পায়রায় জাহাজে কাটা পড়ছে জাল-দড়ি, নিঃস্ব হচ্ছে জেলেরা
Published: 4th, March 2025 GMT
বরগুনার পায়রা নদীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার জাহাজে কাটা পড়ছে শত শত জেলের জাল-দড়ি। এতে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে অন্তত ৬ শতাধিক জেলে। জেলেরা বলছেন, নৌ সীমানায় নির্দিষ্ট চ্যানেল না থাকায় সুবিধামতো জাহাজ চালিয়ে জাল-দড়ি কাটছে জেলেদের। তবে জেলেদের দ্বারা হামলার শিকারের দাবি করেছে জাহাজ কর্তৃপক্ষ।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে বরগুনার তালতলীর তেঁতুল বাড়িয়া এলাকার জয়নাল মৃধা পাঁচ জেলেসহ মাছ শিকার করছিলেন পায়রা নদীতে। এ সময় তালতলীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা বোঝাই ১৬টি জাহাজ এসে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে জয়নাল মৃধার জাল-দড়ি। পরে ধারদেনা করে ৭৭ হাজার টাকা ব্যয়ে জাল-দড়ি মেরামত করে ১৩ দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি ফের পায়রা নদীতে মাছ শিকারে যান তিনি। ওই দিন ভোর রাতে আবারো তালতলীর খোট্টারচরে নির্মিত ৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা বোঝাই জাহাজে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে জয়নাল মৃধার জাল-দড়ি।
জয়নাল মৃধা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘‘এখন আমি ধারদেনায় ডুবে গেছি। আমিসহ পাঁচটি পরিবার এই জাল-দড়ির উপর নির্ভর করে। আমরা এখন খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি আর জাল-দড়ি নিজেরাই মেরামত করছি। কারণ এখন আর জাল-দড়ি মেরামত করার পেশাদার শ্রমিক ভাড়া করার সামর্থ্য আমার নেই।’’
আরো পড়ুন:
‘রমজানে মাছের ঘাটতি হবে না’
পদ্মা-মেঘনায় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে মধ্যরাতে
তার অভিযোগ এবারই প্রথম নয়, গত দেড় বছর ধরে এমনভাবে বার বার জাল-দড়ি কাটা পড়ছে কয়লার জাহাজে। জেলেদের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে পায়রা অন্তত ৫০ কিলোমিটার এলাকায় ৬ শতাধিক জেলের জাল-দড়ি কাটা পড়েছে কয়লার জাহাজে। বার বার জাল-দড়ি কাটা পড়ায় ঋণের বোঝায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নদী পাড়ের জেলেরা।
জয়াল ভাংগা এলাকার জেলে জাহিদ হোসেন, মোস্তাফিজ, খবির মোল্লা, নিলু মাঝিসহ এ এলাকার সকল জেলে এখন ব্যস্ত কয়লার জাহাজে কাটা পড়া জাল-দড়ি মেরামত করতে। নৌরুটে জাহাজ চলাচলে নির্দিষ্ট চ্যানেলের দাবি তুলেছেন তারা।
জেলেরা জানান, কয়লা বোঝাই জাহাজে জাল-দড়ি কাটা পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে এই এলাকার জেলেরা।
নিলু মাঝি রাইজিংবিডি-কে জানান, এমনিতেই নদীতে ইলিশসহ সব মাছ কম ধরা পড়ে। তারপর আবার দেড় বছর ধরে কয়লার জাহাজে কাটা পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। জেলেদের এই লোকসানের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন তিনি।
জেলেদের মাছ শিকার বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে উপজেলার মৎস্য ব্যবসায়। জয়াল ভাংগা এলাকার মাছের আড়ৎদার সেলিম মাঝি জানান, এই এলাকার জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় অলস সময় কাটছে তালতলীর আড়ৎদার-পাইকারদের। কর্মহীন হয়ে পড়েছে মৎস্য শ্রমিকরা।
এমন ঘটনায় বিপাকে পড়েছেন কয়লা নিয়ে আসা জাহাজ চালকরাও। সামিরা-১ জাহাজের সেকেন্ড ক্যাপ্টেন ইউসুফ আলী জাল-দড়ি কাটার বিষয়টি স্বীকার করলেও তার দাবি পায়রায় আসলে তাদের উপর হামলা করে জেলেরা।
পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সদস্য ও সিনিয়র সাংবাদিক আরিফ রহমান বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে অযোগ্য স্থানে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কুফলে ভুগছে জেলেরা। ঘনবসতিপূর্ণ জেলে পল্লীতে ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তৎকালীন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বরিশাল ইলেকট্রিফেকশন কোম্পানি এ কাজটি করেছে। এখন প্রতিদিন জেলেদের জাল-দড়ি কাটা পড়ে পথে বসছেন তারা।
তিনি জানান, ইলিশের প্রজননের অন্যতম স্থান পায়রা নদী। কিন্তু সেই নদীতে এভাবে কয়লার জাহাজ আসা-যাওয়া করলে ইলিশের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে নির্দিষ্ট নৌরুট সৃষ্টির আগে জেলেদের সমস্যা নিরসনে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংলাপের কথা জানালেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.
