেন। আপনার অনেক কিছু বলার ছিল। আপনি কীভাবে সব দিক থেকে এত বিশাল উচ্চতায় উঠেছিলেন, তা জানতে চাই। ওপর থেকেও আপনি কখনোই মাটির স্পর্শ হারাননি, তা জানতে চাই। আপনি কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা জানতে চাই। আমাদের পৃথিবীর বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী চিন্তাবিদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তারপরও আপনি যেভাবে সরল জীবন ও ন্যায়বিচারের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তা জানতে চাই। আপনি আমাদের সমস্যা সমাধান করার জন্য একটি প্যারাডক্সটি রেখে গেলেন। এমন সময় গেলেন, যখন সমগ্র বিশ্ব স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচারের জন্য অদৃশ্য শত্রুদের নিয়ে পরীক্ষা করছে।

আপনাকে আমার পরামর্শক হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য। আপনি সারা জীবনের জন্য আমার পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন। আপনি যখন বেঁচে ছিলেন, তার চেয়ে এখন আপনি আমার মধ্যে বেশি উপস্থিত। আপনার বিদায়ের পরে আপনি আমাকেও মুক্তি দিয়েছেন।

এখন, আমার নিজের পরীক্ষার সময় শুরু হয়েছে।

অধ্যাপক এম তাহের এ সায়ীফ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়স আরবানা শ্যাম্পেইনের এডওয়ার্ড উইলিয়াম এন্ড জাঁ মাঁর গাটসেল অধ্যাপক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