ভুল তথ্য ও অপতথ্য কী, কারা এবং কেন এসব ছড়ায়
Published: 5th, March 2025 GMT
সংবাদমাধ্যমসহ প্রচলিত মাধ্যমগুলোর বাইরে তথ্যের অবাধ প্রবাহের জায়গায় পরিণত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যে কারও তথ্য দেওয়ার সুযোগ থাকায় এবং এসব তথ্য যাচাইয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এটি ভুল ও অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র—প্রায় সব জায়গায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমনকি ভুল ও অপতথ্যের কারণে জাতিগত ও ধর্মীয় দাঙ্গার মতো প্রাণঘাতী সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।
ভুল তথ্য ও অপতথ্য কী
ভুল তথ্য ও অপতথ্য শব্দ দুটি অনেকটা কাছাকাছি মনে হলেও ব্যবহারিক কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যদিও এ দুটির কারণে প্রায় একই রকম নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তবে ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্য এক নয়।
ভুল তথ্য: বিবিসি বলছে, ভুল তথ্য হলো ভুয়া খবর, যা কেউ ভুলবশত করে থাকেন এবং ছড়িয়ে থাকেন, যিনি বুঝতে পারেন না এটি ভুয়া।
এখানে যে মূল বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, সেটি হলো ভুল তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয় না। লোকজনকে ধোঁকা দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে এটি তৈরি করা হয় না। এটা তখনই হয়, যখন প্রকৃত ঘটনা, বাস্তবতা ও খবর না বুঝে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা হয় বা ঘটনাক্রমে কাউকে উল্টো তথ্য দেওয়া হয়।
যেমন একবার এক্সে (সাবেক টুইটার) দাবি করা হলো, দুবাই শহরে কম্পন অনুভূত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি ছিল, পুরোনো ভবন ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করার সময় আশপাশে এ কম্পন অনুভূত হয়েছিল।
অপতথ্য: বিবিসি বলছে, অপতথ্য হলো ভুয়া খবর, যা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করে এবং ছড়িয়ে দেয়। ওই ব্যক্তি জানে, এটি ভুয়া খবর।
মূলত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যখন কেউ ভুয়া খবর তৈরি করে এবং ছড়ায়, সেটি হলো অপতথ্য। এর সঙ্গে ব্যক্তি বা কোনো বিষয়কে অসম্মান বা সমালোচনার বিষয়টি জড়িত থাকতে পারে।
যেমন একবার একটি পোস্টে একটি ছবি জুড়িয়ে দিয়ে বলা হলো, লালগালিচায় দাঁড়িয়ে ‘তর্ক’ করছেন বেন অ্যাফ্লেক ও জেনিফার লোপেজ। এটি ছিল মিথ্যা। মূলত তাঁরা এমনি নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। মূলত পাঠক টানতে জেনে-বুঝে এই ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছিল।
কারা, কেন অপতথ্য ছড়ায়
সাধারণত অপতথ্য ছড়ানোর উৎস খুঁজে বের করাটা কঠিন। অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। নানা মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে নতুন এবং বিদ্যমান ভুল ও অপতথ্যগুলো ছড়ানো হয়।
বিদেশি রাষ্ট্র
সন্দেহ-সংশয় উসকে দিতে, রাজনৈতিক বিভাজন বাড়াতে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করতে এবং সমাজে অবিশ্বাসের বীজ বপন করতে বিদেশি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অপতথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অপতথ্য ছড়ানোর অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ছড়ানো বিপুল ভুল ও অপতথ্য শনাক্ত করেছে তথ্য যাচাইকারী (ফ্যাক্ট চেক) প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক
রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের দেওয়া বক্তব্য অপতথ্য ছড়ানোর উৎস হতে পারে বলে গবেষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। ৭০টি দেশে একটি গবেষণা চালিয়েছিল অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট। ২০২০ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে ৬২টি দেশেই জনমত পাল্টে দিতে অপতথ্য ব্যবহার করেছিল সরকারি সংস্থাগুলো।
সংবাদমাধ্যমের ৫৫ হাজার প্রতিবেদন, ৫০ লাখ টুইট ও ৭৫ হাজার ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘মেইল ব্যালটের’ মাধ্যমে ভোট কারচুপি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিত্তিহীন দাবি ছড়িয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর একটি জরিপ চালায় রয়টার্স ইনস্টিটিউট। এতে ইন্টারনেটে কোনটি ‘সঠিক’ আর কোনটি ‘ভুয়া’ খবর—এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ৬৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় রাজনৈতিক পক্ষ ও সাংবাদিকদের ছড়ানো ভুল ও অপতথ্য নিয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বিদেশি সরকারের চেয়ে নিজ দেশে সরকারের ছড়ানো অপতথ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।
অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক
মতাদর্শিক এজেন্ডা আছে, এমন গোষ্ঠীগুলো অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন তত্ত্ব অস্বীকারকারী ও টিকাবিরোধী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ভিন্নমত পোষণকারী গোষ্ঠীগুলোরও অপতথ্য ছড়ানোর নজির আছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সম্পৃক্ততাও থাকে। অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের তৈরি অপতথ্য আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে পারে সরকারি পক্ষগুলো।
ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান
রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক এজেন্ডা ছড়িয়ে দিতে কিংবা আর্থিক সুবিধা পেতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক, তারকা ব্যক্তিত্ব ও ইনফ্লুয়েন্সাররা অপতথ্য ছড়ানোর কাজটি করে থাকতে পারেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক চিকিৎসক কোভিড-১৯-এর টিকাকে ‘চিকিৎসা জালিয়াতি’ আখ্যা দিয়ে ৬০০টি কলাম লিখেছেন। সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আর্থিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন কোম্পানি অপতথ্য ছড়াতে পারে। যেমন ওপেন ডেমোক্রেসি নামের একটি সংবাদমাধ্যম অভিযোগ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা দিয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠান।
কীভাবে অপতথ্য ছড়ানো হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন নিউজ সাইট, প্রথাগত সংবাদমাধ্যম, এমনকি অফলাইনেও অপতথ্য ছড়াতে পারে। কোনো পরিচিত মুখ ইন্টারনেটে অপতথ্য ছড়িয়ে দিতে পারেন। অপতথ্য ছড়ানোর জন্য কিছু নিউজ সাইট বানানো হয়। তখন অনেকটা সঠিক খবরের মতো করে এসব সাইট অপতথ্য ছড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হয়। অনেক সময় প্রথাগত সংবাদমাধ্যমও এসব অপতথ্য প্রকাশ করে থাকে।
আরও পড়ুনঅপতথ্য ছড়ানোর উৎসে থাকে সরকার ক্ষমতা টাকা১৬ নভেম্বর ২০২৪সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
অপতথ্য ছড়ানোর মূলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এর বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককে দায়ী করে থাকেন গবেষক, সরকার ও শিল্প খাতের পক্ষগুলো। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১৬ দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর জরিপ চালায় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইপসোস। এতে দেখা যায়, তাদের ৫৬ শতাংশেরই খবর পাওয়ার প্রধান উৎস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর ৬৮ শতাংশই জানায়, এখানে অপতথ্যের ছড়াছড়ি। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও অপতথ্য ছড়ানো হয়।
অপতথ্য ছড়ানোর নিউজ সাইট
কিছু ওয়েবসাইট তৈরি করাই হয় অপতথ্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে। এসব সাইটের খবরের ধরন এবং খবরের বরাত দেখে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের খবরের মতোই মনে হয়। নিউজগার্ড নামের একটি ওয়েবসাইট ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো ৪৭১টি ভুয়া নিউজ সাইট শনাক্ত করেছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালিত ৭৫০টি ওয়েবসাইট শনাক্ত করেছে, যেগুলো অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে।
আরও পড়ুন১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য প্রচার০৩ ডিসেম্বর ২০২৪অফলাইনে অপতথ্য
ছাপা পত্রিকা ও সম্প্রচারমাধ্যম, রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি, আলাপ-আলোচনাসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও অপতথ্য ছড়াতে পারে। যেমন কোনো গোষ্ঠী অন্যদের হেয় করতে প্রচারপত্র ও স্টিকার বিতরণ করতে পারে। আর অফলাইনে ছড়ানো অপতথ্য রোধ করাও কঠিন। কারণ, অনলাইনে তথ্য যাচাই-বাছাই করার কিছু ব্যবস্থা থাকলেও অফলাইনের অপতথ্যের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
অপতথ্য মোকাবিলায় একটি বড় উপায় হতে পারে সঠিক তথ্যের প্রবাহ বাড়ানো। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উৎসের বরাত দিয়ে অপতথ্যটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। তথ্য যাচাই ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আরও বেশি যাচাই-বাছাই এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে অপতথ্য ও এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইউকে পার্লামেন্ট পোস্ট নোট
আরও পড়ুনঅপতথ্য বেশি ছড়াচ্ছে ভারতের গণমাধ্যম১৭ আগস্ট ২০২৪আরও পড়ুনঅপতথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে তো লড়তেই হবে, কীভাবে ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ল ও অপতথ য অপতথ য র র জন ত ক র বর ত ত হয় ছ খবর র সরক র র একট ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ভুল তথ্য ও অপতথ্য কী, কারা এবং কেন এসব ছড়ায়
