গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব রাজনীতিতে কতটা সফল হবে?
Published: 4th, March 2025 GMT
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের একাংশের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত জমায়েত দেখতে আমিও গিয়েছিলাম। সেখানে অবস্থানকালে যেসব কথা মনে আসে, তার একটি হলো, এরা তো আরও ক’মাস আগেই এভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসতে পারত। ‘গণঅভ্যুত্থানের চেতনা’য় নতুন দল গঠন অপরিহার্য হলে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছয় মাস দেরি হলো কেন? নতুন দলই যদি গঠন করতে হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানের কী প্রয়োজন? নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মাত্র ক’দিন আগে উপদেষ্টা পরিষদ ছাড়লেও তাঁর আরও দুই সহযোদ্ধা এখনও সেখানে আছেন। এটি নিয়েও বিতর্ক চলমান।
নতুন রাজনৈতিক দলের আগে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’-এর আত্মপ্রকাশ নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের দু’পক্ষে সংঘর্ষ দুর্ভাগ্যজনক। এতে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাই প্রকাশ পেয়েছে। এটাও ঠিক, চট করে কোনো কিছু পরিবর্তিত হবে না।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ভাড়া করে কত লোক আনা হয়েছিল– এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। তবে ওখানে অবস্থান করে আমার মনে হয়েছে, নিজ উদ্যোগে আসা তরুণদের উপস্থিতিই বেশি। মধ্যবয়সী উৎসাহী মানুষও কম দেখিনি। তবে কোনো কোনো অঞ্চল থেকে জমায়েতে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে যানবাহন সংগ্রহ করে দিতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতার খবর সরকার ও নতুন দল কারও জন্যই ভালো হলো না। এর যে ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়া হয়েছে, সেটিও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর আগে গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সরকারি প্রটোকল দেওয়া নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।
এনসিপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠনে কিছুটা দেরি হলেও এতে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস লক্ষণীয়। নানা ঘটনায় বলাবলি হচ্ছিল, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় থাকা ছাত্রনেতাদের মধ্যে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব’ অনুপস্থিত। অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে রয়েছে বলে সমালোচনা ছিল। অথচ গণঅভ্যুত্থানে তাদের বিরাট অংশগ্রহণের কথা সবার জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও পরে অন্যান্য পক্ষই তা বেশি করে টেনে নিয়ে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানে গণমানুষও কম সম্পৃক্ত হয়নি। প্রচলিত রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকাও ছিল বিরাট। এ প্রেক্ষাপটে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক কমিটিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মানুষকে যুক্ত করার প্রয়াস প্রশংসা পাবে। এতে কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়লেও ক্ষতি নেই।
সন্দেহ নেই, গণঅভ্যুত্থানের পর একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দেশে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত কিনা, সে প্রশ্ন পাশে সরিয়ে রেখে সবারই এখন এখান থেকে উত্তরণের প্রয়াস নিতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল গঠনের উদ্যোগকেও সে প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে। আগেও বলেছি; আবারও বলি, ভালো হতো তাদের প্রত্যেকে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বেরিয়ে এ প্রক্রিয়ায় একযোগে শামিল হলে। আরও ভালো হতো তারা উপদেষ্টা পরিষদে যোগ না দিলে। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত হলে বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি তো বাড়ে। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও ভালো হওয়ার কথা নয়। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারও বিতর্কিত হওয়ার বাড়তি চ্যালেঞ্জে রয়েছে। এমনিতেও তার চ্যালেঞ্জ অতুলনীয় রকম বেশি।
এনসিপি ‘কিংস পার্টি’ কিনা– এ প্রশ্নও পিছু ছাড়ছে না অন্তর্বর্তী সরকারের। এর প্রধান ড.
