চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ ছাত্রীকে বহিষ্কারের ঘটনার চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আজ বুধবার ছাত্রীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানানো এসব চিঠি ছাত্রীদের বিভাগ ও আবাসিক হলে পৌঁছেছে। তবে এসব চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল গত রোববার। আর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘বিজয় ২৪’ হলের (সাবেক জননেত্রী শেখ হাসিনা হল) ঘটনায় ১০ ছাত্রী ও ধর্ম অবমাননার ঘটনায় এক ছাত্রীসহ দুজনের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজয় ২৪ হলের বহিষ্কারের ঘটনা নিয়ে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীর অনেকেই এসব চিঠি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে সমালোচনা করছেন।

চিঠি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিজয় ২৪ হলের ৯ জন ছাত্রীকে পাঠানো বহিষ্কারে চিঠির ভাষা হুবহু এক। কেবল ছাত্রীদের নাম উল্লেখ করে পৃথকভাবে চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ হাসিনা হলের সংঘটিত ঘটনার সূত্রপাত ও বিস্তৃতিতে নেতৃত্ব দান, দায়িত্ব পালনরত প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, দায়িত্ব পালনে বাধাদান, সাংবাদিক হেনস্তা, হলের গেট ভেঙে বাইরে যাওয়া, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

একই দিনের ঘটনায় বহিষ্কার হওয়া আরেক শিক্ষার্থীর চিঠিতে সহকারী প্রক্টর কোরবান আলীকে শারীরিক লাঞ্ছনার অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে ছাত্রীদের কাছে কেন দুই বছরের বহিষ্কারাদেশ বহাল রাখা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে বিভাগের সভাপতির মাধ্যমে লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে জানাতে ছাত্রীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চিঠি নিয়ে সমালোচনা

বহিষ্কারে চিঠির ইস্যুর বিষয়টি জানানোর পর ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়া লেখক জি এইচ হাবীব তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘বেদম হাসি পেল চিঠিটা দেখে। হলটার পুরো নাম কী ছিল? কী ঘটনা? কারা গিয়েছিল সেই হলে অরাজকতা করতে প্রথমে?’

ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘মবের উসকানিদাতা, মব করার জন্য শিক্ষার্থীদের মেসেজ দেওয়া প্রক্টরবৃন্দ কত বছরের জন্য শিক্ষক ও প্রশাসনের পদ থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছেন?’ আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্যাসিবাদ এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানে।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জি এইচ হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে খুব লজ্জিত। এটা উদ্ভট একটা ব্যাপার। প্রশাসন কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে! ছাত্ররা কেন রাতের বেলা ছাত্রীদের হলে যাবে? এই প্রশ্ন কেউ করছে না। ছাত্ররা সেখানে রাতের বেলা গিয়ে তালা দিয়ে বিশৃঙ্খলা করেছে। এর প্রতিবাদই তো ছাত্রীরা করেছে। আমার বাসায় দিনে বা রাতে যেকোনো সময় কেউ হামলা করলে, গেটে তালা দিলে আমি উদ্বিগ্ন হব না? প্রতিবাদ করব না?’

জি এইচ হাবীব বলেন, ‘বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই ছাত্রীদের বক্তব্য শুনতে চাওয়া হয়েছে। এতে এটি স্পষ্ট, ছাত্রীদের বক্তব্য না নিয়েই একপাক্ষিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে তাঁদের। আবার ওই রাতে যে ছাত্ররা হামলা করেছিল, এটি চিঠিতে উল্লেখ নেই। এটি কেন চেপে যাওয়া হলো? মূল ঘটনার বর্ণনা কেন নেই?’

বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীরাও এ ঘটনায় নানান প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করছেন। জানতে চাইলে বহিষ্কৃতদের একজন জান্নাতুল মাওয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি হলের বাইরে ছিলেন এরপরও তাঁর চিঠিতে হলের গেট ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার প্রক্টরিয়াল বডিকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার কথা চিঠিতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন জায়গায় বাধা দেওয়া হয়েছে, এই কথা নেই। ভাঙচুর আটকানোও তো তাঁদের দায়িত্ব। অন্যদিকে ৫ ফেব্রুয়ারি কী হয়েছিল, এর বর্ণনা চিঠিতে নেই। ৯ ছাত্রীর চিঠির ভাষাও একই। অনেকেই উল্লিখিত ঘটনায় উপস্থিতও ছিলেন না।’

আরেক শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিনকার অনেক ঘটনার সময়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। এরপরও চিঠিতে এটা উল্লেখ রয়েছে।’

তবে চিঠিতে কোনো অসংগতি নেই বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠিতে অসংগতি রয়েছে, এটি তিনি কখনোই মনে করেন না। ব্যক্তিগতভাবে কারও কাছে অসংগতি মনে হতে পারে, এটি তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এটাই সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাচ্ছে।’

উল্লেখ্য, ১৩ ফেব্রুয়ারি জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের (বর্তমানে বিজয় ২৪ হল) ১০ ছাত্রীকে বহিষ্কার সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ছাত্রী হলের সামনে রাখা নৌকা আকৃতির বসার স্থান ভাঙচুর করতে যাওয়া কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিতণ্ডাও হয়েছিল আবাসিক ছাত্রীদের।

