অন্তর্বর্তী সরকার সব সময়ই ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মোরাল পুলিশিংয়ের’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। আজ মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার বারবার তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে এই বলে যে মব জাস্টিস (দলবদ্ধ সহিংসতা) বা মোরাল পুলিশিংয়ের (নীতি পুলিশিং) কোনো সুযোগ এ দেশে নেই। সরকার এর বিরুদ্ধে সব সময়ই শক্ত অবস্থায় আছে। যেহেতু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে আগে যেভাবে ছিল সেভাবে ফেরত আনা যায়নি, এখনো ফেরত আসেনি, সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো জায়গায় এ রকম মব জাস্টিস বা মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা ঘটছে। সরকারের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট, এ রকম মব জাস্টিস বা মোরাল পুলিশিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ বিষয়ে জেনেছেন, উভয় পক্ষ পুলিশের সামনে একটি আপসনামায় স্বাক্ষর করেছে। যেহেতু দুই পক্ষ আপসনামায় স্বাক্ষর করেছে, কাজেই সে ক্ষেত্রে সেটিকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করতে হচ্ছে। তবে কোনোভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা এবং এ–জাতীয় আচরণ সরকার সমর্থন করে না। এটি আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে, আজ আবারও এই বার্তা সাংবাদিকদের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, মোহাম্মদপুর থানার লালমাটিয়া এলাকার ঘটনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে পরোক্ষভাবে মব জাস্টিসকে সমর্থন করা হয়, এ বিষয়ে তিনি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন কি না বা তাঁর পদত্যাগের যে দাবি উঠেছে তাতে তিনি পদত্যাগ করবেন কি না।

জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আবারও বলছি মব জাস্টিস বা মোরাল পুলিশিং এগুলোর কোনো স্থান বাংলাদেশে নেই। এগুলো সমাজে যখনই ঘটছে তখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, যে মুহূর্তে আমাদের নজরে আসছে। মোহাম্মদপুরের ব্যাপারেও বলেছি, যেহেতু উভয় পক্ষ মিলে একটি আপস করেছে। কাজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এর বাইরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাই থাকছেন।’

সংবাদ ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বিশেষ একটি দলের তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বলে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমে আসছে। এটি রোধ করতে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার চাঁদাবাজি রোধে পদক্ষেপ নেবে ও নিচ্ছে। কোন দল বা কোন ব্যক্তি চাঁদাবাজি করল সেটি সরকার দেখবে না। কোনো বিশেষ দলের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকলে সে প্রশ্নটি সেই বিশেষ দলকেই করতে হবে। সরকারের অবস্থান হচ্ছে, চাঁদাবাজি বা অন্য অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, যখন তা সরকারের দৃষ্টিতে আসছে।

সংস্কার, নির্বাচন ও বিচারে অগ্রাধিকার

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনটি হবে। যখন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বলেন, তখন ডিসেম্বর নিয়েই বলা হয়। কাজেই চূড়ান্ত তারিখ প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে শোনার জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রাধিকারের মধ্যে সংস্কার, নির্বাচন ও বিচার—এই তিনটি। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা যেকোনো সরকারের প্রাধিকারের মধ্যে সব সময় থাকে।’

সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ন বল ন মব জ স ট স র উপদ ষ ট সরক র র অবস থ ন র জওয় ন

এছাড়াও পড়ুন:

চালের দাম যেটুকু কমে বাড়ে তার চেয়ে বেশি

নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। মাঝেমধ্যে দুই-এক টাকা কমলেও তা এক বা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। যত টাকা কমে তার চেয়ে বাড়ছে বেশি। এক বছরের বেশি সময় ধরে চালের বাজারে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। 

বন্যায় ফলন কম, সরবরাহ খরচ বেড়ে যাওয়া, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি কম– এ রকম নানা ছুতা দেখিয়ে মূলত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিলার ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা। 

ভোক্তা-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যথাযথ তদারকি ও সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাল ব্যবসায়ী চক্র নিজেদের ভিত্তি শক্ত করে ফেলছে। বড় ব্যবসায়ীরা চালের বাজারে কলকাঠি নাড়লেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভরা মৌসুমে কৃষক থেকে ধান কিনে নিজেদের কবজায় নিয়ে নেয় তারা। তারপর পুরো বছর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার তাদের বাগে আনতে পারছে না। এতে বেশি ভুগতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে। 

কোন চালের দর কত সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, বাজারে গত এক বছরে সরু চালের দর বেড়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। মাঝারি চালের প্রায় ৯ এবং মোটা চালের ৫ শতাংশ দর বেড়েছে। যদিও গত এক মাসে দাম বাড়ার এই হার কিছুটা কম। তবে সরেজমিন বাজারে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। 