জাহাজে কাটা পড়ে চলতি বছরে অন্তত ৫ কোটি টাকার জাল-দড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি জেলেদের।
ঢাকা/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর এল ক র জ ত লতল র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলবেন কি এটা কোন ‘জাস্টিস’
২২ এপ্রিল যশোরে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘মব জাস্টিস আর অ্যালাউ (অনুমোদন) করা যাবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, দেরিতে হলেও সরকারের হুঁশ ফিরে এসেছে এবং মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থান নেবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যাকে ‘মব জাস্টিস’ বলছেন, সেটা আসলে মব ভায়োলেন্স। রাস্তাঘাটে ঘরে বাইরে কোনো অজুহাত পেলেই একধরনের মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী, দুর্বলের ওপর সবলের সহিংসতা। কবি যেমন বলেছেন, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে কিন্তু মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত মানুষগুলো এতটাই অসহায় যে থানা পুলিশ কিংবা আদালতেও যেতে ভয় পান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই ঘোষণার পরও মব ভায়োলেন্স বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন স্থানে নারী ও সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সেদিন দেখলাম, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একদল লোক বিদ্যালয়ে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে হেনস্তা করছেন এবং তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারতেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেই সভায় যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন, সেটি হলো ১৫ হাজার বোতল ফেনসিডিল ছেড়ে দিয়ে ৫০০ বোতল ‘রিকভার’ (উদ্ধার) দেখানো। কারা দেখাচ্ছেন? কারা মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কেউ পুলিশের লোক, কেউবা র্যাবের।
আওয়ামী লীগ সরকার মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিল, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বহু মানুষ হত্যা করেছিল। কিন্তু তারপরও দেশ মাদক ও সন্ত্রাসের নিরাপদ ভূমি হওয়ার কারণ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই বক্তব্য। তাঁরা ১৫ হাজার বোতল ফেনসিডিল ছেড়ে দিয়ে ৫০০ বোতল ধরেছেন। অর্থাৎ ৩০ ভাগের একভাগ ধরেছেন, ২৯ ভাগই বাজারজাত হয়েছে।
গত সোমবার বরিশালের আগৈলঝাড়ায় র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানের সময় সিয়াম মোল্লা নামে কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। তার আহত রাকিব মোল্লা এখন বরিশালে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। র্যাবের দাবি অনুযায়ী তাঁরা নাকি দুর্ধর্ষ মাদকব্যবসায়ী। র্যাব সদস্যরা যেই মাদকবিরোধী অভিযানে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, অমনি তাদের ওপর হামলা করেছেন ওই দুই শিশু কিশোর। তারা শিশু কিশোরই।
জন্মনিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী নিহত সিয়ামের জন্ম ২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। মৃত্যুর দিন ২১ এপ্রিল তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর ১ মাস ২৮ দিন। আর রাকিবের জন্ম ২০০৭ সালের ১ আগস্ট। সেই হিসাবে তার বয়স ১৭ বছর ৮ মাস ২০ দিন। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দুজনই শিশু-কিশোর।
অবশ্য র্যাব অভিযানের ‘ন্যায্যতা’ প্রমাণ করতে নিহত সিয়াম মোল্লার বয়স ২২ ও আহত রাকিব মোল্লার বয়স ২১ বছর বলে উল্লেখ করেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ওই দুই শিক্ষার্থী মাদক ব্যবসায়ী কিংবা মাদকাসক্ত ছিল না।
হত্যার প্রতিবাদে উজিরপুরের সাহেবের হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মানববন্ধন করেছেন এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা। নিহত সিয়াম এই বিদ্যালয় থেকে গতবার এসএসসি পাস করে একই এলাকার আইডিয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আর রাকিব মোল্লা এ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
সিয়াম মাদক ব্যবসা করত কি করত না, সেটি প্রমাণের পথ র্যাবই বন্ধ করে দিয়েছে। মৃত মানুষ তো আর সাক্ষ্য দিতে পারবে না। র্যাবের দাবি যদি সত্যও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও কি কলেজ পড়ুয়াকে এক কিশোরকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা যায়? সিয়ামের মৃত্যুর পর তার বাবা রিপন মোল্লা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা কী করবেন? আমার পোলারে ফিরাইয়্যা দেতে পারবেন? লেইখ্যা কী অইবে, আমি আল্লার কাছে বিচার দিলাম।’র্যাবের দাবি, মাদক ব্যবসায়ীদের ধরার জন্য র্যাব সদস্যরা অভিযানে গেলে সেখানে মাদক ব্যবসায়ী ১০-১১ জন মিলে তাঁদের ওপর হামলা করেন। এরপর আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরা গুলি করতে বাধ্য হন। তাদের এ সাফাই বক্তব্য আওয়ামী লীগ আমলে বন্দুকযুদ্ধে শত শত মানুষ নিহত হওয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে র্যাব ও পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করার কথা বলে বন্দুকযুদ্ধে মানুষ মারাকে জায়েজ করতে চায়।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলেও কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সেই একই আত্মরক্ষার্থে গুলি কিংবা বন্দুকযুদ্ধের বয়ান দেওয়া হয়।
পুলিশের ভাষ্য, গত সোমবার সন্ধ্যায় আগৈলঝাড়ার রত্নপুর ইউনিয়নের মোল্লাপাড়ায় সাদাপোশাকে র্যাব-৮-এর মাদকবিরোধী অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সিয়াম মোল্লা নিহত হয়। তাঁর খালাতো ভাই আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই মারা গেছে। এতে যতটা না কষ্ট পাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি, তাদের দুজনকে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দেওয়ায়। দয়া করে এটি আপনারা গণমাধ্যমে তুলে ধরুন। তারা শিশু-কিশোর, মাদকাসক্ত ছিল না।’
র্যাবের অভিযানে গুলিতে এক শিক্ষার্থী নিহত ও এক শিক্ষার্থী আহতের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুরে উজিরপুর উপজেলার সাহেবেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে