ময়মনসিংহের অভিবাসী কর্মী হাফিজ (ছদ্মনাম) ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরব যান আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে। তিনি এক সৌদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, যেখানে তাঁকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮০০ রিয়াল বেতন এবং খাবারের জন্য অতিরিক্ত ২০০ রিয়াল দেওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী তিনি বিএমইটি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেন, যা আইনসম্মত অভিবাসনের জন্য প্রয়োজনীয়। তবে সৌদি আরবে পৌঁছানোর পরপরই তিনি নতুন এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন, যেখানে তাঁর বেতন কমিয়ে মাত্র ৮০০ রিয়াল করা হয় এবং তাঁকে জোরপূর্বক খাবার সরবরাহকারী ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। 

হাফিজের গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাঁর মতো অসংখ্য বাংলাদেশি কর্মী প্রতারণার শিকার হন। তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রায় ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও সেখানে গিয়ে প্রতারণার জালে আটকা পড়েন। তাদের স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে যায় এবং শুরু হয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, মজুরি চুরি এবং নির্মম শোষণের দুঃস্বপ্ন।
অভিবাসী কর্মীদের শোষণ বাস্তবে দেশের মাটিতেই শুরু হয়। অসাধু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি ও দালালরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। অধিকাংশ কর্মী অভিবাসন ব্যয় সংগ্রহ করতে তাদের জমিজমা বিক্রি করেন অথবা উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফলে বিদেশে পা রাখার আগেই তারা কঠোর ঋণের ফাঁদে পড়ে যান।

এ শোষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘কাফালা’ নামে স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা, যা অনেক গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) দেশ মেনে চলে। এ কাঠামোর অধীনে অভিবাসী কর্মীরা তাদের নিয়োগকর্তার অধীনে আইনিভাবে দায়বদ্ধ থাকেন এবং তাদের ভিসা ও বসবাসের অনুমতি সম্পূর্ণ নিয়োগকর্তার নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে কর্মীরা চরম নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং সহজেই শোষণের শিকার হন।
কাফালা ব্যবস্থার কারণে অনেক মালিক কর্মীদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেন; ছুটির দিন বা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালান।
নারী গৃহকর্মীদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষণা অনুসারে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশি নারীরা যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আইনি সহায়তাবিহীন এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে।
অনেক কর্মীকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। কর্মীদের ক্যাম্পগুলোতে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব প্রকট। কর্মস্থলে পরিস্থিতি আরও খারাপ– দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতি কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। নির্মাণ শ্রমিক, কারখানা কর্মী এবং গৃহকর্মীরা অতিরিক্ত গরমের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থায় কাজ করেন। অথচ কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পান না।

এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় শুধু অভিবাসী কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোর নয়; বাংলাদেশ সরকারও সমানভাবে দায়ী। বাংলাদেশের সরকার রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হলেও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ; কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আইনি সুরক্ষা প্রদানেও ব্যর্থ। এ ছাড়া দূতাবাসগুলোর পর্যাপ্ত জনবল ও সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি।
অনেক অভিবাসী কর্মী অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ দূতাবাস সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা, তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিও দেখায় না। বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের অবস্থা উন্নত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) দীর্ঘদিন ধরেই কাফালা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও কঠোর শ্রম আইন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এলেও তার বাস্তবায়ন এখনও ধীরগতিসম্পন্ন।

বাংলাদেশ সরকারকে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর ওপর কঠোর নজরদারির সঙ্গে কর্মীদের জন্য বিশদ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যেখানে তাদের আইন, অধিকার ও ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করা হবে। দূতাবাসগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল ও তহবিল বরাদ্দ করতে হবে, যাতে কর্মীরা তাৎক্ষণিক সহায়তা পেতে পারেন। প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে, বাংলাদেশে প্রবাসী কর্মীদের প্রতারণা থেকে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শোষণের বিষয় যেমন একটি অর্থনৈতিক সমস্যা, তেমনি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। এই শোষণের চক্র ভাঙতে হলে সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

পারভেজ আলম: মানবাধিকারকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ম দ র ব যবস থ র জন য কর ম র অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঘুরছে কম কলকারখানার চাকা, উৎপাদনে ধাক্কা