একটা গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। সেটি চলতি বছরের মধ্যেই হবে বলে ধরে নিয়েছে সবাই। এ নিবন্ধ লেখার আগমুহূর্তে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারেও তেমন প্রত্যয় পরিলক্ষিত হলো। সব পক্ষের ঐকমত্যে সংস্কারের তালিকা ‘খুব সংক্ষিপ্ত’ হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যেও নির্বাচন হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে কিন্তু সবাই একমত নয়। এনসিপি ‘গণপরিষদ’ গঠনের দাবি জানালেও তাতেও ঐকমত্য নেই। আর রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে নিজে থেকে কিছুই করবে না অন্তর্বর্তী সরকার– এটি তাদের স্পষ্ট ঘোষণা। এ অবস্থায় ধরে নেওয়া যায়, ভিন্ন দাবিদাওয়া থাকলেও জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্যই কাজ শুরু করতে হবে এনসিপিকে। এর আগে অবশ্য তাদের পেতে হবে নিবন্ধন। সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণে গঠনতন্ত্র প্রস্তুত ও যথেষ্ট সংখ্যক কার্যালয় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হবে বলে কেউ মনে করছে না। তবে শঙ্কা রয়েছে সামনের দিনগুলোয় নতুন দলটির পথচলা নিয়ে। গণঅভ্যুত্থান থেকে সৃষ্ট এবং ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’র কথা নিজেরাই বলছে বলে তাদের দিকে আলাদা দৃষ্টি থাকবে সবার। তাই বিশেষ সতর্কতার সঙ্গেই পথ চলতে হবে।
নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে বলে রাজনৈতিক দল গঠন করেও তারা সাফল্য দেখাবে– বিষয়টি এত সরল নয়। নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন আরও পরের বিষয়। গণতন্ত্রে নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এলেও নির্বাচিত নয় বলে তাকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলা যাচ্ছে না। আমাদের একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার লাগবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তার হাতে শাসনভার দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেখান থেকেই কিন্তু হয়েছিল সংকটের সূত্রপাত, যার নিষ্পত্তি হয় রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে। এতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, পরে অন্য ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও জাতি তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। চব্বিশের অগণিত শহীদ আর আহত যোদ্ধাদেরও কেউ ভুলবে না। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রেখে এবং এর মূল্যবোধ ধারণ করেই এগোতে হবে। এ ধারায় নবগঠিত এনসিপির জোরালো, অর্থবহ অংশগ্রহণই দেখতে চাইব।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এনস প গণঅভ য ত থ ন র গণত ন ত র ক উপদ ষ ট দল গঠন গ রহণ ক ষমত গঠন র এনস প সরক র অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই আন্দোলনকে ‘তথাকথিত’ বলায় ঢাবি ছাত্রদল সভাপতির দুঃখপ্রকাশ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ‘তথাকথিত আন্দোলন’ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতির ‘র’ও বোঝেনা বলায় সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস।
সোমবার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাবির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শাখা ছাত্রদল আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি এ বক্তব্য দিয়েছিলেন। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়।
সোমবার (২১ এপ্রিল) ১১টার দিকে নিজের ফেসবুকে এক বিবৃতি দিয়ে বক্তব্যের দুটি অংশ অসাবধানতাবশত বলেছেন দাবি করে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
আরো পড়ুন:
‘আল্লামা ইকবাল ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক সূত্রে গাঁথা’
‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ইসলামবিরোধী’
গণেশ চন্দ্র রায় তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, “ছাত্রদল নেতা পারভেজ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধনে আমার দেওয়া বক্তৃতার দুইটি অংশ নিয়ে আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা লক্ষ্য করছি। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক সময় রাজনীতির অনেক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কেননা ফ্যাসিবাদের আমলে সে পরিবেশ ছিল না। কিন্তু অসাবধানতাবশত বলে ফেলেছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক সময় রাজনীতির ‘র’ নিয়েও মাথা ঘামায় না। আমি আমার বক্তব্যে অসাবধানতাবশত এ বাক্যটি বলেছি।”
তিনি বলেন, “আমি এ বাক্য দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তুলিনি। আমি আমার পুরো রাজনৈতিক জীবনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এরকম মনোভাব কখনো কোথাও পোষণ করিনি। বরং আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেন্টিমেন্ট ধারণ করি এবং আজীবন তা ধারণ করার জন্য বদ্ধপরিকর।”
তিনি আরও বলেন, “আমার এই কথায় কেউ মনোক্ষুণ্ন হয়ে থাকলে, তাদের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি।”
একইসঙ্গে বক্তব্যের আরেকটি অংশে জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিয়ে ‘তথাকথিত’ শব্দটি ব্যবহার করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই বিষয়ে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমার আরও বেশি সচেতন হতে হবে। আমার অনাকাঙ্ক্ষিত এ কথাটি সেই আবেগের জায়গায় যদি আঘাত দিয়ে থাকে, আমি সবার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।”
তিনি আরো বলেন, “আমি আশা রাখবো আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে আরো অধিক পরিমাণে রাজনীতি সচেতন হব। গঠনমূলক সমালোচনা ও তার যুক্তিযুক্ত জবাবের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ চর্চাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।”
এদিকে, জুলাই-আগস্টের গৌরবময় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ‘তথাকথিত আন্দোলন’ বলায় গণেশের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শুরু হয় সমালোচনা। এ ব্যক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, জাতীয় ঐক্য বিরোধী ও অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখা।
সোমবার (২১ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে ঢাবি শাখা শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, জুলাই বিপ্লব ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসর ব্যতীত বাংলাদেশের সব মত ও পথের মানুষকে একত্রিত করেছিল। পিলখানা থেকে শাপলার গণহত্যা, জাতীয় নেতৃবৃন্দের বিচারিক হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন এবং অবিচারের ভয়াবহ সংস্কৃতি আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি এদেশে কায়েম করেছিল। তার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষ তার অধিকার ও বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মাধ্যমে।
তারা আরো বলেন, ছাত্রদলের এমন বক্তব্য শহীদদের রক্তকে অপমান, আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারী গাজীদের সঙ্গে প্রতারণা। এটা ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে খাটো করে দেখার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ ও ছাত্রসমাজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও গণমুখী সংগ্রামকে আওয়ামী বাকশালীদের মতো অপমানসূচক শব্দ ব্যবহার করে হেয় প্রতিপন্ন করার ধৃষ্টতা দেখানো অন্যায্য ও অত্যন্ত নিন্দনীয়। ছাত্রদলের কাছ থেকে আমরা আরো দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করি।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী