২৯ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প পায় যুক্তরাষ্ট্রেরই সংস্থা: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
Published: 3rd, March 2025 GMT
বাংলাদেশে ‘দুই ব্যক্তির অপরিচিত এক প্রতিষ্ঠানের’ ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়ার যে তথ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, তা ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করেছে ঢাকা।
সোমবার (৩ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ২৯ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাংলাদেশের দুজন ব্যক্তির মালিকানাধীন কোনো সংস্থাকে দেওয়ার অভিযোগটি সত্য নয়।
মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে জানিয়ে বর্ণনা করা হয়, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইউএসএআইডি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালকে (ডিআই) নির্বাচিত করে।
আরো পড়ুন:
পুতিনের পরিবর্তে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে চিন্তা করা উচিত: ট্রাম্প
আবারো ফেডারেল কর্মীদের কাজের হিসাব চাইলেন মাস্ক
গত ২১ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে এক অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে এমন এক সংস্থা ২৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যে সংস্থার নাম আগে কেউ শোনেনি। সেই সংস্থায় মাত্র দুজন কাজ করেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি মেরিল্যান্ডে এক অনুষ্ঠানে আবারো সেই প্রসঙ্গ তোলেন ট্রাম্প। এদিন তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ২৯ মিলিয়ন ডলার গেছে রাজনৈতিক পরিসর শক্তিশালী করতে এবং তাদের সহায়তা করতে, যাতে তারা একজন কট্টর বাম কমিউনিস্টকে ভোট দিতে পারে।’’
ট্রাম্পের ওই বক্তব্য নিয়ে নানা মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান মাইক্রোগভর্নেন্স রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (এমজিআর) এই অনুদান পেয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদারের সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই অর্থ পেয়েছে বলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় কেউ কেউ অভিযোগ করেন।
অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য দেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। গত শনিবার তিনি সংবাদকর্মীদের বলেন, “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সুজন কোনো নিবন্ধিত সংগঠন নয়। সুজন কোনো বিদেশি সাহায্য নিতে পারে না; সংগঠনটি পরিচালিত হয় বিভিন্ন ব্যক্তির সহায়তায়।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ইউএসএআইডির অর্থায়নে ২৯ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা) ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ প্রকল্প নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা নিয়ে জনমনে ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুসন্ধান করেছে।
অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইউএসএআইডি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালকে (ডিআই) নির্বাচিত করে। প্রকল্প প্রস্তাবনা আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণের মধ্য দিয়ে ইউএসএআইডি সিদ্ধান্তটি নেয়। ২০১৭ সালের মার্চে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ডিআই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু করে। পরে প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় এবং এর অর্থ আসে ধাপে ধাপে।
শুরুতে এসপিএল প্রকল্পটি ছিল ৫ বছর মেয়াদি এবং বাজেট ছিল ১৪ মিলিয়ন ডলার। প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনায় ছিল ইউএসএআইডি এবং অর্থায়নে ছিল ইউএসএআইডি ও যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ডিএফআইডি (বর্তমানে এফসিডিও)। এই প্রকল্পে ডিএফআইডির অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার।
এসপিএল প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাস করে শান্তি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরি, দলগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার উন্নয়ন এবং প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বের বিকাশে উৎসাহ দেওয়া। প্রকল্পের অধীনে ডিআই বাংলাদেশে জরিপ কার্যক্রমও পরিচালনা করে।
