নতুন দলের নিবন্ধন পেতে কী শর্ত পূরণ করতে হবে, রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ কী
Published: 5th, March 2025 GMT
নতুন মুখ, তরুণ নেতৃত্ব। তাঁদের নিয়েই আত্মপ্রকাশ করল নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মূলত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয়েছে এ দল।
চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসাবে নতুন দলটির হাতে সময় ১০ থেকে ১১ মাস।
এর মধ্যেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন দলের সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ—নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভোটের মাঠের লড়াই, ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জনসহ নানা বিষয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করার পরই আলোচনা হচ্ছে, নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে কতটা সফল হবে তারা।
আরও পড়ুনতরুণদের নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫নিবন্ধনের যত শর্ত
কোনো দল দলীয় প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে প্রথমে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯০ ক ধারা অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে চাইলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে।
১.
২. সেসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন, সেসব আসনে মোট ভোটের ৫ শতাংশ অর্জন।
৩. কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে। দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় জেলা অফিস থাকতে হবে। আর অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার থানায় অফিস থাকতে হবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ জন ভোটার থাকবে।
আরও পড়ুনজাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের কে কোন পদে২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এসব ছাড়াও নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলটির গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখা (২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ)—এসবসহ আরও কিছু বিধান রাখার শর্ত রয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে নিবন্ধন পেতে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য কিছু শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব হলো, নিবন্ধন পেতে ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ উপজেলা বা থানায় দলের অফিস এবং দলটির কমপক্ষে পাঁচ হাজার সদস্য থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘(রাজনীতিতে) নতুন হওয়ায় এতগুলো জেলা, এতগুলো উপজেলায় অফিস করা তো একটু কষ্টকর, কঠিন ব্যাপার। আসলে রাজনৈতিক দল বেশি আসুক, নতুন নতুন কার্যক্রম করুক, এটাকেই উৎসাহিত করার জন্য মূলত শর্তটাকে শিথিল করা (সুপারিশ) হয়েছে।’
আরও পড়ুন‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে কী বোঝাতে চাইছে জাতীয় নাগরিক পার্টি০১ মার্চ ২০২৫জেসমিন টুলী আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন পেতে হলে অবশ্যই তিন বছর দলের সদস্য হতে হবে। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু তারা নতুন।’
বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়, তখন সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করবে। আর তা না হলে আগের আইন অনুসারেই নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে হবে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে।
আরও পড়ুননাহিদকে আহ্বায়ক করে ১৭১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ তৃণমূলে
জাতীয় নাগরিক পার্টি তৃণমূল গোছানোকে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে। দলের মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের ঘোষণা এসেছে। সেটিকে পুনর্গঠিত করা, সাংগঠনিক কাঠামোতে এনে নিবন্ধন পাওয়ার কিছু শর্ত পূরণ করা, সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলটিকে সাংগঠনিক কাঠামোতে আনার প্রক্রিয়াটি দলের ‘প্রাথমিক বৈতরণী’।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ ওই অর্থে, রাজনৈতিক একটা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় যেতে হয়েছে। বিরাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে যে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, সেটি উত্তরণ করে একটি সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, এটিই হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসংখ্যা ২১৬। সেখানে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা নেতার সংখ্যা প্রায় সমান।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সারা বাংলাদেশে ৪৫০টির বেশি কমিটি রয়েছে।
আরও পড়ুনকমিটির আকার বাড়বে, লক্ষ্য তৃণমূলে বিস্তৃতি ০২ মার্চ ২০২৫বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি রয়েছে ১২০টির বেশি।
যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক কোনো দল হিসেবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। তবে জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূল পর্যায়েও জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিগুলোই দলের কমিটিতে রূপান্তরিত হবে কি না, সেই আলোচনাও রয়েছে।
এ বিষয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে কেউ জাতীয় নাগরিক পার্টিতে আসতে চান, অবশ্যই পদত্যাগ করে আসতে হবে। যারা নতুন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়, সবার জন্যই এ প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির, যিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পাওয়ার জন্য পুরাতন আইনে যে নিয়ম আছে, ২১টা জেলা, ১০০টা উপজেলায় কমিটি থাকা লাগবে, তার থেকে বেশি আমাদের আছে।’
আরও পড়ুনগণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি১৬ ঘণ্টা আগেজয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, ‘আমরা এখন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেওয়ার পর ওই বিপ্লবীরা যাঁরা বিচ্ছিন্ন, ছন্নছাড়া ছিলেন এত দিন, তাঁরা আবার এসে এক হবেন। যদি আবার এক হয়ে যাই, এটা বিশাল একটা রাজনৈতিক শক্তি হবে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটিগুলোর প্রতিটিতে গড়ে দেড় শর মতো সদস্য রয়েছেন বলে জানান জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির লোকজনের জাতীয় নাগরিক পার্টিতে বেশি আগমন ঘটবে, স্বেচ্ছায় আসবে তারা।’
এনসিপির জন্য ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোঁজার কাজ চলছে। দলের প্রতীক এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে কিছু প্রতীকের প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছে দলটির কয়েকজন নেতা।
হাসনাত আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কীভাবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে তারপর এই কার্যক্রমগুলো পরিচালিত করতে পারি এবং শহর থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষের কাছে যেতে পারি, সেটি নিয়েই আমাদের এখন পরিকল্পনা চলছে।’
হাসনাত আরও বলেন, ‘নির্বাচন যখনই হোক না কেন, আমরা আমাদের রাজনৈতিক যে কর্মসূচি, সেটিকে অব্যাহত রেখে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করতে পারব।’
আরও পড়ুনজাতীয় নাগরিক পার্টির লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫নতুন দলের সম্ভাবনা কতটা
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৯টি। পুরোনো দলের ভিড়ে নতুন এসে আলোচনা তৈরি করেছে এনসিপি। তাদের সম্ভাবনা কতটুকু?
এ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রাসঙ্গিক দুটি শর্তের কথা বলেছেন। প্রথমত, সব জায়গায় সংগঠন থাকা। কারণ, নির্বাচনে অনেক কাজ করতে হয়। কাজেই এনসিপি কত দ্রুত তৃণমূলে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করছে। দ্বিতীয়ত, ভালো প্রার্থী দেওয়া। কারণ, আগে যাঁরা রাজনীতি করেছেন, বিভিন্ন দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, ‘তাঁদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ’।
মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এনসিপি যদি সংগঠন তৈরি করতে পারে এবং ভালো প্রার্থী দিতে পারে, তাহলে অনেক জায়গায় লড়াই জমিয়ে তুলতে পারবে।
আরও পড়ুনআলোচনায় ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’, কী বলছে জাতীয় নাগরিক পার্টি০১ মার্চ ২০২৫ভোটের মাঠে আরেকটি বিষয় হচ্ছে জনপ্রিয়তা। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে অনেক জনপ্রিয় প্রার্থী রয়েছেন। সেখানে নতুন দল হিসেবে এনসিপির কমিটির মুখগুলো খুবই তরুণ।
অতীতের অনেক প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ছিল না উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘টাকা ও পেশির জোরে অনেকে নির্বাচন করে। বড় দলগুলো তো বরাবর তা–ই করেছে। এবার যদি টাকার ছড়াছড়িটা নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আর পেশিশক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’
আরও পড়ুন‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নিয়ে সমর্থকদের প্রত্যাশা২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫যেসব বাধা আসতে পারে
রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা পুরোনো ধারার রাজনীতি করে। তারা নিজেরা বদলাবে না। সুতরাং তারা একটা চ্যালেঞ্জ দেখছে নিজেদের মধ্যে। এবং সেখান থেকেই বাধাটা আসবে।’
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এ ক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দল নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে পারে। তবে কতটুকু হবে, সেটা নির্ভর করে তাদের শক্তিমত্তার ওপর। কারণ ’৭২ সাল বা তারপর দেখা গেছে জাসদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।
কিন্তু এখন যেহেতু অরাজনৈতিক সরকার আছে, সরকারের তরফ থেকে সে রকম কোনো চ্যালেঞ্জ দেখেন না মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্যাওটিক (বিশৃঙ্খলা), মারামারি, পিটাপিটি, মিটিং ভেঙে দেওয়া, টাকা দিয়ে লোক ভাগিয়ে নেওয়া—এগুলো তো হয় আমাদের দেশে। এ ধরনের হয়তো কিছু কিছু হতে পারে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২৮ ফ ব র য় র প রথম আল ক র র জন ত জনপ র য় র সদস য কমপক ষ ন দল র র কম ট র জন য আম দ র দল র স ন বন ধ দলগ ল দলট র সরক র উপজ ল এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের বেশ কিছু মৌলিক সুপারিশের বিষয়ে একমত হয়নি বিএনপি
সংস্কারের যেসব সুপারিশে বিএনপির আংশিক একমত বা ভিন্নমত ছিল, সেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে আসার লক্ষ্যে দলটির সঙ্গে আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তিন দিন আলোচনা হলেও সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মৌলিক পরিবর্তনের বেশ কিছু সুপারিশের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কমিশনের ঐকমত্য হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ হয়। আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রায় ৬৯৪টি প্রস্তাবের মধ্যে বেশির ভাগের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়েছে। আপাতত আলোচনা শেষ হয়েছে। প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আরও আলোচনা হতে পারে।
আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে আছি। সুপারিশমালার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা নিঃসন্দেহে অংশগ্রহণ করবেন।অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে তিন দিন আলোচনা হয়েছে। গতকাল বিএনপির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা শেষ হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে প্রথম আলোচনা হয় গত বৃহস্পতিবার, এরপর গত রোববার।
গতকাল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের যে ২৮টি সুপারিশ নিয়ে নির্বাচন কমিশন আপত্তি জানিয়েছিল, বিএনপিও কমবেশি সেগুলো নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ নেতার পদ থাকা উচিত। দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কি না, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। সালাহউদ্দিন আহমদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপিনির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার জন্য একটি প্রস্তাব করেছিল সংস্কার কমিশন। সেটি হলো মেয়াদ-পরবর্তী সময়ে ইসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করার জন্য সংসদীয় কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়া। এই প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি। তারা মনে করে, এটি বাস্তবায়িত হলে ইসির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে আলাদা একটি কমিশন করার প্রস্তাবেও বিএনপি একমত হয়নি। এক ব্যক্তি একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করতে বলেছিল কমিশন। এর সঙ্গেও একমত নয় বিএনপি।
আলোচনা শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় কমিটির কাছে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তায় আঘাত আসতে পারে। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে এবং মেয়াদ-পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইসির সাংবিধানিক এখতিয়ার। এখানে আরেকটা বডি করা হলে একসঙ্গে দুটি সত্তা হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলেই তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব করেছিল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এর সঙ্গেও একমত হয়নি বিএনপি। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কেউ অভিযুক্ত হলেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে বলা যায় না। শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে অযোগ্য করা যুক্তিসংগত নয়। কেউ আদালতের রায়ে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা যায়।
গতকাল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে তাঁরা ১৪১টিতে একমত হয়েছেন। আংশিক একমত হন ১৪টিতে, মন্তব্যসহ ভিন্নমত দিয়েছেন ৬৪টিতে। আর একমত নন ২৪টিতে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ১৮৭টিতে তাঁরা একমত হয়েছেন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৮৯টি সুপারিশকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে ৬২টিতে তাঁরা একমত হয়েছেন। দুদক সংস্কার কমিশনের ২০টি সুপারিশের মধ্যে ১টিতে তাঁদের আপত্তি আছে। সংবিধান সংস্কারের ১৩১টি সুপারিশের বেশির ভাগের সঙ্গে তাঁরা একমত হয়েছেন।
সংবিধান সংস্কারে যেখানে একমত নয় বিএনপি
সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছিল, তাদের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির অন্যতম লক্ষ্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে এবং রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের (আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করার প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনের। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্য যেকোনো কাজে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয়। বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয় রাষ্ট্রপতিকে। মূলত প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই সাংবিধানিক পদে নিয়োগ হয়। এনসিসি হলে এই পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক থাকবে না। বিএনপি এনসিসি গঠনের প্রস্তাবে একমত হয়নি। তারা মনে করে, এই কাউন্সিল করা হলে সরকার দুর্বল হবে।