গ্যাসের ঘাটতি দিনে প্রায় ১৩৫ কোটি ঘনফুট। গ্যাস-স্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি ধুঁকছে শিল্প খাত। এখন চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্পকারখানা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদীসহ দেশের শিল্পাঞ্চলে এই সংকট দিন দিন বাড়ছেই। এতে ছেদ পড়ছে উৎপাদনে। বন্ধ হয়েছে শতাধিক কারখানা। অনেকটি বন্ধের পথে। বাধ্য হয়ে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকরা নানা দাবিতে প্রায় দিনই সড়ক অবরোধ, ভাঙচুরসহ বিক্ষোভ করছেন। উৎপাদনে ধাক্কা লাগায় কমছে পণ্য রপ্তানি, বিদেশ থেকে বাড়ছে কাঁচামাল আমদানি।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভোগান্তি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে, কারখানা চালু রাখার চেয়ে বন্ধ রাখলেই লাভ। বারবার শিপমেন্ট বাতিল করতে হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন কারখানার গ্যাসের দর দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়লে নতুন বিনিয়োগ আসবে না।

জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, সহসাই গ্যাস সংকট দূর হবে না। আগে দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতেই সরকারের ঝোঁক ছিল বেশি। সম্ভাবনা থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা করা হয়েছে। এতে গ্যাসের উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে চাহিদা দিন দিন বেড়েছে। ফলে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। 
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে প্রায় ৪২০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে এলএনজিসহ গড়ে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা গ্যাস (এলএনজি) ৯৫ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুতে দেওয়া হচ্ছে ৯৬ কোটি, শিল্পে ১১৮ কোটি, সার কারখানায় ১৩ কোটি, সিএনজিতে এক কোটি এবং আবাসিক ও বাণিজ্যে ৫৭ কোটি ঘনফুট। 

শিল্পে সংকট
শিল্পের মধ্যে গ্যাসের ব্যবহার বস্ত্র খাতেই বেশি। বস্ত্রকলে বাষ্প তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এ খাতে দুই বছর ধরেই গ্যাস সংকট চলছে। তবে নতুন করে গ্যাস সংকট উৎপাদন কাঠামোকে করে দিয়েছে এলোমেলো। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্ত্রকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে ৬৫ শতাংশ কম। দিনে গ্যাস থাকছেই না। গ্যাসের চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা, সেখানে মিলছে ১ থেকে ২ পিএসআই। এত কম চাপের কারণে জেনারেটর চালু হয় না। এ কারণে উৎপাদন বন্ধ অনেক বস্ত্রকলে। যেখানে পিএসআই একটু বেশি পাওয়া যায়, এর সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়িয়ে কোনো রকমে জেনারেটর চালু করা যায়। এই পদ্ধতিতে চলছে কিছু কিছু বস্ত্রকল। তবে তা উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের মতো। আবার জেনারেটর চালাতে অতিরিক্ত বিদ্যুতের ব্যবহার উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। বস্ত্রকলে সাধারণত গ্যাসের ৭৫ শতাংশ ব্যবহার হয় বাষ্প তৈরিতে, বাকি ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে। একজন টেক্সটাইল উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সাধারণত একটি জেনারেটর এক হাজার কিলোওয়াটের হয়ে থাকে। ৭০০ কিলোওয়াটের শক্তি থাকলেও কাজ চালানো যায়। গ্যাস সংকটের চাহিদা অনুসারে শক্তি মিলছে না। এতে জেনারেটর দ্রুতই নষ্ট হচ্ছে। প্রায় সব বস্ত্রকলেই জেনারেটর নষ্ট হওয়ার ঘটনা আছে। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নতুন জেনারেটর কিনতে হয়। উৎপাদন কমে আসায় ক্ষতি কমাতে অনেক বস্ত্রকল শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাধ্য হয়েছে। চাপ কম থাকায় ডায়িং ও প্রিন্টিংয়ের মান খারাপ হচ্ছে। 
পোশাক খাতের মধ্যে নিট অর্থাৎ গেঞ্জি জাতীয় পণ্যের প্রায় শতভাগ কাঁচামাল দেশীয় বস্ত্রকলগুলো জোগান দিয়ে থাকে। কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, বস্ত্রকলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাড়তি ডলার ব্যয়ে কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। নিট পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কাঁচামাল পাচ্ছেন না তারা। এ কারণে নিটের রপ্তানি পোশাকের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমেছে।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ চাহিদা অনুসারে গ্যাস না পাওয়ায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গেছে, যা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সমকালকে বলেন, শিল্পে গ্যাসের সংকট সমাধানের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

