সাবেক বিচারপতি মানিক রিমান্ডে, নতুন মামলায় গ্রেপ্তার আনিসুল-শাজাহানসহ ১৬ জন
Published: 5th, March 2025 GMT
গুলশান থানার একটি হত্যা মামলায় আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দুই দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক; সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান; সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এসব আদেশ দেন।
গুলশান থানায় করা আরজু শেখ হত্যা মামলায় শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আজ আদালতে হাজির করে তাঁকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি নিয়ে তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে আজ সকালে আনিসুলসহ অন্যদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আনিসুল, শাজাহানদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। আদালত তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
কারাগারে পাঠানো অপর আসামিরা হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহম্মেদ মজুমদার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিম, একাত্তর টিভির সাবেক সাংবাদিক শাকিল আহম্মেদ ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা রুপা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুজাহিদ ইসলাম, চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী সিরাজুল ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, আওয়ামী লীগ সদস্য রাতুল ও লালবাগ থানা আওয়ামী লীগ নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও শেখ মোহাম্মদ আলী আড্ডু।
আইনজীবী ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যাত্রাবাড়ী থানার মামলায় আনিসুল হক, শাজাহান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, আবুল হাসান, ফারজানা রুপা, শাকিল আহম্মেদ, মুজাহিদ ইসলাম, তানভীর হাসান সৈকত ও আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এ ছাড়া মিরপুর থানার মামলায় কামাল আহম্মেদ মজুমদার, খিলগাঁও থানার মামলায় তাজুল ইসলাম, লালবাগ থানার মামলায় সোলায়মান সেলিম, হাজী সিরাজুল ইসলাম, ওয়ালিউল্লাহ ও রাতুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে পল্লবী থানার মামলায় শেখ মোহাম্মদ আলী লাড্ডুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন আনিসুল হক। এরপর বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল আহম ম দ জ ল ইসল ম জ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা জরুরি
অপরাধের পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একপক্ষীয় চিত্র তুলে ধরে। এতে সবসময় সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে না। কারণ পরিসংখ্যান অনেক সময় অপরাধের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে বিবেচনা করে না। বাংলাদেশের ২০২৪ সালের পরিস্থিতির তুলনায় ২০২৫ সালের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। পৃথিবীর অন্য দেশে আন্দোলন বা বিপ্লবের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসকের সরকারের পতনের পরের চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে তুলনা করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, স্বৈরশাসনের পতনের পর অপরাধের হার শুরুর দিকে বৃদ্ধি পায়। পরে তা সময়ের সঙ্গে কমে আসে। শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর ২০২২ সালে গুরুতর অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনকি ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর শুরুর দিকে অপরাধের হার বেড়েছিল।
আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১-৯২ সালের মধ্যে রাশিয়ায় অপরাধের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ যেমন– এল সালভাদর, গুয়েতেমালা ও ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রে উত্তরণকালে অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলাদেশও এই প্রবণতার বাইরে নয়।
আবার বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ যে চ্যালঞ্জের মুখে পড়েছিল, তেমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীকে পড়তে হয়নি। বর্তমানে পুলিশ একটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও সময়ের সঙ্গে পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতিকে সামলে নিচ্ছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশে অপরাধের হার দিন দিন কমে আসবে।
আট মাসের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মব জাস্টিস’। নিজেরা আইন হাতে তুলে নেওয়া। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আচরণের পেছনে হয়তো বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এমনটা চলতে থাকলে তা সামগ্রিকভাবেই রাষ্ট্রের কাঠামোয় আঘাত হানবে। দেশের সুনাম নষ্ট হবে বহির্বিশ্বে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের ইউলসন অ্যান্ড কেলিং (১৯৮২)-এর ব্রোকেন উইন্ডোজ তত্ত্ব বিবেচনায় নিতে হবে। এই তত্ত্বমতে, ছোট অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে মানুষ ভাবতে শুরু করে– আইনের প্রয়োগ নেই। তখন তারা নিজেরা তা করতে শুরু করে। তাই ‘মব জাস্টিস’ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করতে অনেক দেশ নরম-গরম কৌশল (হার্ড অ্যান্ড সফ্ট স্ট্র্যাটেজি) নিয়েছে। যেমন শ্রীলঙ্কা জরুরি আইন ও কাউফিউ জারি করে কঠোরভাবে সব ধরনের বিক্ষোভ ও সন্ত্রাস দমন করেছে। একই সঙ্গে তারা জাতীয় সংলাপ ও কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে। আফগানিস্তান দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাশিয়া গ্যাং এবং মাফিয়া-শাসিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এফএসবি ও পুলিশের যৌথ অভিযান পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং এনজিওর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। আবার এল সালভাদর অপরাধীদের গ্রেপ্তারে ন্যাশনাল ক্র্যাকডাউন প্রোগ্রাম পরিচালনার পাশাপাশি ডিজিটাল পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করে মানুষের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশও ইতোমধ্যে কার্যকর বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর পরও যারা ‘মব জাস্টিস’-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটকের একটি বিখ্যাত উক্তি– ‘আমাকে শুধু দয়ালু হওয়ার জন্য নির্মম হতে হবে (আই মাস্ট বি ক্রুয়েল অনলি টু বি কাইন্ড)।’
দেশের বর্তমানে সংঘটিত ‘মব জাস্টিস’-এর পেছনে রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণে এখানেও এখন ‘নরম-গরম’ কৌশল কাজে লাগাতে হবে। নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য নাগরিক পুলিশিং জোরদার করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। তাহলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: মো. ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ; বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য