বিএনপি অবশ্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সে আইনে রাষ্ট্রপতিকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা তারা স্পষ্ট করেনি। দলটি বলেছে, এ বিষয়ে পরবর্তী সংসদে আলোচনা করে তা ঠিক করা হবে।
বিএনপি বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা তাদের অঙ্গীকার। তবে একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না; এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এই দুটি প্রস্তাবে একমত নয় দলটি। এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন একটি প্রস্তাব আলোচনায় এলেও তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর করা, সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করা, জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবিত বিধান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা, সংবিধানে দেশের নাম পরিবর্তন, নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করার মতো প্রস্তাবগুলোতেও বিএনপি একমত হয়নি।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং নিম্নকক্ষে সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টি করার বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তাদের মত ভিন্ন।
আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে কমিশনের প্রস্তাব ছিল জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে, এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের আগে আইনসভায় উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে। এ প্রস্তাবে একমত হয়নি বিএনপি। তারা এ-সংক্রান্ত সংবিধানের বর্তমান বিধান পরিবর্তনের পক্ষে নয়।
কমিশনের প্রস্তাব ছিল নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রয়োগ করা হবে। এ বিষয়ে বিএনপির মত হলো, মন্ত্রিপরিষদ প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে পরিচালিত হতে হবে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকা উচিত।
সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ নেতার পদ থাকা উচিত। আর দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কি না, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
যেসব বিষয়ে একমত বিএনপি
সংবিধান সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাবের মধ্যে বিএনপি একমত হয়েছে তার মধ্যে আছে—বিদ্যমান সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) বিলুপ্ত করা, সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, উভয় কক্ষে দুজন ডেপুটি স্পিকারের একজন বিরোধী দল থেকে দেওয়া, রাষ্ট্রপতির অভিশংসনপ্রক্রিয়া, ‘অধস্তন আদালত’–এর বদলে ‘স্থানীয় আদালত’ শব্দ ব্যবহার করা, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য অনূর্ধ্ব ১৪ জন রাখা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা ইত্যাদি। কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করার বিষয়েও বিএনপি একমত হয়েছে।
এ ছাড়া সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে পারবেন না, ন্যায়পাল নিয়োগ, স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি এবং প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি-সংক্রান্ত সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার প্রস্তাবের সঙ্গেও বিএনপি একমত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—এ বিষয়গুলো তারা মৌলিক অধিকারের মধ্যে আনার কথা বলেছে।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিকল্প রাখার পক্ষে
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। তবে এই সুপারিশের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় বিএনপি। গতকাল বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, এখানে বিকল্প রাখা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ অন্তত দুই থেকে তিনজন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ রাখার পক্ষে বিএনপি। তিনি বলেন, বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৭০ বছর করার প্রস্তাবের বিষয়ে তাঁরা বলেছেন, এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ, অন্যান্য বিভাগ থেকেও একই দাবি আসতে পারে।
ঐতিহাসিক মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে
সালাহউদ্দিন আহমদ ছাড়াও গতকালের আলোচনায় বিএনপির পক্ষে অংশ নেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বেশ কিছু সুপারিশের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে। আবার মতের ভিন্নতাও রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, তার অনেকগুলো বিষয়ে তারা তাদের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনকে জানাবে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সন্ধিক্ষণে আছি। সুপারিশমালার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেবল এই টেবিল থেকে হতে পারে না। কারণ, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা নিঃসন্দেহে অংশগ্রহণ করবেন।’