নারীর ওপর হামলা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপব্যাখ্যা
Published: 4th, March 2025 GMT
শুরুতে বলে রাখা ভালো, এই নিবন্ধ ধূমপান উৎসাহিত করার জন্য নয়। ধূমপান অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। এই লেখা পিতৃতন্ত্রের ঝাণ্ডাধারী মোরাল পুলিশের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেভাবে আসল অপরাধীদের ধরার কথা না বলে আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যা শেখালেন, সেটি নিয়ে।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর– নারী-পুরুষ সবার স্বাস্থ্যের জন্যই। কিন্তু এই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের পরও অগণিত মানুষ ধূমপান করে। কারণ এটি একটি বদঅভ্যাস। যারা নিয়মিত ধূমপান করে, তারা সহজে ছাড়তে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে পিতৃতন্ত্র আপত্তি তোলে কেবল নারীর ধূমপানের বেলায়। ছেলেরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে এই পিতৃতন্ত্রের তেমন বিকার হয় না। বিকার তুঙ্গে ওঠে, যদি ধূমপানকারী নারী হয়। পিতৃতন্ত্র তখন অবধারিতভাবে বক্তব্য হাজির করে– ‘মেয়েটা খারাপ’। এভাবে ‘স্লাট শেমিং’ এবং ‘মোরাল পুলিশিং’ শুরু করে দেয় আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।
এখানে লক্ষণীয়, ধূমপানের স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে এরা খুব একটা চিন্তিত নয়। নারী কিংবা পুরুষ কারও জন্যই নয়। তাদের আসল সমস্যা হলো নারী ধূমপান করায়। অথচ দেশের কোনো আইনে কোথাও কি লেখা আছে যে, নারীরা ধূমপান করতে পারবে না?
সম্প্রতি লালমাটিয়ায় দুই নারী এক টং দোকানে বসে চা ও সিগারেট খাচ্ছিলেন। লাখ লাখ ছেলে টং দোকানে বসে তা-ই করে। তখন কেউ কোনো সমস্যা বোধ করে না। অথচ সেখানে ‘মব’ খাড়া করে ওই দুই নারীর গায়ে হাত তোলা হলো। তাদের ‘বেশ্যা’ বলা হলো। প্রতিবাদ করায় তাদের যৌন হয়রানি করা হলো, মারধর করা হলো। এমনকি জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হলো। এ সবই গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু এই ফৌজদারি অপরাধ করার জন্য অপরাধীদের ধরা হলো না।
আমরা দেখলাম, নারীদের গায়ে হাত তুলে, তাদের যৌন নিপীড়ন করে ফৌজদারি অপরাধ করল যারা, তাদের গ্রেপ্তারের জন্য কোনো উদ্যোগই নেওয়া হলো না। উল্টো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রকারান্তরে সেই সব অপরাধীর পক্ষে সাফাই গেয়ে আমাদের আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যা দিলেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। তাই সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান না করে (প্রথম আলো)।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে মনে হতেই পারে– ঠিকই তো। আইনে আছে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে জরিমানা! বাস্তবে ২০০৫ সালে প্রণীত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জরিমানা ছিল ৫০ টাকা। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হলে জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। ওই আইনের ২(চ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘পাবলিক প্লেস’ অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোনো বা সকল স্থান।’
এটা পরিষ্কার– ওই দুই তরুণী যে টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন এবং ধূমপান করছিলেন, সেটা ‘পাবলিক প্লেস’ নয়। ফলে তারা কোনোভাবেই কোনো আইন ভাঙছিলেন না। তাহলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কোন যুক্তিতে পাবলিক প্লেসের দোহাই পাড়লেন– আমরা জানতে চাই।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই– টং দোকানটি ‘পাবলিক প্লেস’, তাহলেও সে অপরাধের বিচারের ভার কার? আলোচ্য আইনের ১৪ (১) (খ) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারের ভার ‘যে কোনো শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের’। শুধু তাই নয়; ‘কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ব্যতিরেকে কোনো আদালত এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করিবে না।’ ফলে আইন অনুযায়ী কোনোভাবেই কোনো পথচারী বা ‘মব’ ধূমপানের বিচার করতে পারে না। পরিষ্কারভাবে লালমাটিয়ায় মবই আইন লঙ্ঘন করেছে। শুধু তাই নয়; আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াও অপরাধ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শুধু ধূমপানবিষয়ক আইনে উল্লিখিত পাবলিক প্লেসের অপব্যাখ্যাই দেননি; যারা কিনা মব হামলা করল, তাদের বিষয়েও নীরব থেকেছেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব’ (বিডিনিউজ)। লালমাটিয়ার অঘটনা কি শাস্তির আওতায় আনার নমুনা? নারীদের ওপর বিনা অপরাধে হামলা করল যারা; আইন হাতে তুলে নিল যারা; তাদের গ্রেপ্তার না করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্টো ভিকটিমদের বকে দিচ্ছেন আইনের ভুলভাল ব্যাখ্যা হাজির করে!
ড.
মাহতাব উদ্দীন আহমেদ: গবেষক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট; সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি
mahtabjuniv@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ প বল ক প ল স র র জন য আম দ র আইন র অপর ধ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ক্রাচ হাতে, হুইলচেয়ারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মানববন্ধন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা সুচিকিৎসার দাবিতে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে দেড় ঘণ্টা মানববন্ধন করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত শতাধিক আহত ব্যক্তি এই মানববন্ধনে অংশ নেন। তাঁরা বর্তমানে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই মানববন্ধনে পাশের চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরাও অংশ নেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, পঙ্গু হাসপাতালে বিভিন্ন তলায় চিকিৎসাধীন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে আহত ব্যক্তিরা হুইল চেয়ার ও ক্রাচে ভর করে হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পাশের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা এই মানববন্ধনে যোগ দেন।
মানববন্ধনে আহত ব্যক্তিরা বলেন, গুলিতে আহত হয়ে তাঁরা মাসের পর মাস পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু তাঁরা ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সুচিকিৎসার অভাবে তাঁরা সুস্থ হচ্ছেন না। সুচিকিৎসা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আগামী শনিবার থেকে প্রতিদিন পঙ্গু হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া মাদ্রাসা ছাত্র মো. রাফি হোসাইন বলেন, ১৮ জুলাই শ্যামলী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করা গুলির স্প্লিন্টার তাঁর ডান পায়ে লাগে। পরে ৫ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করা গুলি তাঁর দু হাতে লাগে। তাঁর দুই হাতেই ২৫০ স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। এরপর থেকে তিনি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্প্লিন্টারের অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে তাঁর দিন কাটছে। চিকিৎসকেরা ব্যথানাশক ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আর কত দিন ব্যথানাশক ওষুধ খাবেন-এই প্রশ্ন রাখেন।
রাফি বলেন, সুচিকিৎসার দাবিতে আগামী শনিবার থেকে তাঁরা প্রতিদিন বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।
এ ব্যাপারে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক মো. আবুল কেনান আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যস্ত আছেন। পরে কথা বলবেন।