পাইকারিতে দাম কমলেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে
Published: 4th, March 2025 GMT
রমজান মাস ঘিরে এবার ভোগ্যপণ্য আমদানির নতুন রেকর্ড হয়েছে। সর্বশেষ চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, চিনি, খেজুর, পেঁয়াজসহ ৯ ধরনের পণ্য প্রায় ৩৯ শতাংশ বেশি এসেছে। তবে পাইকারি বাজারে এমন আমদানির সবচেয়ে বেশি প্রভাব খেজুরের দামে। এই পণ্যের যে হারে দাম কমেছে, তা ‘অবিশ্বাস্য’ বলছেন অনেকে। এ ছাড়া প্রতিদিন দাম কমছে ডাল, চিনি, পেঁয়াজেরও। তবে পাইকারি বাজারে যে হারে দাম কমছে, সে হারে খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকায় দাম কমার সুফল কিছুটা কম পাচ্ছেন সাধারণ ভোক্তা।
চট্টগ্রামের প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মিয়া মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিছ আলম বলেন, আগের বছরের তুলনায় এবার বেশ কিছু পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে। তাই কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজসহ মসলা জাতীয় বিভিন্ন পণ্য।
টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম বলেন, গত দুই মাসে ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম নিম্নমুখী থাকায় বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে। বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাবও আছে।
৩০-৪০ শতাংশ কমেছে খেজুরের দাম
দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৬০ থেকে ৯০ হাজার টন। শুধু রমজান মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। খেজুর মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, জর্ডান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়। গত কয়েক বছর ধরে রমজান শুরুর আগেই আগুন লাগত খেজুরের দামে। এবার সে চিত্র একেবারে বিপরীত। ১০ শতাংশ শুল্কহার কমার প্রভাবে কেজিতে খেজুরে দাম কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। গতবারের তুলনায় এবার মানভেদে কোনো কোনো খেজুরের দাম ১০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের ফলমন্ডী ও রিয়াজউদ্দিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বহু জাতের খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ইরাকি জায়েদি খেজুরের। গত বছরের তুলনায় এবার জায়েদি খেজুর ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কমে ৩৫০ থেকে ৩৭০, আজোয়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কমে ৬০০ থেকে ৮০০, মেডজল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা কমে ৯০০ থেকে ৯৫০ এবং মাবরুম খেজুর ৪০০ টাকা কমে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ জানান, পাইকারিতে জায়েদি খেজুর ১০ কেজির কার্টন ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বস্তার খেজুর ১২৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খেজুরের দাম আরও কমে আসতে পারে।
পণ্য বেশি এলেও প্রভাব কম খুচরা বাজারে
রমজানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ৯টি পণ্য। এসব পণ্যের রমজান-পূর্ববর্তী চার মাসের ঋণপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এবার গড়ে ৩৯ শতাংশ পণ্য বেশি এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা চিনি চার লাখ ৫৪ হাজার, ডাল জাতীয় পণ্য ১ লাখ ৫৭ হাজার, সয়াবিন তেল ৫ লাখ ৯৮ হাজার, ছোলা ৫৭ হাজার ৫৫৫, মটর ডাল ২ লাখ ২ হাজার ৮৪৫, পেঁয়াজ ২ লাখ ৮০ হাজার, রসুন ৬১ হাজার ৩৮১, আদা ৫২ হাজার ৫১৫ ও খেজুর ১৪ হাজার ৪২০ টন আনার ঋণপত্র নিষ্পত্তি করেছেন।
অথচ গত রমজানের একই সময়ে (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি) ব্যবসায়ীরা চিনির জন্য ৩ লাখ ৭৮ হাজার, ডাল জাতীয় পণ্য ১ লাখ ৯ হাজার, সয়াবিন তেল ৪ লাখ ৪৭ হাজার, ছোলা ৫৯ হাজার ৩২৯, মটর ডাল ১ লাখ ৯ হাজার, পেঁয়াজ ২ লাখ ৭৫ হাজার, রসুন ৫০ হাজার ৯৯৫, আদা ৩৩ হাজার ৫৭৩ ও খেজুর ১১ হাজার ৭১৪ টন পণ্য আনতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি করেছিলেন। এই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার চিনিতে ২০ শতাংশ, ডাল জাতীয় পণ্যে ৪৪, সয়াবিন তেলে ৩৪, ছোলায় ৬৪, মটর ডালে ৮৫, পেঁয়াজে ২, রসুনে ২০, আদায় ৫৬ ও খেজুরের আমদানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এটির প্রভাবে এবার পাইকারি বাজারে কিছু পণ্যের দাম কমেছে। তবে সেই হারে খুচরা বাজারে দাম কমেনি।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভোগ্যপণ্য যে হারে আমদানি হয়েছে, দাম আরও কমার কথা। ছোলার দাম কিছুদিন কম থাকলেও এখন আবার বেড়েছে। অবশ্য খেজুরের দাম এখনও কম। মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকায় খুচরা বাজারে ভোক্তারা দাম কমার সুফল সেভাবে পাচ্ছেন না। প্রশাসনের নজরদারি আরও জোরদার করা দরকার।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব জ রদর দ ম কম আমদ ন বছর র রমজ ন