অস্থিরতা কাটছে না
পোশাকশিল্প এক ধরনের অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারণে রাস্তায় নামছেন শ্রমিকরা। হুটহাট বন্ধ করে দিচ্ছেন সড়ক-মহাসড়ক। শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি যুক্ত হয় গ্যাস সংকট। রাজনৈতিক পালাবদলের পর কিছু কারখানা মালিকের অনুপস্থিতিও শ্রমিক অসন্তোষ দানা বাঁধতে ভূমিকা রাখছে বলে মনের করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নানা দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি অসন্তোষের আরেকটি কারণ হলো ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। জুলাই বিপ্লবের পর তৈরি পোশাক কারখানায় টানা অস্থিরতা, গ্যাস সংকটে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পোশাক খাতে সংকট কাটছে না। 
বিজিএমইএর হিসাব বলছে, গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুর ও ময়মনসিংহে কারখানা বন্ধ ছিল পাঁচটি; সাভার, আশুলিয়া ও জিরানীতে চারটি এবং নারায়ণঞ্জে একটি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশের জোগানদাতা এবং ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের এ খাতের আড়াই হাজার কারখানা বিজিএমইএর সদস্য। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নিটওয়্যার ও সোয়েটার এবং বাকি ৬০ শতাংশই ওভেন খাতের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ সময় পোশাক শ্রমিকদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। একেক কারখানায় একেক ধরনের দাবি উঠছে। সরকারের তরফ থেকে উস্কানি ও ষড়যন্ত্রের কথাও নানা সময় বলা হয়েছে।

সাভার ও আশুলিয়ায় বন্ধ ২০ কারখানা
সাভার ও আশুলিয়ায় অধিকাংশ কারখানায় গ্যাস সংকটে উৎপাদন লাটে উঠেছে। গ্যাসের বদলে ডিজেল ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। রমজানের আগে গ্যাসের চাপ কিছুটা থাকলেও এখন বেশ কমে গেছে। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ১৫ থেকে ২০টি কারখানা। যেগুলো চালু আছে, তাদের উৎপাদন অনেকটাই কমে গেছে। ফলে বিদেশি ক্রেতা চুক্তি অনুযায়ী পণ্য সময়মতো পাচ্ছেন না। 
সাভারের আনলিমা কারখানার ব্যবস্থাপক রফিক আহম্মেদ জানান, কারখানায় মাঝেমধ্যে গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জেকে গ্রুপের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, গ্যাসের চাপ কম হওয়ায় কারখানায় বয়লার চালানোই যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ডিজেল দিয়ে বয়লার মেশিন চালানো হচ্ছে। ফলে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। 

গাজীপুরে উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ
গাজীপুরে রয়েছে আড়াই হাজারের কাছাকাছি শিল্প প্রতিষ্ঠান। জেলা সদরের ভোগাড়া, বাসন সড়ক, বোর্ডবাজার, হোসেন মার্কেট, পুবাইল, জয়দেবপুর, কড্ডা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর এবং কালিয়াকৈরের সফিপুর, মৌচাক, পল্লী বিদ্যুৎ, কালিয়াকৈর বাজার, সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
গাজীপুরের এসএ স্পিনিং কারখানার মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল আহসান বলেন, গ্যাসের চাপ যেখানে অন্তত ১৫ পিএসআই থাকার কথা, সেখানে থাকছে ১-২ পিএসআই। কখনও আবার শূন্যের কোঠায় চলে আসে। এ অবস্থায় বারবার বন্ধ করার ফলে মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চাহিদার ৩০ শতাংশ গ্যাসও পাচ্ছি না। ফলে শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না। বসিয়ে বসিয়ে তাদের বেতন দিতে হচ্ছে। মহানগরের শিলমুন এলাকার ড্রিম টাচ ওয়াশিংয়ের মালিক খলিলুর রহমান বলেন, গ্যাস সংকটের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে কর্মসংস্থানের ওপর পড়তে শুরু করেছে। কাজ না থাকায় কর্মী ছাঁটাই করে দিতে হচ্ছে। মহানগরের টঙ্গী এলাকার বিএইচআইএস নামে পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তা বলেন, সকালে গ্যাস থাকলে বিকেলে থাকে না। গ্যাস না পাওয়ায় এলপিজি ও ডিজেল দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ক্রেতাকে সময়মতো পণ্য দিতে শ্রমিকদের ওভারটাইমও বেশি করতে হচ্ছে। 
তিতাস গ্যাস গাজীপুর জোনের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) রিদওয়ানুজ্জামান সমকালকে বলেন, মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছে গাজীপুরের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। 

