চুক্তির ফাঁদে বন্দি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী
Published: 4th, March 2025 GMT
ময়মনসিংহের অভিবাসী কর্মী হাফিজ (ছদ্মনাম) ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরব যান আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে। তিনি এক সৌদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, যেখানে তাঁকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮০০ রিয়াল বেতন এবং খাবারের জন্য অতিরিক্ত ২০০ রিয়াল দেওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী তিনি বিএমইটি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেন, যা আইনসম্মত অভিবাসনের জন্য প্রয়োজনীয়। তবে সৌদি আরবে পৌঁছানোর পরপরই তিনি নতুন এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন, যেখানে তাঁর বেতন কমিয়ে মাত্র ৮০০ রিয়াল করা হয় এবং তাঁকে জোরপূর্বক খাবার সরবরাহকারী ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়।
হাফিজের গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাঁর মতো অসংখ্য বাংলাদেশি কর্মী প্রতারণার শিকার হন। তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রায় ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও সেখানে গিয়ে প্রতারণার জালে আটকা পড়েন। তাদের স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে যায় এবং শুরু হয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, মজুরি চুরি এবং নির্মম শোষণের দুঃস্বপ্ন।
অভিবাসী কর্মীদের শোষণ বাস্তবে দেশের মাটিতেই শুরু হয়। অসাধু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি ও দালালরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। অধিকাংশ কর্মী অভিবাসন ব্যয় সংগ্রহ করতে তাদের জমিজমা বিক্রি করেন অথবা উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফলে বিদেশে পা রাখার আগেই তারা কঠোর ঋণের ফাঁদে পড়ে যান।
এ শোষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘কাফালা’ নামে স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা, যা অনেক গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) দেশ মেনে চলে। এ কাঠামোর অধীনে অভিবাসী কর্মীরা তাদের নিয়োগকর্তার অধীনে আইনিভাবে দায়বদ্ধ থাকেন এবং তাদের ভিসা ও বসবাসের অনুমতি সম্পূর্ণ নিয়োগকর্তার নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে কর্মীরা চরম নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং সহজেই শোষণের শিকার হন।
কাফালা ব্যবস্থার কারণে অনেক মালিক কর্মীদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেন; ছুটির দিন বা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালান।
নারী গৃহকর্মীদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষণা অনুসারে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশি নারীরা যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আইনি সহায়তাবিহীন এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে।
অনেক কর্মীকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। কর্মীদের ক্যাম্পগুলোতে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব প্রকট। কর্মস্থলে পরিস্থিতি আরও খারাপ– দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতি কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। নির্মাণ শ্রমিক, কারখানা কর্মী এবং গৃহকর্মীরা অতিরিক্ত গরমের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থায় কাজ করেন। অথচ কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পান না।
এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় শুধু অভিবাসী কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোর নয়; বাংলাদেশ সরকারও সমানভাবে দায়ী। বাংলাদেশের সরকার রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হলেও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ; কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আইনি সুরক্ষা প্রদানেও ব্যর্থ। এ ছাড়া দূতাবাসগুলোর পর্যাপ্ত জনবল ও সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি।
অনেক অভিবাসী কর্মী অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ দূতাবাস সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা, তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিও দেখায় না। বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের অবস্থা উন্নত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) দীর্ঘদিন ধরেই কাফালা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও কঠোর শ্রম আইন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এলেও তার বাস্তবায়ন এখনও ধীরগতিসম্পন্ন।
বাংলাদেশ সরকারকে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর ওপর কঠোর নজরদারির সঙ্গে কর্মীদের জন্য বিশদ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যেখানে তাদের আইন, অধিকার ও ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করা হবে। দূতাবাসগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল ও তহবিল বরাদ্দ করতে হবে, যাতে কর্মীরা তাৎক্ষণিক সহায়তা পেতে পারেন। প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে, বাংলাদেশে প্রবাসী কর্মীদের প্রতারণা থেকে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শোষণের বিষয় যেমন একটি অর্থনৈতিক সমস্যা, তেমনি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। এই শোষণের চক্র ভাঙতে হলে সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
পারভেজ আলম: মানবাধিকারকর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ম দ র ব যবস থ র জন য কর ম র অবস থ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
তিরিশের বেশি বয়সীদের ব্রেনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন
বয়স তিরিশের বেশি হলেই ব্রেনের যত্নে আমাদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। কারণ এই সময় অনেকগুলো হরমোনের উৎপাদন কমে যায়, ফলে শরীর ও ব্রেনে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দেয়। মনোবিদরা বলছেন, তিরিশের বেশি বয়সীদের ব্রেনের যত্নে ৫ টি দিক খেয়াল রাখা উচিত।
১.তিরিশের বেশি বয়সীদের শরীরের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রোটিন। আর ব্রেনের জন্য প্রয়োজন ভিটামিন ডি এবং ম্যাঙ্গানিজ। পর্যান্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি এবং ম্যাঙ্গানিজের অভাবে ব্যক্তি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। রাগ বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়াও ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ যেকোন কিছু মনে করা কঠিন হতে পারে। সুতরাং এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত যা শরীর এবং ব্রেনের জন্য ভালো।
২. আধুনিক জীবনে ব্যস্ততার অভাব নেই। তিরিশের পরে ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি, দায়িত্ব নিয়ে ব্রেনে ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এ সময় আপনি যদি আপনার ব্রেনকে বিশ্রাম না দেন, তাহলে ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন একটি ট্রেনকে বিশ্রাম দিতে হয়, ব্রেনকেও সেভাবে বিশ্রাম দিন। স্ক্রিন টাইম কমিয়ে ফেলুন। হাসি-খুশি থাকার উপায় খুঁজে নিন।
আরো পড়ুন:
তরমুজের বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা
আমরা কেন ঘুমাই
৩. তিরিশ বছরের পরে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরন জাতীয় হরমোনের উৎপাদন কমতে শুরু করে। যার প্রভাব পরে ব্যক্তির মন ও মেমোরির ওপর। এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ব্যায়াম করা জরুরি। ভার উত্তোলন—এর মতো ব্যায়াম বেশি উপকারী।
৪. তিরিশের পরে মন সব সময় শান্ত রাখা কঠিন। সুতরাং মেন্টাল ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য একটি রুটিন ফলো করতে পারেন। মেডিটেশন, জার্নালিং, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন।
৫. লাভ হরমোন ‘অক্সিটোসিন’ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করে। যার ফলে ব্যক্তি অনেক বেশি একাকীত্ববোধ করেন, বিরক্তির প্রকাশ ঘটান। এই সময় পারিবারিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিন।
সূত্র: আভাসা মেন্টাল হেলথ থেকে অনূদিত
ঢাকা/লিপি