Prothomalo:
2025-03-04@07:33:00 GMT

সকালেই পড়ুন আলোচিত ৫ খবর

Published: 4th, March 2025 GMT

ছবি: বিবিসি বাংলা

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার

লেখক ও সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কমিশন প্রধানের একান্ত সচিবআমাদের অন্যতম সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। একাত্তরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। 

বাংলাদেশ ‘জেনুইন ইলেকশন’, অর্থাৎ সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। কারণ, রাষ্ট্র আকারে আমরা ‘সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’-এ স্বাক্ষরদাতা। তাই আমরা যে নির্বাচনই আয়োজন করি না কেন সে নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম ও অতি আবশ্যকীয় পদক্ষেপ হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে কিছু নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বহুলাংশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আবার কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে। আর যখনই জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে, তখনই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনগুলোয় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বস্তুত নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এবং জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। ফলে দেশের সর্বস্তরে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। তাই রাজনীতি ও নির্বাচনী অঙ্গন পরিচ্ছন্ন করা এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।

আশার কথা হলো, গত ৫ আগস্ট এক অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। স্বভাবতই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো নির্বাচনব্যবস্থাসহ দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন, যাতে দেশে আর কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসতে না পারে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার, বাক স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়।

আমরা আশাবাদী যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’। আমরা আরও আশাবাদী যে, কমিশন ৪৩১ পৃষ্ঠার (পরিশিষ্ট-সহ) প্রতিবেদন সরকার প্রধানের নিকট হস্তান্তর করেছে। 

কমিশনের তার কাজের শুরুতেই ১৮টি ক্ষেত্রকে সংস্কারের অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। বিষয়গুলো হলো: (১) নির্বাচন কমিশন; (২) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা; (৩) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন; (৪) জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; (৫) সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ; (৬) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন; (৭) জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবস্থাপনা ও ভোটার তালিকা; (৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন; (৯) জাতীয় সংসদে সংসদ নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব; (১০) প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা; (১১) অনলাইন (ইন্টারনেট) ভোটিং; (১২) নির্বাচনি অপরাধ; (১৩) নির্বাচনি বিরোধ ও বিচার ব্যবস্থাপনা; (১৪) নির্বাচনি পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা; (১৫) রিকল বা প্রতিনিধি প্রত্যাহার; (১৬) নির্বাচনি ব্যয়; (১৭) গণভোট (১৮) স্থানীয় সরকার নির্বাচন।

কমিশনের তার মেয়াদকালে জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সকল আইন, বিধি-বিধান, রীতি এবং ব্যবস্থাপনা বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রণয়নের লক্ষ্যে আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য অংশীজনের মতামত নিয়েছে কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও লিখিত মতামত নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহায়তায় জাতীয়ভাবে একটি জরিপেরও আয়োজন করা হয়। নির্বাচনি দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার মাধ্যমে বিগত তিনটি নির্বাচনের সমস্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন কমিশনের সদস্যগণ। ঢাকায় এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কমিশন মতবিনিময় করেছে। মোবাইলে এসএমএস প্রেরণ, ওয়েবসাইট, ই-মেইল ও ফেসবুকের মাধ্যমে দেশের সকল নাগরিকের কাছেও মতামত আহ্বান করেছিল, যাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে পরামর্শের জন্য প্রবাসীদের সঙ্গে অনলাইন সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

সকল অংশীজনের মতামত বিবেচনা করে কমিশন গ্রহণযোগ্য মতামতগুলোর ভিত্তিতে তার সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কমিশন সদস্যদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং বিবেচনাবোধের সঙ্গে সকল পর্যায়ের অংশীজনের মতামত যুক্ত হয়েছে। মোট ১৮টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে কমিশন দুই শতাধিক সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। কমিশন মনে করে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে তা নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন একটি সমন্বিত ‘নির্বাচন কমিশন আইনে’র খসড়া প্রণয়ন করেছে। খসড়া আইনে শুধু রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক সমাজের অর্থবহ অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়নি, এতে আরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কমিশনের কার্যপরিধি, দায়িত্ব, ক্ষমতা, জনবল ও দায়বদ্ধতার বিষয়গুলো। 

সংস্কার কমিশন মনে করে, যেহেতু নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠূ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা নির্বাচনের কস্টোডিয়ান। তাই কমিশন চেষ্টা করেছে কমিশনকে আরও ক্ষমতায়িত ও শক্তিশালী করতে। কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার একটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের দুর্বৃত্তায়িত নির্বাচনি অঙ্গন। তাই নির্বাচনি অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগতার মাপকাঠিকে কঠোর করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। ঋণখেলাপিদের নির্বাচনি মাঠ থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে প্রস্তাব করেছে। কমিশন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদেরকে বিচারিক আদালত বা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার দিন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করার সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে আইনানুগভাবে অযোগ্য করার সুপারিশ করেছে আমাদের দেশে যারা ভয়াবহ মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তাদেরকে। নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনা এবং প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা এবং এতে ভুল তথ্য দেওয়ার বা তথ্য গোপনের প্রমাণ পেলে নির্বাচনের আগে প্রার্থিতা বাতিল এবং নির্বাচনের পরে যে কোনো সময় প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করার সুপারিশও করেছে সংস্কার কমিশন।

নির্বাচনি অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করার পাশাপাশি সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকেও পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও দলের নেতাকর্মীদের কাছে দায়বদ্ধ করার সুপারিশ করেছে। নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে কমিশন সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বাৎসরিকভাবে একটি তালিকা করে তা প্রকাশের এবং এ তালিকা ব্যবহার করে দলের সব স্তরের কমিটি নির্বাচনের। একইসঙ্গে সুপারিশ করেছে দলের সদস্যদের চাঁদা এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুদান ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রহণ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করার এবং ব্যয়ের অডিট করা হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার ও তা প্রকাশ করার। কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’-এর আওতায় আনার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়াও কমিশন সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের ভোটে প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকার জন্য তিন সদস্যের একটি প্যানেল তৈরি করার, যে প্যানেল থেকে দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার জন্য একজনকে মনোনয়ন দেবে। কমিশন সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন এবং বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করার। এ ছাড়া যারা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য তাদেরকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্য এবং কোনো কমিটির সদস্য হওয়া থেকেও বিরত রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও কলুষমুক্ত রাখার লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন রিকল ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে সুপারিশও করেছে ‘না-ভোটে’র বিধান ফিরিয়ে আনার এবং জাতীয় নির্বাচনে যেসব আসনে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়বে সেগুলোতে পুনর্নির্বাচন আয়োজনের। একইসঙ্গে যারা ২০১৮ সালের জালিয়াতির নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন তাদেরকে তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০১৪ ও ২০২৪ সালে যারা একতরফা ও পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন তাদেরকেও এই তদন্তের আওতায় আনা যেতে পারে বলে মনে করে সংস্কার কমিশন। 

কমিশন মনে করে, জাতীয় সংসদে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন সম্পূর্ণ আলংকারিক এবং এটি নারীদের জন্য মর্যাদাকরও নয়। তাই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৪০০- এ উন্নীত করে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করার এবং এগুলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পূরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক দফায় লটারি বা অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, যেখানে শুধু নারীরাই যোগ্যতার ভিত্তিতে একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ৩০০টি সাধারণ আসনে নারী-পুরুষ উভয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এই পদ্ধতিতে ২০ বছরের মধ্যে প্রতিটি আসন থেকে একজন নারী যোগ্যতার ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পাবেন এবং জনগণের ভেটে এসব নির্বাচিত নারীরা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের মতো একই ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সুযোগসুবিধা ভোগ করবেন। এদের মধ্যে যোগ্য নারীরা ভালো কাজ ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পরবর্তীতে তাদের পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিতে আসতে পারবেন। এভাবে এক সময়ে নারীদের জন্য আর সংরক্ষিত আসন রাখারই প্রয়োজন পড়বে না। কমিশন মনে করে যে, এটি একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব এবং এর মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক অপূর্ব ও ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হবে, যদিও এর জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, টাকার খেলা বাংলাদেশের রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করেছে। ‘উই হেভ দ্য বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’। টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন গণতন্ত্র আমাদের দেশে বিরাজ করছে। এ লক্ষ্যে ‘দৃশ্যমান’ নির্বাচনি ব্যয় নিরীক্ষণের লক্ষ্যে কমিশন সুপারিশ করেছে। কমিশন সুপারিশ করেছে পোস্টার, বিল বোর্ড ইত্যাদি বন্ধের। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত ‘অদৃশ্য’ নির্বাচনি ব্যয় অর্থাৎ মনোনয়ন বাণিজ্য ও ভোট-কেনা বেচা বন্ধের ব্যাপারে কমিশন হলফনামার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পদের বিবরণী প্রদানের এবং তা যাচাই-বাছাই করার সুপারিশ করেছে। তবে কমিশন মনে করে, এসব অদৃশ্য ব্যয় বন্ধ করা না করা নির্ভর করবে আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদদের এবং তাঁদের নৈতিকতাবোধের ওপর। 

দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চরমভাবে কলুষিত হয়েছে। তাই সংস্কার কমিশন নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। দলীয়করণের দুষ্টু থাবা থেকে দূরে রাখতে কমিশন সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরাসরিভাবে মেয়র/চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে সুপারিশ করেছে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের। 

বাংলাদেশের প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে বসবাস করেন এবং এদের একটি অংশ ভোটার নন এবং প্রায় অধিকাংশই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। এ বিরাট জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলে আমাদের নির্বাচনি ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পারে না। তাই সংস্কার কমিশন প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্ড দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কমিশন প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালট বা ই-ভোটিং ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। এছাড়াও এনআইডি ব্যবস্থাপনা সাময়িকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করলেও আগামী সাত বছরের মধ্যে একটি স্বাধীন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের সুপারিশ করেছে। কারণ এনআইডি ব্যবস্থাপনা কারিগরিভাবে একটি জটিল বিষয় এবং এর ব্যাপ্তি বিশাল, তাই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সুচারুরূপে পালন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও এটাই হলো আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস।

সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হবেন নারী। আমরা সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্যদের বয়স ন্যূনতম ৩৫ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাাতক নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।

কমিশন দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে। সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ সীমিত করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি দুইবার নির্বাচত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়াও একই ব্যক্তিকে একইসঙ্গে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা না করার সুপারিশ করেছে।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, অতীতের সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। একটি গুরুতর অভিযোগ করা হয় যে, সীমানা নির্ধারণে কারসাজির আশ্রয় নিয়ে একটি দলকে অতীতের নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই বহুল ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণে একটি আলাদা স্বাধীন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সীমানা নির্ধারণের কাজটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর মাধ্যমে স্বাধীন কর্তৃপক্ষের কাছে নির্বাচন কমিশনের মতামত প্রদানের সুযোগ থাকবে। তবে আগামী নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ কাজটি সম্পন্ন করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

কমিশনের আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, নির্বাচনের সময় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ ওঠে, যা অনেক সময়ই সুরাহা হয় না। একইভাবে অনেক নির্বাচনি অপরাধেরও শাস্তি হয় না। বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জড়িতদের অনেকেই অনেক গুরুতর অপরাধ করেছেন, কিন্তু কেউই শাস্তির আওতায় আসেননি। তাই সংস্কার কমিশন নির্বাচনি অভিযোগ এবং অপরাধ ব্যবস্থাপনার জন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। ইলেকশান পিটিশান বা নির্বাচনি বিরোধ মিমাংসার ক্ষেত্রে প্রায় সীমাহীন দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে কমিশন এর বিচারের দায়িত্ব হাইকোর্ট থেকে আবার জেলা জজের নেতৃত্বে জেলায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে।  কমিশন ২০১৮ সালের জালিয়াতির নির্বাচনের দায় নিরুপণের জন্য একটি ‘বিশেষ তদন্ত কমিশন’ গঠন করার সুপারিশ করেছে। 

কমিশন মনে করে, অন্যান্য সাম্প্রতিক বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরকেও এ তদন্তের আওতায় আনা যেতে পারে। এছাড়াও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আচরণবিধি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

আমি মনে করি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে গভীর আইনি, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। আশার কথা হলো, ইতোমধ্যে সংস্কার প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রথম ৬টি কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

আমাদের আশাবাদ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচ্ছন্ন হবে, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উত্তরণ ঘটবে।

লেখক: সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কমিশন প্রধানের একান্ত সচিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