এই প্রকল্পের বাস্তবায়নও শুরু হয় ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়। চার বছর বিরতির পর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর প্রথমেই ইউএসএআইডির ওপর খড়্গহস্ত হন ট্রাম্প। মার্কিন এই সংস্থা গত শতকের ষাটের দশক থেকে বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রম দেখভাল করে আসছে। শুরুতেই এক নির্বাহী আদেশে এ সংস্থাসহ বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের উন্নয়ন অর্থায়নে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ দেশ তিনি।
ইউএসএআইডির দিকে তোপ দাগার এই সময়ে তিনি সঙ্গী করেছেন ধনকুবের ইলন মাস্ককে; যাকে নতুন গঠিত ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির (ডিওজিই) প্রধান করা হয়েছে।
ট্রাম্প ও মাস্কের দাবি, সংস্থাটি অহেতুক নানা প্রকল্পে মার্কিন করদাতাদের অর্থ খরচ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কাজে তো আসেইনি, উল্টো জালিয়াতির মাধ্যমে অনেককে পকেট ভরার সুযোগ করে দিয়েছে। ইউএসএআইডি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক প্রচার নিয়ন্ত্রণেও অর্থ ব্যয় করেছে বলে অভিযোগ তাদের।
এমন প্রচারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন ট্রাম্প ও মাস্ক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ২৯ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পের উদাহরণ টানছেন তারা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ওয়াশিংটনে আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “২৯ মিলিয়ন ডলার গেছে বাংলাদেশে, যেন একজন উগ্র বামপন্থি কমিউনিস্টকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা যায়।”
উগ্র বামপন্থি কমিউনিস্ট হিসেবে কারো নাম উচ্চারণ করেননি ট্রাম্প। কিন্তু জো বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনায় প্রায়ই তিনি ‘উগ্র বাম কমিউনিস্ট’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন।
২৯ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের বিষয়ে আরো তথ্যের অপেক্ষায় থাকার কথা গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুসন্ধানে জানতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে এসপিএল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু করে। তাই এটি বাংলাদেশের দুজন ব্যক্তির মালিকানাধীন কোনো সংস্থাকে প্রদান করার অভিযোগটি সত্য নয়। বস্তুত এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির (ডিওএজি–ডেভেলপমেন্ট অবজেকটিভ অ্যাসিস্ট্যান্টস অ্যাগ্রিমেন্ট) মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না।
উল্লেখ্য, ইউএসএআইডির প্রকল্পের ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক। এতে আর্থিক নিরীক্ষার প্রক্রিয়াটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পরও এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়। প্রয়োজনে পুনর্নিরীক্ষা করা হয়।
ঢাকা/এনএইচ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ট র ম প র প রথম ম য় দ ইউএসএআইড র প রকল প র র প রকল প র জন ত ক ন বন ধ ত
এছাড়াও পড়ুন:
পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়া: কী দেখছেন আর কী বিশ্বাস করছেন?
সেদিন একজনের সঙ্গে আলাপ চলছিল। ধার্মিক মানুষ তিনি। ট্রাম্প প্রসঙ্গে এ–কথা সে–কথায় হঠাৎ বললেন, দেখেন, গাজায় ইউএসএআইডির মাধ্যমে ৫০ মিলিয়ন ডলারের কনডম পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের জন্মনিয়ন্ত্রণ। তারা যাতে সংখ্যায় না বাড়ে, যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
তাঁর সঙ্গে আরও দু–একজন যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও তাল মেলালেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটি ভুল পাঠ। তিনি প্রমাণ দেখালেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিত উন্মুক্ত ব্রিফিংয়ে বলেছেন ৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কনডম পাঠানোর কথা।
