গত শুক্রবার অবন্ধুসুলভ আচরণের মুখোমুখি হয়ে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেনীয় নেতার উদ্দেশে লেখেন, ‘শান্তির জন্য প্রস্তুত হলে আবার ফিরে আসবেন।’

শান্তি একটি শক্তিশালী শব্দ। কিন্তু এর পুরো অর্থ বুঝতে হলে যে পটভূমিতে এটি উচ্চারিত হচ্ছে, সেদিকে আমাদের তাকাতে হবে। ট্রাম্প যেদিন শান্তির গুরুত্ব নিয়ে বললেন এবং জেলেনস্কিকে চিন্তা করার জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন, সেদিনই ইউক্রেনের শহরগুলোয় দেড় শতাধিক ড্রোন হামলা করে রাশিয়া। যদিও ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে শান্তির ব্যাপারে তিনি দুর্দান্ত অগ্রগতি ঘটিয়েছেন। বাস্তবতা হলো, তাঁর অভিষেকের পর ইউক্রেনে পুতিনের হামলা বেড়েছে।

গতকাল রোববার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের আমন্ত্রণে ইউরোপের নেতারা, ন্যাটোর মহাসচিব জেনারেল মার্ক রুট এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো লন্ডনে সমবেত হয়েছিলেন। ইউক্রেনের জন্য সমর্থন জোরদার করা এবং ট্রাম্পের সমর্থন জয় করে যুদ্ধ অবসানের একটি পরিকল্পনা তৈরির প্রতিশ্রুতি তাঁরা দিয়েছেন।

ইউরোপীয়রা বুঝতে পারছেন যে (যেটা ট্রাম্প প্রশাসন বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না) ইউক্রেন এমন একটি শান্তি চুক্তি চায়, শর্তের কারণে যেন সেটা নষ্ট না হয়ে যায়। পুতিনের ভাবনায় রয়েছে পুরো ইউক্রেন; ন্যাটো কিংবা ইউক্রেনের ভূমির অংশবিশেষ নয়। চুক্তির পরও ইউক্রেন যদি স্বাধীন থাকে, ইউক্রেনের যদি নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকে, তাহলে পুতিন সেখানেই থেমে যাবেন না। তিনি এখন ইউক্রেনের একখণ্ড ভূমি নিয়ে সাময়িক বন্দোবস্তে আসবেন, যাতে করে ভবিষ্যতে গোটা ইউক্রেনকে নিজের করায়ত্তে নেওয়া যায়। ন্যাটো যদি পুতিনের চিন্তার কারণ হতো, তাহলে তিনি ২০২৩ সালে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে এত সহজে মেনে নিতেন না। বর্তমানে ইউক্রেনের সীমানা থেকে মস্কোর দূরত্বের চেয়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে ন্যাটোর সীমানা আরও কাছাকাছি।

পুতিন স্বাধীন ইউক্রেনকে সহ্য করতে পারেন না। তার কারণ হলো, গত ৩০০ বছরে তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই এটা মেনে নিতে পারেননি। আরও একটি কারণ হলো, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন যদি সফল হতে পারে, তাহলে সেটা পুতিনের স্বৈরতান্ত্রিক মডেলের শাসনের ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিকে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। তিনি চান যেকোনো মূল্যেই সেটা সফল করতে।

বাইডেনের আমলে আফগানিস্তানে যেটা ঘটেছে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প সেটা হতে দিতে পারেন না। নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফাঁদে নিজেই আটকা পড়ে ট্রাম্প তড়িঘড়ি একটা সাফল্য অর্জন করতে চাইছেন। সেখান থেকেই গত সপ্তাহে তিনি জেলেনস্কিকে আক্রমণ করেছেন।

পুতিন বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। সে কারণে তিনি ট্রাম্পের দেওয়া সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ করার জন্য হয়তো একটা যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে পারেন, কিন্তু ইউক্রেন ধ্বংস করে দেওয়ার কৌশলগত লক্ষ্য থেকে তিনি কখনোই সরে আসবেন না। নিরাপত্তা নিশ্চয়তা শর্ত ছাড়া চুক্তি হলে, সেই চুক্তি ভেঙে যাবে এবং যুদ্ধ আবারও শুরু হবে।

শুক্রবারের ঘটনা নতুন একটি বাস্তবতার প্রকাশ, যেটা কয়েক সপ্তাহ ধরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। আমেরিকা এখনো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটা একটা আলাদা বিশ্ব। ওভাল অফিসে জেলেনস্কিকে ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্সের চেপে ধরার দৃশ্যটি ইউরোপজুড়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখ সম্মেলনে ইউরোপের নেতারা ভ্যান্সের উপদেশবাণী শুনেছিলেন। তাঁরা এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন যে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের মতো তাঁরা আর অপেক্ষা করে থাকতে পারবেন না। এরপরও কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকলেও শুক্রবারের ঘটনায় সেটা ভেঙে গেছে।

ইউরোপ এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও বেশ কিছু চিন্তাভাবনা যেমন সম্মেলন, টেলিফোন আলাপ, প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর খসড়া সিদ্ধান্ত এবং ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দ্রুতগতিতে এসেছে। এই সব অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েই যে প্রশ্ন করা দরকার সেটি হলো, ইউক্রেন ও বাকি ইউরোপের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর দিতে এগুলো কখন ব্যর্থ হয়? এসব ধারণা কবে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তে পরিণত হবে?

