এস আলমের শেয়ারদর বাড়ার কারণ ডিএসইকে তদন্তের নির্দেশ
Published: 4th, March 2025 GMT
পুঁজিবাজারের প্রকৌশল খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের শেয়ারের দাম ও লেনদেন অস্বাভাবিক হারে বাড়াকে সন্দেহের চোখে দেখছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তাই বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ডিএসইকে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিএসইসির সহকারী পরিচালক লামিয়া আক্তার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ডিএসইর কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ও লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এটির পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ আছে কি না সেটি খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া, সম্প্রতি কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কারসাজি বা ইনসাইডার ট্রেডিং অথবা অনৈতিক কোনো লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটিও তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হলো।
এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে যে কোনো সন্দেহজনক ট্রেড এক্সিকিউশন যদি হয়ে থাকে অথবা কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে তা অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অফিসার বা সিইওকে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
উল্লেখ্য, ২০ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি থেকে একটি চিঠি জারি করা হয়েছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কিছু কোম্পানির কার্যক্রম তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরেও এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের বিষয়ে পৃথকভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।
ঢাকা/এনটি/এনএইচ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এসইস এস আলম ল নদ ন তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
বিএসইসির ওপর আস্থাহীনতা কেন বাড়ছে
আবারও আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্বের ওপর। গত আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ওলটপালট হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পুনর্গঠিত কমিশনের ওপর আস্থার ঘাটতি নয়া এক সংকটেরই বার্তা দেয় শেয়ারবাজারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর আস্থার সংকট মানে বিনিয়োগে স্থবিরতা। নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে এ স্থবিরতা বিরাজ করছে, যা হতাশার জন্ম দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের মনে।
দেশের শেয়ারবাজারের শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ সম্প্রতি শেয়ারবাজার নিয়ে বাজার অংশীজনদের মনোভাব বা সেন্টিমেন্টভিত্তিক এক জরিপ করেছে। সেই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিএসইসির নতুন নেতৃত্বের ওপর তাদের আত্মবিশ্বাস কেমন? জবাবে মতামতদানকারীদের সাড়ে ৪৯ শতাংশই জানিয়েছে, বিএসইসির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। আর প্রায় ৩৭ শতাংশ বলেছেন, বিএসইসির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর ‘কিছুটা আস্থা’ আছে তাদের। আর ৯ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বর্তমান নেতৃত্বের ওপর ‘খুবই আস্থাশীল’।
লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ শেয়ারবাজার নিয়ে ২০১২ সাল থেকে নিয়মিত এই মনোভাব জরিপ করে আসছে। এবারের জরিপটি করা হয়েছে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে গত ২৫ জানুয়ারির মধ্যে। এবারের জরিপে ১০১ জন তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগ ব্যাংকার, বিদেশি বিনিয়োগকারী, শেয়ারবাজারে লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ট্রেডার বা লেনদেনকারী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, শিক্ষার্থী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে এসব অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি জরিপে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
জরিপে মতামত প্রদানকারীদের সংখ্যাটি হয়তো কম। কিন্তু তাঁরা তাঁদের যে মনোভাব তুলে ধরেছেন, সেটি ‘আমলযোগ্য’। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়ে বাজার–সংশ্লিষ্টদের ধারণা দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ। বিশেষ করে ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস পরবর্তী দুই কমিশন নিয়ে বাজারে অভিযোগ ও সমালোচনার অন্ত নেই। এসব অভিযোগ ও সমালোচনা একেবারেই যে অমূলক তা–ও নয়। বিগত দুই কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। এর মধ্যে নতুন কমিশনের ওপরও আস্থাহীনতার কথা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক জরিপে।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস না যেতেই কমিশনের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমেছেন। বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশও হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলে। বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অনিয়ম বা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ শোনা যায় না। কেউ এই ধরনের দাবিও তোলেনি। তবে এই কমিশনের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। আর সেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে কমিশন নিজেই।
