মসজিদের এক পাশে শামিয়ানা টানিয়ে সাজানো হচ্ছে প্লেট। একটা বড় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা প্লেটে প্লেটে বেড়ে দিচ্ছিলেন পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, আলুর চপ, পাকোড়া ও জিলাপি। বড় টেবিলের পাশেই বিশাল এক ড্রামে রুহ আফজা, লেবু আর চিনি মিশিয়ে শরবত তৈরি করছিলেন একজন। বরফের বড় খণ্ড ভেঙে টুকরা করে দেওয়া হচ্ছিল ড্রামে। রোজাদারেরা এই হৃদয়জুড়ানো ঠান্ডা শরবত পান করেই ইফতার শুরু করবেন।

২৪ বছর ধরে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে এমন গণ–ইফতারের আয়োজন চলছে। এর মধ্যেই এটি নগরের অন্যতম ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে ইফতারে শামিল হতে দূরদূরান্ত থেকে যেমন লোকজন আসেন, তেমনি পথচারী, শ্রমজীবীসহ নানা পেশার মানুষও থাকেন। ইফতারির থালায় ধনী-গরিবের ব্যবধান ঘুচে যায়।

বরফের বড় খণ্ড ভেঙে টুকরা করে দেওয়া হচ্ছিল ড্রামে। রোজাদারেরা এই হৃদয়জুড়ানো ঠান্ডা শরবত পান করেই ইফতার শুরু করবেন।

গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে চারটায় আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের মূল ফটকের পর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে চোখে পড়ে অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যে গড়া মূল ভবন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের মোগল শাসকদের অন্যতম গর্বের ইতিহাস—চট্টগ্রাম বিজয়ের ঘটনা। সাড়ে তিন শতাব্দীর পুরোনো আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ এখনো তার মহিমা হারায়নি এতটুকু। হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করেন প্রতিদিন।

মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই মসজিদ সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত হয়েছে। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ দীর্ঘ, সাড়ে ৭ গজ প্রশস্ত। মসজিদের পশ্চিমের দেয়াল পোড়ামাটির ইটে তৈরি, বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। ছাদের মধ্যে একটি বড় গম্বুজ ও দুটি ছোট গম্বুজ। চারটি অষ্টভুজাকৃতি বুরুজের মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো টিকে আছে।

খোলা বড় চত্বর আর জাফরিকাটা খিলানের সাবেকি মসজিদে বিকেলের আলো এসে পড়ায় এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্লেটে প্লেটে ইফতারি পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবকেরা।

আবুল হোসেন জানালেন, আজকের (সোমবার) আয়োজনে ৭০ কেজি ছোলা, ২৫ কেজি পেঁয়াজু, ২৫ কেজি বেগুনি, ৪০ কেজি আলুর চপ তৈরি করেছেন তাঁরা। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় রান্নার কাজ। চলে দুপুর পর্যন্ত। রান্নার কাজে তাঁর সঙ্গে ১০ জন সহযোগী ছিলেন।

মসজিদের ইফতার আয়োজনের জন্য রান্নার কাজটা সামলান বাবুর্চি আবুল হোসেন। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিন বছর ধরে শাহি মসজিদে ইফতার আয়োজনে যুক্ত তিনি। আবুল হোসেন জানালেন, আজকের (সোমবার) আয়োজনে ৭০ কেজি ছোলা, ২৫ কেজি পেঁয়াজু, ২৫ কেজি বেগুনি, ৪০ কেজি আলুর চপ তৈরি করেছেন তাঁরা। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় রান্নার কাজ। চলে দুপুর পর্যন্ত। রান্নার কাজে তাঁর সঙ্গে ১০ জন সহযোগী ছিলেন।

মসজিদের এক কোণে প্রতিবছরের মতো এবারও বড় ড্রামে শরবত তৈরি করছিলেন মো.

শহীদ আলম। এক ব্যবসায়ীর কর্মচারী তিনি। প্রতিবছর রোজায় ওই ব্যবসায়ীর খরচে শরবতের আয়োজন করা হলেও তিনি নাম প্রকাশ করতে চান না। শহীদ আলম জানান, প্লাস্টিকের বড় এক ড্রাম শরবত তৈরিতে প্রতিদিন ১৫ বোতল রুহ আফজা ও ১৫ কেজি চিনি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান শাহিদ আলম।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মসজিদ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রিকশাচালক—কে নেই এই গণ-ইফতার আয়োজনে। মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদ এই আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। তিনি জানান, প্রতিবছর ইফতার আয়োজন চলে। বছর বছর এখানে মুসল্লি আর রোজাদারের সংখ্যা বাড়ছে।

চারজনই ভিন্ন বয়সের, পোশাকেও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সব ব্যবধান হঠাৎ যেন ঘুচে গেছে। ইফতারির থালা ঘিরে এক অনন্য সৌহার্দ্য তৈরি হয়েছে। এটাই এই গণ–ইফতারের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আর এর টানেই এখানে রোজাদারেরা ছুটে আসেন।

অনেকে এখানকার ইফতার আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজে থেকে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে আলাপ হলো মো. তারেক, মাইনুদ্দিন ও জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে। তারেক এলাকারই একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। রোজার মাসে সে মসজিদে ইফতারি পরিবেশনের কাজ করবে বলে জানায়। বাকি দুজন মাইনুদ্দিন ও জয়নাল শ্রমজীবী। দিনভর কাজে ব্যস্ত থাকার পর তাঁরা বিকেলে এখানে আসেন ইফতার আয়োজনে শামিল হতে।

বড় দস্তরখানা বিছিয়ে সারি করে বসেন রোজাদারেরা। ভ্যানচালক রবিউল হোসেন আর ব্যাংকার নিজাম উদ্দিন বসেন পাশাপাশি। তাঁরা দুজনেই আন্দরকিল্লা এলাকায় কাজে এসেছিলেন। বাসা দূরে বলে এখানে ইফতার সেরে নিচ্ছেন। দুজনের পাশেই একটা বড় থালায় চারজন বসেছেন। চারজনই ভিন্ন বয়সের, পোশাকেও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সব ব্যবধান হঠাৎ যেন ঘুচে গেছে। ইফতারির থালা ঘিরে এক অনন্য সৌহার্দ্য তৈরি হয়েছে। এটাই এই গণ–ইফতারের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আর এর টানেই এখানে রোজাদারেরা ছুটে আসেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইফত র র থ ল মসজ দ র ২৫ ক জ

এছাড়াও পড়ুন:

ইফতারের শরবতের লেবুর দামে আগুন, সিলেটে ৫ টাকার লেবু এখন ২৫ টাকা

পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিলেটে লেবুর দাম বেড়ে গেছে। ১০ দিন আগে যে লেবুর দাম ছিল ৫ টাকা, এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। তবে অন্যান্য সবজির দাম স্থিতিশীল আছে।

গতকাল শনিবার রাতে নগরের বন্দরবাজার, আম্বরখানা, রিকাবিবাজার ও মদিনা মার্কেট এলাকা ঘুরে এমন চড়া দামে লেবু বিক্রি হতে দেখা যায়। বিক্রেতারা জানান, ইফতারের সময় ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার কাছে লেবুর শরবতের বেশ চাহিদা থাকে। তবে বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এ কারণে দাম একলাফে কয়েক গুণ বেড়েছে।

বাজার ঘুরে জানা গেছে, দেড় সপ্তাহ আগে মাঝারি আকারের লেবু প্রতি হালির দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকা। অন্যদিকে বড় আকারের লেবু প্রতি হালি এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। আগে তা ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা।

রিকাবিবাজার এলাকার সবজি ব্যবসায়ী মো. হেলাল মিয়া গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে সব ব্যবসায়ীর লেবু শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর তিনি ১০০টি লেবু এনেছিলেন। এখন আছে মাত্র এক হালি। পাইকারি বাজারে লেবুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারে একলাফে কয়েক গুণ বেড়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

সিলেটের রিকাবিবাজার এলাকার সবজি ব্যবসায়ী মো. হেলাল মিয়া শনিবার সন্ধ্যার পর ১০০টি লেবু এনেছিলেন। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক হালি বাদে সব লেবু বিক্রি হয়ে যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রোজায় স্বাস্থ্যসম্মত খাবার
  • ইফতারে কোন দেশে কী খাওয়া হয়
  • লেবুর দাম হালিতে বেড়েছে ৩০ টাকা
  • ইফতারের শরবতের লেবুর দামে আগুন, সিলেটে ৫ টাকার লেবু এখন ২৫ টাকা
  • ইফতারে লেবুর শরবতের বিকল্প কী হতে পারে