অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭৪ জন নিহত এবং ১১৯ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। আজ বুধবার মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানিয়েছে।

এইচআরএসএস বলছে, সম্প্রতি গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না।

এইচআরএসএসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে গত বছরে। গত বছর গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৭৯ জন। আহত হয়েছেন ৮৮ জন। গত বছরের মতো গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটেছে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে। এই দুই বছর গণপিটুনিতে ২৩২ জন নিহত হন।

এই মানবাধিকার সংস্থার হিসাব, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে অন্তত ৩০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৯ জন আর আহত হয়েছেন ২০ জন।

দেশে গণপিটুনির ঘটনা আগে ঘটলেও ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর এ ধরনের ঘটনা নতুন মাত্রা পায়। আগে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটলেও এ সময় দলবদ্ধভাবে হামলার ঘটনা বেড়েছে, যা ইতিমধ্যে ‘মব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর এ ধরনের ঘটনাকে মানুষের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন অনেকে। তবে ছয় মাস পর এসেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অধিকারকর্মীরা এ জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন।

এর মধ্যে ৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের এওচিয়া এলাকায় মাইকে ‘ডাকাত পড়ার’ ঘোষণা দিয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে দলবদ্ধভাবে গুলশানের একটি বাসায় ঢুকে ‘তল্লাশি’র নামে জিনিসপত্র তছনছ ও লুটপাট করা হয়েছে।

এইচআরএসএস বলছে, এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ডাকাতির ঘটনায় শরীয়তপুরে সাতজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এতে পাঁচজন মারা যান। এর এক দিন আগে রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এসব ঘটনার বাইরে বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মিরসরাই, যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, রাজশাহী ও বরিশালেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে।

দেশে এ ধরনের সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে ছয় ধরনের কারণের কথা বলেছেন এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক ক্ষোভের কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষত পুলিশ ও র‌্যাব এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। আবার চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে ক্ষোভের কারণে অনেকে সন্দেহ করে গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে।

ইজাজুল ইসলাম বলেন, গণপিটুনির ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির নজির তেমন নেই, তাই অনেকেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এ ছাড়া স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অরাজকতা তৈরির চেষ্টা এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতার অভাবে রয়েছে। এসব কারণে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি বলেছে, গণপিটুনি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই দেশের সব নাগরিককে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে আহ্বান জানিয়েছে এইচআরএসএস। সংস্থাটি বলছে, গণপিটুনির মতো ঘটনা এড়াতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন ও গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এইচআরএসএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাঁকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ওই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী সব ব্যক্তি সমনাভাবে দায়ী থাকবেন। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ করা যাবে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণপ ট ন র ঘটন এ ধরন র ঘটন ও গণপ ট ন র গণপ ট ন ত ঘটন য় অপর ধ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ফেব্রুয়ারিতে সহিংসতায় প্রাণ গেছে ১৩৪ জনের 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনি, সংঘর্ষ, হামলা, নারী ও নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে ১৩৪ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া মাজারে হামলা ও ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নামে একটি সংস্থা এই তথ্য জানায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
  
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে কমপক্ষে ১০৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৯ জন এবং আহত কমপক্ষে ৭৫৫ জন। এসব সহিংসতার ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৫৮টি ঘটনায় প্রাণ গেছে পাঁচজনের ও আহত হয়েছে ৪৯৪ জন। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে ২৫টি সংঘর্ষের ঘটনায় দু’জন নিহত ও ১১৫ জন আহত হয়েছেন। 

রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৯ জনের মধ্যে বিএনপির পাঁচজন, আওয়ামী লীগের একজন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একজন নিহত হয়েছেন। অপর দু’জনের রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি, যার মধ্যে একজন নারী রয়েছেন। পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীর হামলায় আওয়ামী লীগের পাঁচজন, বিএনপির পাঁচজন, জামায়াতের একজন নারী সদস্য ও চরমপন্থি দলের তিনজনসহ অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন।  

এতে বলা হয়, এ মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্যাম্পাসে কমপক্ষে ছয়টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫৭ জন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হয়ে আবুল কাসেম নামে একজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৬ জন শিক্ষার্থী। কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রদল ও যুবদলের সংঘর্ষে অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।  

এইচআরএসএসের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংষর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ মাসে সারাদেশে কারাগার ও হাজতে কমপক্ষে ১২ জন আসামি মারা গেছেন। গণপিটুনির ১৭টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ১৩ জন। এ ছাড়া ১৯টি হামলার ঘটনায় ৩৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। পাঁচটি মামলায় ১১ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা ছয় মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচজন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ১০ জনকে।

ফেব্রুয়ারি মাসে বিএসএফের সাতটি হামলার ঘটনায় একজন বাংলাদেশি নিহত, ছয়জন আহত ও ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তিনটি হামলার ঘটনায় ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর ও জমি দখলের মতো ঘটনা ঘটেছে। ২৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮৭ জন। দুর্ঘটনায় ৯ জন শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে কমপক্ষে ১০৭ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৩ জন ও ১৩ জনকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। অন্যদিকে ১০৪ জন শিশু নির্যাতনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৯ জন। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭৫ জন শিশু।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুই সংগঠনের তথ্য: গণপিটুনির ঘটনা ও নারীবিদ্বেষ বেড়েছে
  • গণপিটুনিতে ৭ মাসে নিহত ১১৯ জন: এইচআরএসএস
  • ফেব্রুয়ারিতে সহিংসতায় প্রাণ গেছে ১৩৪ জনের 
  • ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৯ জন নিহত: এইচআরএসএস