গত প্রায় ১৫ বছরে শেয়ারবাজারের নানা অনিয়মের জন্য অভিযোগের তির সবচেয়ে বেশি ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিকে। এ কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার প্রত্যাশা ছিল বিএসইসিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হবে। কিন্তু বাজার–সংশ্লিষ্টদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আবার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা পরবর্তীতে প্রশ্নের মুখে পড়ে। এ কারণে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে গিয়ে বারবার সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে কমিশনকে। আবার নতুন কমিশন বিএসইসির অভ্যন্তরেও নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। কমিশনের কর্মকর্তাদের আস্থাও পুরোপুরি অর্জনে ব্যর্থ হয় তারা। তাতে গত ছয় মাসে কমিশনের কাজে একধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
শেয়ারবাজারবিষয়ক প্রতিবেদনের কাজে ২০০৭ সাল থেকে বিএসইসিতে নিয়মিত যাতায়াত করছি। এখনকার মতো বিএসইসির কাজে এত বেশি স্থবিরতা অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। বিএসইসির কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশই এখন শুধু নিয়মিত দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাতে সংস্থাটির কার্যক্রম বড় ধরনের স্থবিরতার মধ্যে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজে যখন স্থবিরতা দেখা দেয়, তখন তার রেশ বাজারে ছড়িয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও দক্ষতার ঘাটতি। এ কারণে শেয়ারবাজারে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর ক্ষত এখনো ব্যথা ছড়াচ্ছে বাজারে। সেই ব্যথায় কাতরাতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। সেখান থেকে যত অনাস্থার জন্ম হচ্ছে।
সম্প্রতি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিবিএ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা খুবই দুঃখজনক। বিএসইসির বিগত দুই কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে এখনো সেই ধরনের কোনো অভিযোগ শোনা না গেলেও তাদের অভিজ্ঞতায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে বর্তমান কমিশন অনেক উদ্যোগ নিলেও সেগুলোর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, বিগত দুই কমিশনের সময় বাজারে আসা অনেক কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বড় বোঝা বা বার্ডেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বার্ডেন দূর করতে না পারলে বাজারে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসবে না।
একই আলোচনা সভায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক ব্যাংক সুপারভাইজার সাবিদ সিদ্দিকী বলেন, পৃথিবীর যেকোনো শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে কোনো ঘাটতি তৈরি হলে বা দেখা দিলে সেই বাজারে গতি আসবে না। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থার ক্ষেত্রে তথ্য সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই দুই আলোচকের আলোচনাকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, বর্তমান কমিশন তা এখনো নিতে পারেনি। সে শেয়ারবাজারের লেনদেন কমে ৪০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। যেকোনো কিছু নতুন শুরুর ক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হচ্ছে পুরোনো জঞ্জাল দ্রুত সরিয়ে ফেলা ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নতুন আশাবাদ তৈরি করা। বিএসইসির বর্তমান কমিশনের কাছে বাজার–সংশ্লিষ্টদের এই দুটি প্রত্যাশায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিলছে না। এ কারণে দিন দিন হতাশা বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। তার মধ্যে শেয়ারের দরপতন এই হতাশাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোন পদক্ষেপ বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে? জবাবে ২৮ শতাংশ জানিয়েছেন, কারসাজির দায়ে কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে যে জরিমানা কমিশন করেছে, সেটি বাজারের জন্য ইতিবাচক। অর্থাৎ শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শেয়ারবাজারকে কারসাজিমুক্ত দেখতে চান। এ কারণে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটিকে বাজারের জন্য ইতিবাচকই বলছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।
বিএসইসির বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়ে অতীতের বেশ কিছু কারসাজির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে তা বাজারের জন্য যে ইতিবাচক, সেই ধারণা পাওয়া গেছে জরিপ থেকে। তাই কারসাজির বিরুদ্ধে কমিশনকে দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের কাজটি দ্রুত করতে হবে।
শেয়ারবাজারের অতীতের ক্ষতকে যদি আমরা ক্যানসারের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে সেই ক্ষত যত দ্রুত নির্মূল করা যাবে, ততই মঙ্গল। সেই কাজটি যত বেশি বিলম্বিত হবে, ততই তা আশপাশে ছড়াতে থাকবে। তাতে এই ক্যানসার থেকে বাঁচার উপায় ক্ষীণ হয়ে আসবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বর্তমান কমিশন এখন শেয়ারবাজারের ক্ষত সারানোর চিকিৎসকের ভূমিকায়। যার ওপর নির্ভর করছে শেয়ারবাজার নামক রোগীর ভবিষ্যৎ। এই চিকিৎসকের ওপর যদি আস্থার সংকট বাড়তে থাকে, তাহলে তা পুরো বাজারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।