ছাত্রীদের অভিযোগ, মধ্যরাতে একদল শিক্ষার্থী হলে এসে ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। এসব ঘটনায় হলের আবাসিক শিক্ষক ও প্রক্টরিয়াল বডিকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এ কারণেই তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে সহকারী প্রক্টর কোরবান আলীকে শারীরিক লাঞ্ছনা করতে দেখা গেছে এক ছাত্রীকে। এ ছাড়া কয়েকটি ভিডিওতে প্রক্টরিয়াল বডির একাধিক সদস্যকে ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে দেখা যায়।

এর মধ্যে সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায় ছাত্রীদের বহিষ্কার করতে প্রশাসনকে চাপ দিতে ‘অনুগত’ ছাত্রদের বলেছিলেন দুজন সহকারী প্রক্টর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এসব নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া এসব স্ক্রিনশটে ছিল সহকারী প্রক্টর কোরবান আলী ও নুরুল হামিদের সঙ্গে তাঁদের ‘অনুগত’ ছাত্রদের কথোপকথন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর ক শ ক ষ র থ প রথম আল ক এসব চ ঠ ফ সব ক হয় ছ ল ঘটন য় সহক র ঘটন র র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

‘বিনা লাভের দোকানে’ নিম্নবিত্তের স্বস্তি

খুলনা নগরীর শিববাড়ী মোড়। গতকাল বুধবার বিকেল ৪টায় সেখানে দেখা মেলে একদল মানুষের জটলা। এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, নতুন একটি দোকানে বসে চিড়া, মুড়ি, সয়াবিন তেল, আলু-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বিক্রি করছেন তিন-চার যুবক।

দোকানের ওপরে ব্যানারে লেখা– ‘পবিত্র মাহে রমজানে জনমনে স্বস্তি ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বিনা লাভের দোকান। কেনা দামে পণ্য বিক্রি। আয়োজনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও টাস্কফোর্স টিম, খুলনা।’ সেখান থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে পণ্য কিনছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। 

বিক্রেতারা জানান, তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। কোনো লাভ ছাড়াই মোট ১৬ ধরনের পণ্য বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি আলু ১৭ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৩৫ টাকা, শসা ২৫ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, ছোলা ৯৫ টাকা, মুড়ি ৬৫ টাকা, বেসন ৬০ টাকা, চিড়া ৬০ টাকা, টমেটো সাড়ে ৭ টাকা, কাঁচামরিচ ৪০ টাকা, রসুন ১০০ টাকা, ডিম প্রতি পিস ১০ টাকা, সয়াবিন তেল এক লিটারের বোতল ১৭৫ টাকা এবং লেবু প্রতি হালি ২৭ টাকায় বেচছেন। এ ছাড়া রয়েছে ধনিয়া পাতা ও বোম্বাই মরিচ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনার বাজার নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য হৃদয় ঘরামী জানান, গত অক্টোবরে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে তারা নগরীর শিববাড়ী মোড়, বয়রা বাজার, নতুন বাজার, গল্লামারী, দৌলতপুর বাসস্ট্যান্ড ও খালিশপুর চিত্রালী মার্কেটে ‘বিনা লাভের দোকান’ চালু করেছিলেন। তখন ক্রেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পান। রোজার সময় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আবারও সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে তারা আবারও এ দোকান চালু করেছেন।

তিনি আরও জানান, প্রথমে শিববাড়ী মোড়ে এ দোকান চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি পয়েন্টে চালু করা হবে। রমজানজুড়ে তাদের এ কার্যক্রম চলবে। হৃদয় বলেন, তারা পণ্য কেনার পর পরিবহন খরচসহ মূল্য নির্ধারণ করছেন। শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমে এগুলো বিক্রি করছেন। প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ দোকান চালু থাকবে। 

বাজার মনিটরিং কন্ট্রোল টিম সদস্য ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাঈম মল্লিক, টিম সদস্য আরিফুল ইসলাম সানি ও রাইসা ইসলাম জানান, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূলত বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য না কমা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।   

শিক্ষার্থীরা জানান, নিজেদের টাকায় পণ্য কিনে এনে বিক্রি করছেন তারা। কারও কাছ থেকে কোনো অনুদান নেননি।

এই দোকান থেকে আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ও মুড়ি কেনার পর ইজিবাইক চালক ইসমাইল হোসেন বলেন, বাজারের তুলনায় এখানে দাম অনেক কম। নগরীর আরও কিছু পয়েন্টে এ ধরনের দোকান চালু করলে লোকজন রোজায় কম দামে জিনিসপত্র কিনতে পারত।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আলম শেখ বলেন, বাড়ি যাওয়ার সময় লোকের ভিড় দেখে এলাম। আমি ছয় আইটেম কিনেছি। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে আরও কিছু পণ্য এবং বিক্রির পয়েন্ট বৃদ্ধি করলে ভালো হবে। তাহলে আরও অনেকে উপকৃত হবেন। শিক্ষার্থীরা অসাধারণ একটি উদ্যোগ নিয়েছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