গতকাল রাজধানীর হাতিরপুল, তেজকুনিপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরু বা মিনিকেট চালের দাম সর্বোচ্চ দরের রেকর্ড ছুঁয়েছে। ভালো মানের (মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের) এ চালের কেজি এখন সর্বোচ্চ ৯০ টাকা। 

বেড়েছে মোটা ও মাঝারি আকারের চালের দরও। খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি গুটিস্বর্ণা বা মোটা চাল ৫৩ থেকে ৫৫ এবং  পাইজাম চাল ৫৬ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগে এসব চাল অন্তত ২ টাকা কমে কেনা গেছে। বিআর-২৮ জাত বা মাঝারি চালের কেজি মাসখানেকের ব্যবধানে প্রায় ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৬ টাকায়। আবার ভালো মানের বিআর-২৮ জাতের চিকন চাল ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মিনিকেট বলে বিক্রি করছেন ৭০ থেকে ৭২ টাকায়।

সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু চালের। ৮০ টাকা নিচে এখন সরু চাল মিলছে না। মানভেদে এ ধরনের চালের কেজি কিনতে ভোক্তাকে খরচ করতে হচ্ছে কেজিতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। এক-দেড় মাস আগে এ ধরনের চালের কেজি ছিল ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা।

ক্ষুব্ধ ক্রেতা

গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে ২৫ কেজি ওজনের এক বস্তা মিনিকেট (সরু) চাল কেনেন বেগুনবাড়ী এলাকার ইলেকট্রিশিয়ান শাহরিয়ার হোসেন। কত টাকায় কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, ‘সবজির দাম কমায়া বাহাদুরি করলে হবে? মানুষ কী শুধু সবজি খায়? আগে তো গরিব বাঁচাতে হবে, তারপর বাকি আলাপ।’ একই বাজারে গাজী সাইফুল নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘সরকার বড় ব্যবসায়ীদের ধরতে পারে না। এ জন্য চালের দামও কমে না।’ 

চালের সংকট নেই

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ১৬ লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৯ হাজার টন। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল। সরকারি-বেসরকারি মিলে চলতি অর্থবছরের সাড়ে ৯ মাসে মোট আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৭৭ হাজার টন। সরকারের গুদামে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ টন চাল মজুত রয়েছে। 

অনেকে বাজারে সংকট আছে বলে আওয়াজ তুললেও মূলত চালের ঘাটতি নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংকট শুধু মুখে মুখে। চাহিদামতো সব সময় চাল থাকে। এর আগে কখনই সরু বা চিকন চালের দাম এতটা বাড়েনি। তাদের অভিযোগ, চালের বাজার এখন মিলার এবং করপোরেট ব্যবসায়ীর হাতে। 

তেজকুনিপাড়ার মায়ের দোয়া স্টোরের স্বত্বাধিকারী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মিলাররা বলে চালের সংকট। তবে যখন যত বস্তার অর্ডার দেই, পাই। মিলে না থাকলে চাল কোথা থেকে দেয়। নাই নাই বলে আতঙ্কে ফেলে দাম বেশি নেয়।’ 

কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী জনতা রাইস এজেন্সির মালিক মো. রাসেল বলেন, ‘গত বছর নির্বাচনের পর থেকে দাম বাড়ছে। সেই যে বাড়া শুরু হইল আর কমাতে পারল না সরকার।’ তবে আগামী সপ্তাহ থেকে বোরো ধান আসা শুরু হলে দাম কমতে পারে বলে ধারণা এই ব্যবসায়ীর।

খুচরা আর মিলগেটে চালের দামের ব্যবধান অনেক বেশি বলে মনে করেন মিল মালিকরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ সমকালকে বলেন, মিলাররা চাল বিক্রির সময় পাইকারি ব্যবসায়ীকে চালান সরবরাহ করেন। তাতে চালের ক্রয়মূল্য লেখা থাকে। সরকারের উচিত ব্যবসায়ী পর্যায়ে চালান খোঁজ করে ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যের ফারাক দেখা। আর যদি কোনো মিলার চালান সরবরাহ না করেন তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। 

এবারও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে উল্লেখ করে শীর্ষস্থানীয় এই মিল মালিক বলেন, চাল নিয়ে বেশি টেনশন করতে হবে না। ফলন অনেক ভালো হয়েছে। তবে মিল, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কারণে মিলারদের বিপদে পড়তে হয়।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, চালের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই ঊর্ধ্বমুখী। এর মূল কারণ বাজারে তদারকি নেই। করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মিলার একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দাম বাড়ান। যারা এই সিন্ডিকেটে জড়িত আবার তারাই আমদানিকারক। আমদানি ও মজুত সবই তাদের হাতে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বাজার।

যদিও বাজারে তদারকি অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি সরকারের সংশ্লিষ্টদের। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আরীম আখতার খান বলেন, ‘চালের বাজার তদারকি হচ্ছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