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বিপক্ষীয় আস্থা পুনর্নির্মাণের সূচনা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যাংককে শুক্রবার অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটিকে আমরা ইতিবাচক বলিয়া মনে করি। বিশেষত দক্ষিণ এশীয় ভ্রাতৃত্ববোধ গড়িয়া তুলিবার ক্ষেত্রে ইহা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচিত হইতে পারে। প্রথমত, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের জোট বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হইল, যখন বিশেষ কিছু কারণে–যাহার জন্য কোনো দেশই এককভাবে দায়ী নহে–দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকিয়াছিল। অথচ দুই দেশেরই শীর্ষ নেতারা মনে করিয়া থাকেন, ভারত ও বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে নহে, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনেও আবদ্ধ। অতএব, শুক্রবারের বৈঠক দুই দেশের সম্পর্কে জমাটবদ্ধ বরফ গলাইতে সহযোগিতা করিতে পারে। দ্বিতীয়ত, বহু বৎসর যাবৎ ধরিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা চ্যালেঞ্জের মুখে রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অনেক সম্ভাবনা লইয়া গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট–সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হইয়া রহিয়াছে। ড. ইউনূস সম্প্রতি সার্ককে সক্রিয় করিবার প্রয়াস শুরু করিয়াছেন, যেই ক্ষেত্রে শুক্রবারের বৈঠকটি অবদান রাখিতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা জানিয়াছি, বাংলাদেশের পক্ষ হইতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, গঙ্গা চুক্তির নবায়ন, তিস্তাসহ আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের পানি ন্যায়সংগতভাবে বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলি ভারতের শীর্ষ নেতার সমক্ষে উপস্থাপন করা হইয়াছে। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ হইতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক উত্তরণ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যথাযথ তদন্ত ও বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হইয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, পরস্পরের নিকট স্বীয় ফর্দ তুলিয়া ধরিবার মধ্য দিয়াই বৈঠকটি সমাপ্ত হইয়াছে। তবে ইহাকে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার সূত্রপাত হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। স্মরণে রাখিতে হইবে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম ড. ইউনূসের সহিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হইল। উভয় পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকিলে এই সম্পর্ক আগামী দিনসমূহে আরও গভীর হইবে।
জন্মলগ্ন হইতে বাংলাদেশ সকলের সহিত বন্ধুত্ব কাহারও সহিত শত্রুতা নহে– এই পররাষ্ট্রনীতি লইয়া চলিয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হইলেও বাংলাদেশের বিগত প্রায় সকল সরকারই এই নীতি মানিয়া চলিয়াছে। সম্ভবত বাংলাদেশের এই নীতির কারণে সার্কের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকাকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল। এই নীতির সুফল হিসেবে ইতোপূর্বে বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সহিত দীর্ঘদিন ধরিয়া বিরাজমান সমুদ্রসীমা, ভৌগোলিক সীমারেখার ন্যায় একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হইয়াছে। আমরা বিশ্বাস করি, মিয়ানমারের সহিত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং ভারতের সহিত আন্তঃনদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ যেই সকল সমস্যা রহিয়া গিয়াছে সেইগুলিও ওই একই প্রক্রিয়ায় নিরসণ করা যাইবে। তবে ইহা সত্য, এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আচরণ প্রায়শই প্রতিবেশীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, যাহা হইতে দেশটিকে বাহির হইতে হইবে। সেই বহুলশ্রুত প্রবাদ বাক্যটি কে না জানে যে, এক হাতে যদ্রূপ তালি বাজে না, তদ্রূপ বন্ধুত্বও একতরফা হয় না। উভয়ের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা এই ক্ষেত্রে জরুরি। বাংলাদেশ বা ভারত কেহই ইচ্ছা করিলে পরস্পরকে প্রতিবেশীর তালিকা হইতে বাদ দিতে পারিবে না। জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা নিশ্চিত করিবার জন্য উভয়ের নিকট উভয়ে অপরিহার্য। তদুপরি, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত যদ্রূপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অমিত সম্ভাবনা উন্মোচিত করিতে পারে তদ্রূপ অন্তত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল তথা সাত বোন বলিয়া খ্যাত রাজ্যসমূহের উন্নয়নে বাংলাদেশ অতুলনীয় ভূমিকা পালন করিতে পারে। বৈশ্বিক কূটনীতিতেও দুই দেশের মিত্রতা উভয়কে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে।
এই সকল বিষয় বিবেচনায় রাখিয়া দ্বিপক্ষীয় আস্থার ভিত্তি নির্মাণে উভয় দেশের নেতৃত্ব সচেষ্ট থাকিবে বলিয়া আমরা প্রত্যাশা করি।