রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে ঋণের দায় মাথায় নিয়ে কেউ ঘরছাড়া, কেউ নিঃস্ব
Published: 4th, March 2025 GMT
রাজশাহীর চারঘাটের মুংলি গ্রামে সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছিল। ভালো ব্যবসা হচ্ছিল। কিছু জায়গাজমিও আছে। একতলা ছাদের বাড়ি। সচ্ছল পরিবার। কিছুদিন থেকে ধারকর্জ নিয়ে আর শোধ করতে পারছিলেন না। প্রায় ১৫ দিন আগে গভীর রাতে তিনি সপরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না। আগামী ১০ এপ্রিল তাঁর ছেলের এসএসসি পরীক্ষা। সেটাও অনিশ্চিত।
এই গ্রামের আরও দুটি পরিবার একইভাবে দেনার দায়ে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গেছে। গ্রামের আরও বেশ কয়েকজন একইভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। উপজেলার কালুহাটি গ্রামের একজন পালিয়ে গেছেন, আরও অন্তত ১০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামের একজন, মাঝপাড়া বাউসা গ্রামের একজন ও দিঘা গ্রামের একজন বাড়ির ফেলে পালিয়ে রয়েছেন বলে খোঁজ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, দিন দিন গ্রামে গ্রামে এই ধরনের ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাজশাহীর প্রায় প্রতিটি গ্রামে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়া মানুষ পাওয়া যাবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সহউপাচার্য ফরিদ খান বলেন, তাঁদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্রঋণের ওপরে মাঠে কাজ করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঋণ দেওয়ার জন্য সংস্থা কর্মীদের একটা টার্গেট ধরিয়ে দেয়। এই টার্গেট পূরণের জন্য কর্মীরা ঠিকমতো যাচাই না করেই ঋণ দেন। আবার গ্রাহকেরা যে কারণ দেখিয়ে ঋণ নেন, সেটা আসলে করেন না। ফলে সময়মতো এই ঋণের টাকা আর পরিশোধ করতে পারেন না।
আবার গ্রাহকেরা যে কারণ দেখিয়ে ঋণ নেন, সেটা আসলে করেন না। ফলে সময়মতো এই ঋণের টাকা আর পরিশোধ করতে পারেন না।অধ্যাপক ফরিদ খান, সহউপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়গত মঙ্গলবার মুংলি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকসের দোকান ‘সেলিম স্টোর’ বন্ধ রয়েছে। বাজারের পেছনেই তাঁর বাড়ি। বাড়িতে তাঁর মা হোসনে আরা বেগমকে পাওয়া গেল। উঠানে বসে নাতির পোষা পাখিকে খাবার দিচ্ছিলেন। একা বাড়িতে আছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন কীভাবে—জানতে চাইলে বললেন, পাশেই তাঁর মেয়ের বাড়ি। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করছেন। কাঁদতে কাঁদতে হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘একলা মানুষ কি এত বড় বাড়িতে থাকা যায়?’ ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পাঁচ থেকে সাতজন টাকার জন্য এসেছেন। তাঁরা কেউ বলছেন পাঁচ লাখ টাকা পাবেন, কেউ বলছেন আট লাখ পাবেন। ছেলে তাঁকে এসবের কিছু বলে যায়নি। রাত একটার সময় চলে গেছেন।
একই গ্রামের মাইনুল ইসলামের একতলা ছাদের পাকা বাড়িতে গিয়ে দরজায় তালা লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেল। তবে দরজায় বেসরকারি একটি সংস্থার একটি নোটিশ লাগানো রয়েছে। এতে তাঁর অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ লেখা রয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮০ টাকা। নোটিশের নিচে সংস্থার জেলা ব্যবস্থাপকের স্বাক্ষর ও ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপক মতিউর রহমান বললেন, ‘কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহককে না পাওয়া গেলে তাঁর বাড়িতে এই নোটিশ লাগিয়ে দেওয়া হয়।’
একই গ্রামের উজ্জ্বল আলীর টিনশেডের পাকা বাড়ির সঙ্গে উজ্জ্বল ভ্যারাইটি স্টোর নামের দোকান ছিল। এখনো দোকানের সাইনবোর্ড আছে। প্রতিবেশী মাহাতাব হোসেনের স্ত্রী নাদিরা বেগম জানালেন, উজ্জ্বলের দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের বয়স ১৫ বছর হবে। মেয়ের বয়স ৮ বছর। কোলের ছেলের বয়স ৫ বছর হতে পারে। সংসারে স্ত্রী ও মা আছে। গত রমজানের পরে সবাইকে নিয়ে কখন চলে গেছেন, কেউ জানে না।
ঋণ নিয়ে ঋণচক্রে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কালুহাটিতে জুতার কারখানা করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তবে অনেকে ঋণ নিয়ে পথেও বসে গেছেন। সেই রকম একজন ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বাড়িতে এখন তাঁর বাবা-মা আছেন। তাঁরা বলতে পারেন না ছেলে কোথায় আছেন।
কালুহাটি বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, তাঁদের বাজারের অন্তত ১০ ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের আর ঋণ শোধ করার কোনো উপায় নেই। তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। উপজেলার মুংলি বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানালেন, তাঁদের বাজারে কয়েকজন ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ী আছেন। তাঁরা বেকায়দায় রয়েছেন।
একটার টাকা দিয়ে আরেকটার কিস্তি দিতেই ঘাড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেনার বোঝা হয়েছে। আফজাল হোসেন, ঋণের দায়ে পলাতকবাঘা উপজেলার পীরগাছা গ্রামের মারজুল হোসেন পেঁয়াজের আবাদ করতে গিয়ে লোকসান খেয়েছেন। ঋণ শোধ করতে না পেরে বছরখানেক আগে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। মারজুলের এক প্রতিবেশী জানান, পেঁয়াজ চাষ করার জন্য মারজুল প্রথমে একটি বেসরসারি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু পেঁয়াজের ফলন ভালো না হওয়ায় ঠিকমতো ঋণের কিস্তি দিতে পারেননি। পরে মায়ের একটা জমি ৭০ হাজার টাকায় ইজারা রাখেন। এই টাকা দিয়ে পরের মৌসুমে লাভের আশায় আরও বেশি করে পেঁয়াজ রোপণ করেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপরে টাকা নেন। শেষ পর্যন্ত সংস্থার কিস্তি শোধ করতে পারলেও গ্রামের মহাজনের ঋণ আর শোধ করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তাঁর মোট ঋণের পরিমাণ কত হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে তাঁর মায়ের জমিটিও এখনো ছাড়ানো হয়নি।
দিঘা গ্রামের আফজাল হোসেন নামে ঋণগ্রস্ত পলাতক এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি জানান, প্রথমে একটি সংস্থা থেকে ব্যবসা করার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যবসা ভালো না চলার কারণে ঋণের কিস্তি ঠিকমতো দিতে পারেননি। ওই ঋণের কিস্তি দিতে পরে আরেকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তারপরও ব্যবসা থেকে তিনি সেই টাকা তুলতে পারেননি। বাধ্য হয়ে পরে আশা থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেন। একটার টাকা দিয়ে আরেকটার কিস্তি দিতেই শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘাড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেনার বোঝা চাপে। তখনই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান আফজাল। পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটি। এখনো তিনি পালিয়ে আছেন। বাইরে কাজ করে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করছেন। তিনি কোথায় আছেন, তা জানাননি।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, এ বিষয়ে তাঁকে কেউ কিছু জানাননি। তবে যাঁর ছেলে পরীক্ষার্থী, এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এ জন্য কারা ঋণ দিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারলে সুবিধা হতো। তবু তিনি বিষয়টি দেখবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র ম র একজন উপজ ল র শ ধ করত ব যবস য় প র নন শ ধ কর র জন য ঋণ ন ন ঋণ ন য়
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডা: পশ্চিমাদের জেগে ওঠার বার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে বসে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করেছেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের হতবাক করেছে। এই ঘটনা ওয়াশিংটনের বিশেষজ্ঞদের ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নিয়ে শোকগাথা লেখার দরজা খুলে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম গোলার্ধে বিরাজমান তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিভাষায় ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নামে পরিচিত।
ট্রাম্প-জেলেনস্কির গত শুক্রবারের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা স্পুতনিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং প্রতিরক্ষা নীতির দুজন অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছে। এই ঘটনার পর কী ঘটতে পারে, তা নিয়েও তাঁরা মন্তব্য করেছেন।
শুক্রবারের কথার লড়াই নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তুরস্কের সাংবাদিক সেয়দা করন বলেন, ‘জেলেনস্কি এমন একটি খোলামেলা, আর্থিক দিক থেকে অবাধ, কিন্তু নিরাপত্তার নিশ্চয়তাহীন চুক্তি করতে নিঃশর্তভাবে ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন, যা তাঁর নিজের দেশে ভিন্ন কথা বলে জনপ্রিয় করা হয়েছিল। ট্রাম্প ও (যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি) ভ্যান্স প্রকাশ্যেই বলেছেন, জেলেনস্কি পরাস্ত হয়েছেন, তিনি তাঁর দেশের মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন। তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় সেনাসদস্য নেই, তাঁদের শান্তিচুক্তিতে সম্মত হওয়া উচিত।’
ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগ্বিতণ্ডার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ করে করন বলেন, ‘তাঁরা সোজাসাপটা বলেছেন, জেলেনস্কি পুরো বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, ট্রাম্প পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এমন এক সত্য উপস্থাপন করছেন, যা রাজনৈতিক পরিশুদ্ধতার আলোচনায় এখন সর্বজনস্বীকৃত।’
তুরস্কের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, জেলেনস্কি ‘এমন এক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে চেয়েছিলেন, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট খারাপ ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প যে ইউক্রেনের (খনিজ) সম্পদের মালিকানা দাবি করেছেন, তা বিশ্বের কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন জেলেনস্কি একজন ভুক্তভোগী। অথচ গত এক বছর ধরে জেলেনস্কি নিজেই এই বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। কিয়েভের জন্য নতুন সামরিক সহায়তা অনুমোদন নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সমস্যা হচ্ছিল, তখন জেলেনস্কিই সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের পাশে বসে ওয়াশিংটনের কাছে সম্পদ নিয়ে চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন। ওই সময় গ্রাহাম আপ্তবাক্য আওড়ে বলেছিলেন, “ইউক্রেনে যদি একজন ব্যক্তিও বেঁচে থাকে, আমরা তাঁর রক্ষায় লড়াই” চালিয়ে যাবে। পাশে বসে গ্রাহামের বক্তৃতা শুনছিলেন জেলেনস্কি।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির (বাঁয়ে) সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের আগে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে, ১ মার্চ ২০২৫