বললাম, জানি, এবং নিজেও ব্রিফিং দেখেছি। ৫০ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটিই মিথ্যা। তাঁরাও মিথ্যা বলেন। পেছনের উদ্দেশ্য পরে বলব, বুঝবেন। আমার হাতেও প্রমাণ আছে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে এই খাতে এক ডলার দেওয়া হয়নি। ২০২৩ সালে মাত্র ৪৬ হাজার ডলার বরাদ্দ ছিল। তা–ও জর্ডান এবং পশ্চিম তীরের অগণিত অসংখ্য মানুষ, বিশেষত চালচুলোহীন শরণার্থীদের জন্য। সেগুলো কনডমও নয়, জন্মনিয়ন্ত্রণের ইনজেকশন এবং প্রোজেস্টিন-নির্ভর বড়ি। খুবই দরকারি ছিল মা ও শিশুর জীবন রক্ষার জন্য।
একদিকে অসুস্থ অপুষ্ট মায়েদের সন্তান ধারণে জীবনাশঙ্কা; অন্যদিকে আরও অপুষ্ট, অসুস্থ, বিকলাঙ্গ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা। ফলাফল, বিভীষিকাময় জীবন-যন্ত্রণা। সন্তানদের সুস্থ-সুন্দর, মানবিক ও স্বাভাবিক জীবন দিতে না পারা। আগে কনডম দেওয়া হতো এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়াসহ নানা রকম চর্ম ও যৌনব্যাধির মহামারি রোধ করার জন্য। এই সময়ে এসে এইডসবিরোধী জনসচেতনতা বেড়েছে। ওষুধ-চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে। ফলে মহামারির প্রকোপ কমেছে। তাই কনডম বিতরণের দরকারটিও কমেছে।
যাঁদের বুঝিয়ে বলছিলাম, তাঁরা বুঝতে চাইছেন মনে হলো না। উল্টো নমনীয় ভাষায় ইঙ্গিত করলেন আমি সম্ভবত এনজিওপন্থী বা ইউএসএআইডির সুবিধাভোগী বলে এসব কথাবার্তা বলছি। জানালাম শিক্ষকতার বাইরে আমি অন্য কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টও নই, সত্য বলতে দ্বিধান্বিতও নই।
হঠাৎই মনে হলো ইউটিউবে কোনো একজন ইসলামি বক্তার ওয়াজেও এ ধরনের অদ্ভুত জনমিতি-জ্ঞানবহির্ভূত ধারণা প্রচার দেখেছিলাম। সেই সময়ও ভাবছিলাম, আমাদের হাতে হাতে মুঠোফোনে-ট্যাবে তথ্যের মহাসমুদ্রে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। কিন্তু তথ্যকে কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়, কজনই–বা জানি! আম-মার্কিনদের এক বড় অংশও জানে না। আলাপি ভদ্রলোকের আদলে তারাও বিশ্বাস করে, তৃতীয় বিশ্ব টিকেই আছে মার্কিন দান-খয়রাতের কারণে।
সত্য-উত্তর যুগ বা পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়ার ছল বোঝা আসলেই দরকার। একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সাংবাদিকদের মতো খোঁচাখুঁচিপ্রবণ মানুষদের সামনে বসিয়ে চোখে চোখ রেখে নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলতে পারছেন কেন? কারণ, নির্জলা মিথ্যাকে বিশ্বাস করার মতো সহজ–সরল মানুষের সংখ্যা চিরকালই অগণিত। তাঁরা আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। তারা বিশ্বাসও করবে, সম্মতিও উৎপাদন করবে এভাবে—না, না, আমাদের কষ্টের টাকায় ট্যাক্স দিই, সেই টাকা অন্য দেশে অকাজে খরচ করা যাবে না।
ট্রাম্পের ঘোষণায় বিদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সাহায্য–সহযোগিতা বন্ধ হয়ে গেছে। ইউএসএআইডিতে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। ট্রাম্পের অন্যতম অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক ইলন মাস্ক বলেই বসেছেন, সংস্থাটি অপরাধী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় হয়েছে এটি বন্ধ করে দেওয়ার।
আসলে খলের ছলের অভাব হয় না। ঈশপের গল্পের নেকড়ের ছুঁতো খোঁজার মতো একটি বড়সড় ছুঁতো দরকার ছিল। আগে ইউএসএআইডি যেভাবে ও যত রকম উপায়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার কাজে লাগত, এখন সেসব উপায়ের সব বিকল্প মিলে গেছে। ফলে সংস্থাটি না থাকলেও কিছু মার্কিন স্বার্থের কিছু যাবে আসবে না।
ইউএসএআইডির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাই ছিল তৃতীয় বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহায়তার মাধ্যম। কেন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন ডলার খরচ করত অন্যের দেশের উন্নয়নে? একেবারেই নিঃস্বার্থভাবে দান-দক্ষিণার মাধ্যমে সওয়াব কামানোর জন্য? উত্তর ‘না’। তৃতীয় বিশ্বে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর জন্য? উত্তর, মোটেই না। আসলে এটা ছিল একধরনের ‘উইন-উইন’ বন্দোবস্ত। দুই পক্ষেরই যাতে লাভ হয়, সে রকম ব্যবস্থা। ব্যয় বরাদ্দের বড় অংশই আবার স্বদেশে ফেরত যেত মার্কিন কর্মকর্তা-কর্মচারী-পরামর্শকদের বেতন–ভাতা আকারে। মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থান হতো।
ইউএসএআইডির কার্যক্রমের কারণে সহায়তা পাওয়া দেশগুলোর সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পররাষ্ট্রনীতি—এককথায় সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব ও মুখাপেক্ষী হয়ে উঠত। গরিব দেশগুলোও সমানভাবে লাভবান হতো। দূরদূরান্তরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সক্ষমতার অভাবটুকু ঘুচে যেতে মার্কিন উন্নয়ন-সহযোগিতার মাধ্যমে।