প্রতিষ্ঠান চালু রাখলেই ক্ষতি, বন্ধে লাভ 
গ্যাস সংকটে নারায়ণগঞ্জের অনেক ডাইং কারখানা বন্ধ। বাকিগুলো চালু রাখলে ক্ষতি; বন্ধ রাখলে লাভ– এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফতুল্লার ওসমান ডাইংয়ের মহাব্যবস্থাপক মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, পোশাকের থান স্টিম করতে, আয়রন করতে, ডাইং চালাতে গ্যাস প্রয়োজন। তবে সংকটের কারণে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করলে খরচ বেড়ে যায়। আবার রোজা শুরুর ১০ দিন ওভারটাইম করানোও সম্ভব না। কারণ শ্রমিকরা ইফতারের পর কাজ করতে চায় না। 
ফতুল্লা ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিং মিলসের পরিচালক মিনহাজুল হক বলেন, ‘আমাদের ডাইং সক্ষমতা দৈনিক ২০ টন। তবে গ্যাস কম পাওয়ায় দিনে ৮ টনের বেশি ফেব্রিক্সে রং করতে পারছি না। গত শুক্রবার গ্যাসের অভাবে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ডাইং চালু রাখলেই আমার ক্ষতি। বরং বন্ধ রাখলে লাভ। গত অর্থবছরে কারখানা চালু রেখে সাড়ে সাত কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। ব্যাংক লোন না থাকলে আমি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতাম।’

নরসিংদীতেও ভোগান্তি
নরসিংদীর মাধবদী, পাঁচদোনা, ভাটপাড়া, শেখেরচরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানা এবং সিএনজি পাম্পে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। পাকিজা গ্রুপের পোশাক কারখানার হেড অব অপারেশন রাশেদুর রহমান জানান, এই কারখানার ক্যাপটিভ জেনারেটরের গ্যাসের চাপ ১৬ পিএসআই। তবে প্রায় এক বছর ধরে ৩ থেকে ৫ পিএসআই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শূন্য থেকে ২ পিএসআই গ্যাস আসে। তখন কারখানা ও জেনারেটর কোনোটাই চালানো যায় না। গ্যাস সংকটের কারণে ৭০০ তাঁতের মধ্যে ৩০০টি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে দিনে প্রায় দুই কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। বয়লারও ঠিকমতো স্টিম হচ্ছে না। তাই ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং সক্ষমতা দেড় লাখ মিটার থাকার পরও উৎপাদন মাত্র ৬০ হাজার মিটার। এতে বিদেশি অর্ডার যথাসময়ে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। 
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোমেন মোল্লা বলনে, ‘আমাদের প্রতিটি শিল্পকারখানায় ১৫ পিএসআই চাপে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন থাকলেও পাই ৩ থেকে ৪ পিএসআই। এতে উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কম হচ্ছে।’
 
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ
শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। নতুন শিল্পের জন্য এটি বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তিতাসের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে পারলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না।’ তিনি বলেন, ‘পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে। তাই নতুন নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরাতন কারখানার সম্প্রসারণ করতে হবে। তবে ৭৫ টাকা দরে গ্যাস কিনে কেউ এই খাতে বিনিয়োগ করবে না।’ 
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