ইউক্রেনের ওপর ট্রাম্পের খবরদারি করার জায়গাটি হলো অর্থ ও অস্ত্র। অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে হলে এ দুটোই ইউক্রেনের দরকার। এখন দুটি উপায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাত থেকে ইউরোপ তুরুপের তাসটি সরিয়ে নিতে পারে। এক.

ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে একটি বিকল্প চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া। দুই. রাশিয়ার বাজেয়াপ্ত করা সম্পদ অস্ত্র উৎপাদন ও কেনার জন্য ব্যবহার করা।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে পরিমাণ সহযোগিতা ও সমর্থন দেয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও নরওয়ে সম্মিলিতভাবেও সেটা প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু এই সব বাস্তববাদী পদক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে ইউরোপের ভূমিকাকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে এবং ইউক্রেনও তাতে শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাবে।

১৯১৮ সালে বলশেভিক রাশিয়া ইউক্রেনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান, সেনা প্রত্যাহার এবং প্রোপাগান্ডা বন্ধের অঙ্গীকার করে জার্মানির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। একই সময়ে কিয়েভ তাদের বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে ইউক্রেনের স্বাধীনতা সুরক্ষা দেওয়া হবে এই শর্তে জার্মানির সঙ্গে চুক্তি করেছিল।

এক বছরের মধ্যে চুক্তিটি ভেস্তে যায়। জার্মানির সেনারা চলে যায়, রাশিয়ার রেড আর্মি সেখানে প্রবেশ করে এবং ইউক্রেন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মুছে ফেলে। সেই চুক্তি এবং ২০২২ সালে রাশিয়ার আগ্রাসনের মধ্যে ১০৪ বছর পার হওয়ার পর ইউরোপ অবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যে ইউরোপের অংশ, তার স্বীকৃতি দিয়েছে।

মস্কো বাস্তবে কখনো বদলায় না, কিন্তু ইউরোপ এখনো বদলাতে পারে।

দিমিত্র কুলেবা ইউক্রেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হার্ভার্ড বেলফার সেন্টারের একজন সিনিয়র ফেলো

 নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র স ইউর প র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বৈঠকে বিতণ্ডা ‘অনুতাপের’, ট্রাম্পের ‘বলিষ্ঠ নেতৃত্বের’ অধীন কাজ করতে প্রস্তুত জেলেনস্কি

হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বাগ্‌বিতণ্ডা হওয়াকে ‘অনুতাপের’ বলে উল্লেখ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘বলিষ্ঠ নেতৃত্বের’ অধীন যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধের অবসানে কাজ করতে প্রস্তুত ইউক্রেন।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সব ধরনের সামরিক সহায়তা স্থগিত করার পর আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে দেওয়া বিবৃতিতে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে শুক্রবার আমাদের বৈঠক যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। এভাবে ঘটনাটি হওয়াটা অনুতাপের। এখন সঠিক কাজ করার সময়।’

জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমার টিম ও আমি প্রস্তুত রয়েছি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধীন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে, যেটা স্থায়ী হবে।’

গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকে বসেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কি। বৈঠকের এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। ওই বৈঠক শেষে দুই প্রেসিডেন্টের যৌথ সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়। তা ছাড়া ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। এই বৈঠকের পর ওই ঘটনার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ক্ষমা চাইতে বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। এরপর ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুনরাশিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলতে প্রস্তাব তৈরির নির্দেশ দিয়েছে হোয়াইট হাউস৪ ঘণ্টা আগে

ভলোদিমির জেলেনস্কি বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিতের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি।

রাশিয়া–ইউক্রেন সংকট ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পদক্ষেপ ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা স্থগিত করা। দৃশ্যত এর মধ্য দিয়ে তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন স্পষ্ট হয়েছে এবং এতে মস্কোর পক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে।

আরও পড়ুনইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা দেওয়া স্থগিত করলেন ট্রাম্প১৭ ঘণ্টা আগে

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা ও যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী কিয়েভ।

জেলেনস্কি বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য আমেরিকা যেভাবে ভূমিকা রেখেছে, তা সত্যিকারে আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কেউ একটি নিরন্তর যুদ্ধ চাই না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় যত দ্রুত সম্ভব সমঝোতার টেবিলে বসতে ইউক্রেন প্রস্তুত রয়েছে। ইউক্রেনিয়ানরা শান্তির জন্য যতটা মুখিয়ে আছেন, তার চেয়ে বেশি অন্য কেউ নন।’

আরও পড়ুনইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য জেলেনস্কিকে পদত্যাগ করতে হতে পারে: ট্রাম্পের উপদেষ্টা০৩ মার্চ ২০২৫আরও পড়ুনইউরোপ কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউক্রেনে শান্তি নিশ্চিত করতে পারবে০২ মার্চ ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