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লাভ কী ছিল? লাভ অসংখ্য। এই স্বল্প পরিসরে শুধু মুখ্য এক-দুটি বিষয় আলাপ সম্ভব। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত বিশ্বময় রাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধে মোকাবিলা। পঞ্চাশের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়ছিল নানা দেশ। দেশগুলো যাতে সমাজতান্ত্রিক বলয়ে ঢুকে পড়তে না পারে, সে জন্য সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল প্রথম উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহায়তাই ছিল সেরা মারণাস্ত্র।
নব্বইয়ে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দরকারটি মিইয়ে গেল। কিন্তু হুট করেই সাহায্য–সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া যাচ্ছিল না অনেক কারণে। বাজারে নব্য-উদার তত্ত্ব ছাড়া হলো ‘উন্মুক্ত বাজার’ অর্থনীতির। ‘প্রতিযোগিতায় আসো, নিজের পায়ে দাঁড়াও, নিজ সক্ষমতা বাড়াও, বাজার খুলে দাও’ তত্ত্ব। এদিকে আরও কয়েক বছর বা দশক অপেক্ষা করে দেখা দরকার ছিল সমাজতন্ত্রী ভাবধারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কি না। আস্তে আস্তে নিশ্চিত হওয়া গেল সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। চীনও নামেই সমাজতন্ত্রী, আদতে বাজার-অর্থনীতিমুখো।
তবু ইতিমধ্যে অসংখ্য দেশের সঙ্গে কয়েক দশকের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ও উন্নয়ন-সহযোগিতার সম্পর্ক ডালপালা শিকড় ছড়িয়ে এতটাই শক্তপোক্ত হয়েছে যে চাইলেই হুট করে পিঠ দেখিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। হুটহাট উন্নয়ন-সহায়তা তুলে নিলে অবন্ধুসুলভ, অকূটনৈতিক এবং অভব্য অশোভন আচরণের মতোও দেখাত। তা ছাড়া অর্থনীতিতে চমক জাগানো দৌড়ে ছুটে চলছিল জাপান ও চীন। তারা নতুন ধরনের উন্নয়ন-সহযোগিতা দিতে উদার হাতে এগিয়ে আসছিল। কয়েক দশক পর এখন যেহেতু নিশ্চিত হওয়াই গেছে সমাজতন্ত্রও আর হুমকি নয়, চীন-জাপানের উন্নয়ন-সহযোগিতাও সমস্যা নয়, উন্নয়ন-সহায়তা বন্ধ করাই যেতে পারে।
আসলে তার চেয়েও বড় একটি উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের তথ্যভান্ডারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’ ধরনের অবস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। প্রয়োজন ছিল সারা বিশ্বের গ্রামগঞ্জের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, শক্তি ও সামর্থ্যের ধরন, দুর্বলতা ও পশ্চাৎপদতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণী তথ্য জেনে ও সংরক্ষণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ রাখা। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকালে এবং আগে-পরে নানা রকম গবেষণা, প্রশিক্ষণ, নিয়মিত মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণযজ্ঞ চলত। প্রতিবেদন হতো। প্রতিবেদনগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের আনাচ-কানাচ বিষয়ক তথ্যের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য দিত।
তথ্য যার, ক্ষমতাও তার। মার্কিন পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্ত ও নীতি নির্ধারণেও কাজে লাগত প্রতিবেদনগুলো। তাই উন্নয়ন সহায়তার নামে সশরীর জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিটি সেকেলে ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। জিপিএস, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, এআই ইত্যাদি প্রযুক্তির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যে বলীয়ান মার্কিন প্রশাসনের জন্য তথ্য পেতে এখন কি-বোর্ডের কয়েকটি খোঁচাই যথেষ্ট। সরাসরি লোকবল অর্থবল বিনিয়োগই বরং অপচয়।
আমার সঙ্গে বাহাসে নামা দুজন যেমন এই সুগভীর প্রেক্ষাপটটি বুঝতে চাননি, আম-মার্কিনরাও তেমনি বুঝতে চায় না। সত্য-উত্তরকালের ভয়াবহ বিপদটি এখানেই। তথ্যসমুদ্রে ছুড়ে দিয়ে যে কাউকেই দিকহারা করে দেওয়া যায়। এভাবেই মার্কিনদের বড় অংশকেও সহজেই বিশ্বাস করানো গেছে এত দিন উন্নয়নশীল দুনিয়া টিকে ছিলে তাদের করের টাকায়।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়