সংবাদমাধ্যমসহ প্রচলিত মাধ্যমগুলোর বাইরে তথ্যের অবাধ প্রবাহের জায়গায় পরিণত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যে কারও তথ্য দেওয়ার সুযোগ থাকায় এবং এসব তথ্য যাচাইয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এটি ভুল ও অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র—প্রায় সব জায়গায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমনকি ভুল ও অপতথ্যের কারণে জাতিগত ও ধর্মীয় দাঙ্গার মতো প্রাণঘাতী সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।
ভুল তথ্য ও অপতথ্য কী
ভুল তথ্য ও অপতথ্য শব্দ দুটি অনেকটা কাছাকাছি মনে হলেও ব্যবহারিক কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যদিও এ দুটির কারণে প্রায় একই রকম নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তবে ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্য এক নয়।
ভুল তথ্য: বিবিসি বলছে, ভুল তথ্য হলো ভুয়া খবর, যা কেউ ভুলবশত করে থাকেন এবং ছড়িয়ে থাকেন, যিনি বুঝতে পারেন না এটি ভুয়া।
এখানে যে মূল বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, সেটি হলো ভুল তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হয় না। লোকজনকে ধোঁকা দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে এটি তৈরি করা হয় না। এটা তখনই হয়, যখন প্রকৃত ঘটনা, বাস্তবতা ও খবর না বুঝে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা হয় বা ঘটনাক্রমে কাউকে উল্টো তথ্য দেওয়া হয়।
যেমন একবার এক্সে (সাবেক টুইটার) দাবি করা হলো, দুবাই শহরে কম্পন অনুভূত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি ছিল, পুরোনো ভবন ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করার সময় আশপাশে এ কম্পন অনুভূত হয়েছিল।
অপতথ্য: বিবিসি বলছে, অপতথ্য হলো ভুয়া খবর, যা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করে এবং ছড়িয়ে দেয়। ওই ব্যক্তি জানে, এটি ভুয়া খবর।
মূলত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যখন কেউ ভুয়া খবর তৈরি করে এবং ছড়ায়, সেটি হলো অপতথ্য। এর সঙ্গে ব্যক্তি বা কোনো বিষয়কে অসম্মান বা সমালোচনার বিষয়টি জড়িত থাকতে পারে।
যেমন একবার একটি পোস্টে একটি ছবি জুড়িয়ে দিয়ে বলা হলো, লালগালিচায় দাঁড়িয়ে ‘তর্ক’ করছেন বেন অ্যাফ্লেক ও জেনিফার লোপেজ। এটি ছিল মিথ্যা। মূলত তাঁরা এমনি নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। মূলত পাঠক টানতে জেনে-বুঝে এই ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছিল।
কারা, কেন অপতথ্য ছড়ায়
সাধারণত অপতথ্য ছড়ানোর উৎস খুঁজে বের করাটা কঠিন। অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। নানা মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে নতুন এবং বিদ্যমান ভুল ও অপতথ্যগুলো ছড়ানো হয়।
বিদেশি রাষ্ট্র
সন্দেহ-সংশয় উসকে দিতে, রাজনৈতিক বিভাজন বাড়াতে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করতে এবং সমাজে অবিশ্বাসের বীজ বপন করতে বিদেশি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অপতথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অপতথ্য ছড়ানোর অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ছড়ানো বিপুল ভুল ও অপতথ্য শনাক্ত করেছে তথ্য যাচাইকারী (ফ্যাক্ট চেক) প্রতিষ্ঠানগুলো।
রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক
রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের দেওয়া বক্তব্য অপতথ্য ছড়ানোর উৎস হতে পারে বলে গবেষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। ৭০টি দেশে একটি গবেষণা চালিয়েছিল অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট। ২০২০ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে ৬২টি দেশেই জনমত পাল্টে দিতে অপতথ্য ব্যবহার করেছিল সরকারি সংস্থাগুলো।
সংবাদমাধ্যমের ৫৫ হাজার প্রতিবেদন, ৫০ লাখ টুইট ও ৭৫ হাজার ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘মেইল ব্যালটের’ মাধ্যমে ভোট কারচুপি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিত্তিহীন দাবি ছড়িয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর একটি জরিপ চালায় রয়টার্স ইনস্টিটিউট। এতে ইন্টারনেটে কোনটি ‘সঠিক’ আর কোনটি ‘ভুয়া’ খবর—এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ৬৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় রাজনৈতিক পক্ষ ও সাংবাদিকদের ছড়ানো ভুল ও অপতথ্য নিয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বিদেশি সরকারের চেয়ে নিজ দেশে সরকারের ছড়ানো অপতথ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।
অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক
মতাদর্শিক এজেন্ডা আছে, এমন গোষ্ঠীগুলো অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন তত্ত্ব অস্বীকারকারী ও টিকাবিরোধী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ভিন্নমত পোষণকারী গোষ্ঠীগুলোরও অপতথ্য ছড়ানোর নজির আছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সম্পৃক্ততাও থাকে। অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের তৈরি অপতথ্য আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে পারে সরকারি পক্ষগুলো।
ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান
রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক এজেন্ডা ছড়িয়ে দিতে কিংবা আর্থিক সুবিধা পেতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক, তারকা ব্যক্তিত্ব ও ইনফ্লুয়েন্সাররা অপতথ্য ছড়ানোর কাজটি করে থাকতে পারেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক চিকিৎসক কোভিড-১৯-এর টিকাকে ‘চিকিৎসা জালিয়াতি’ আখ্যা দিয়ে ৬০০টি কলাম লিখেছেন। সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আর্থিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন কোম্পানি অপতথ্য ছড়াতে পারে। যেমন ওপেন ডেমোক্রেসি নামের একটি সংবাদমাধ্যম অভিযোগ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা দিয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠান।
কীভাবে অপতথ্য ছড়ানো হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন নিউজ সাইট, প্রথাগত সংবাদমাধ্যম, এমনকি অফলাইনেও অপতথ্য ছড়াতে পারে। কোনো পরিচিত মুখ ইন্টারনেটে অপতথ্য ছড়িয়ে দিতে পারেন। অপতথ্য ছড়ানোর জন্য কিছু নিউজ সাইট বানানো হয়। তখন অনেকটা সঠিক খবরের মতো করে এসব সাইট অপতথ্য ছড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হয়। অনেক সময় প্রথাগত সংবাদমাধ্যমও এসব অপতথ্য প্রকাশ করে থাকে।
আরও পড়ুনঅপতথ্য ছড়ানোর উৎসে থাকে সরকার ক্ষমতা টাকা১৬ নভেম্বর ২০২৪সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
অপতথ্য ছড়ানোর মূলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এর বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককে দায়ী করে থাকেন গবেষক, সরকার ও শিল্প খাতের পক্ষগুলো। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১৬ দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর জরিপ চালায় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইপসোস। এতে দেখা যায়, তাদের ৫৬ শতাংশেরই খবর পাওয়ার প্রধান উৎস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর ৬৮ শতাংশই জানায়, এখানে অপতথ্যের ছড়াছড়ি। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও অপতথ্য ছড়ানো হয়।
অপতথ্য ছড়ানোর নিউজ সাইট
কিছু ওয়েবসাইট তৈরি করাই হয় অপতথ্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে। এসব সাইটের খবরের ধরন এবং খবরের বরাত দেখে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের খবরের মতোই মনে হয়। নিউজগার্ড নামের একটি ওয়েবসাইট ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো ৪৭১টি ভুয়া নিউজ সাইট শনাক্ত করেছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালিত ৭৫০টি ওয়েবসাইট শনাক্ত করেছে, যেগুলো অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে।
আরও পড়ুন১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য প্রচার০৩ ডিসেম্বর ২০২৪অফলাইনে অপতথ্য
ছাপা পত্রিকা ও সম্প্রচারমাধ্যম, রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি, আলাপ-আলোচনাসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও অপতথ্য ছড়াতে পারে। যেমন কোনো গোষ্ঠী অন্যদের হেয় করতে প্রচারপত্র ও স্টিকার বিতরণ করতে পারে। আর অফলাইনে ছড়ানো অপতথ্য রোধ করাও কঠিন। কারণ, অনলাইনে তথ্য যাচাই-বাছাই করার কিছু ব্যবস্থা থাকলেও অফলাইনের অপতথ্যের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
অপতথ্য মোকাবিলায় একটি বড় উপায় হতে পারে সঠিক তথ্যের প্রবাহ বাড়ানো। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উৎসের বরাত দিয়ে অপতথ্যটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। তথ্য যাচাই ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আরও বেশি যাচাই-বাছাই এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে অপতথ্য ও এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইউকে পার্লামেন্ট পোস্ট নোট
আরও পড়ুনঅপতথ্য বেশি ছড়াচ্ছে ভারতের গণমাধ্যম১৭ আগস্ট ২০২৪আরও পড়ুনঅপতথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে তো লড়তেই হবে, কীভাবে ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