ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জেডি ভ্যান্সের মৌখিক আক্রমণ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখটিকে আমেরিকা ও বিশ্ব ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করবে।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত তার সুনাম নষ্ট করছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর একনায়কদের পেছনে ফেলে দেশটির বর্তমান নেতা আরও বড় একনায়ক হয়ে উঠছেন। ইতিমধ্যেই ট্রাম্প-ভ্যান্স আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা ও খ্যাতির যে ক্ষতি করেছেন, তা পুনরুদ্ধার করতে দেশটির কয়েক দশক লেগে যেতে পারে—এমনকি সে ক্ষতি আর কখনো পূরণ না–ও হতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা এখন বৈশ্বিক কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ পতন দেখতে পাচ্ছি। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাওয়া বিদ্রোহী দেশগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থায় ইউরোপকে এগিয়ে আসতে হবে এবং একসময় যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা পালন করত, সেই ভূমিকা ইউরোপকে নিতে হবে। আর এর শুরুটা হতে হবে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে; বিশেষ করে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখন ইউরোপকে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে।

হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, সামরিক দিক থেকে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর নয়। তাই বলে ইউরোপকে একেবারে দুর্বল বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগও নেই।

আদতে ইউরোপের হাতে তার প্রয়োজনীয় সব শক্তি ও সক্ষমতা রয়েছে। তার সম্মিলিত সামরিক বাহিনী বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী, অভিজ্ঞ ও উদ্ভাবনী বাহিনী।

ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও ভ্যান্স ইচ্ছাকৃতভাবে যে ঝগড়া উসকে দিয়েছেন, তা ইউরোপের জন্য দীর্ঘদিনের আলসেমি ও নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠার চূড়ান্ত প্রেরণা হওয়া উচিত।

শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য, ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য এবং রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য যা যা দরকার, তার সবই ইউরোপের কাছে আছে।

ট্রাম্পের অগ্রহণযোগ্য আচরণের কারণে আমেরিকার সবচেয়ে কাছের মিত্ররা (যেমন ব্রিটেন) এখন ইউরোপের দিকে বেশি ঝুঁকছে। এটি ব্রেক্সিটের পর ইউরোপে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল (যেমন ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যকার তিক্ততা), তা কমাতে সাহায্য করছে। একদিকে এটি ইউরোপে গণতন্ত্র ও একত্র হওয়ার পক্ষে শক্তিগুলোকে নতুন করে প্রেরণা দিচ্ছে; অন্যদিকে রাজনীতির উচ্চপর্যায়ের নেতারা (যাঁরা হয়তো আগে বাস্তবতা এড়িয়ে চলতেন) এখন পরিস্থিতি মেনে নিতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

শিগগিরই জার্মানিতে একটি মধ্যপন্থী দুই–দলীয় জোট সরকার গঠিত হতে পারে এবং অস্ট্রিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি সরকার আসতে পারে। কঠিন একটি বছর পার করার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আবারও জনপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছেন।

ইউরোপে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ আছে। আর এর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সমান শক্তিশালী। ইউরোপ হয়তো উদ্ভাবনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে, কিন্তু সেই ব্যবধান ততটা বড় নয়, যতটা বলা হয়ে থাকে। যদি আমরা জাপান, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মিলে কাজ করি, তাহলে দ্রুত এই ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষ করে এখন এটি জরুরি; কেননা ট্রাম্প, ভ্যান্স ও ইলন মাস্ক নিজেরাই যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির মূল ভিত্তিগুলো নষ্ট করে দিচ্ছেন।

এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক বাড়িয়ে আমেরিকানদের নিত্যপণ্যের দাম তথা থাকা–খাওয়া ও চলাফেরার খরচ বাড়াচ্ছে। অভিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করলেও ট্রাম্প এখন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইউরোপের এখন এই সুযোগকে কাজে লাগানো উচিত এবং বিশ্বের সেরা মেধাবীদের স্বাগত জানানো উচিত। বিশেষ করে যাঁরা এখন আমেরিকার সরকারি সংস্থা থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন, তাঁদের সম্মানের সঙ্গে ডেকে আনা উচিত।

প্রতিরক্ষার দিক থেকে জার্মানির শিল্প খাত ইউরোপের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র তৈরি করতে যথেষ্ট সক্ষম। আর ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক শক্তি সহজেই আমেরিকার জায়গা নিতে পারে। ইউরোপের পাঁচটি বড় দেশে ও যুক্তরাজ্যে এখন দায়িত্বশীল ও স্থিতিশীল সরকার রয়েছে। এটি ওয়াশিংটনের বর্তমান নেতৃত্বের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। পোল্যান্ডের সামনে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ এসেছে।

মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনে আমি অনেক মার্কিন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের মধ্যে সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতো লোকও ছিলেন, যাঁরা ট্রাম্পের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। আমি তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব লক্ষ করেছি। নিজেদের বিবেচনা থেকে উঠে আসা যৌক্তিক মতপ্রকাশের বদলে তাঁরা আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে ‘ডিয়ার লিডার’-এর কথার অন্ধ অনুবর্তী হয়েছেন। এটি খুব অস্বস্তিকর ছিল।

ট্রাম্প প্রশাসনের ইউক্রেন দূত কিথ কেলগকে পর্দার আড়ালে ইউরোপের দিক থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আমাদের কি এখনো জোট আছে?’ জবাবে তিনি নির্বিকারভাবে নিজেই স্বীকার করলেন, তিনি আসলে কিছু জানেন না। কারণ, ওয়াশিংটনে এখন সব ক্ষমতা ট্রাম্পের হাতে কেন্দ্রীভূত। সেখানে আর কোনো ‘বিচক্ষণ ব্যক্তি’ অবশিষ্ট নেই। সেখানে কেবল চাটুকার তোতাপাখিরা রয়েছেন।

ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার যথার্থই বলেছেন, আমেরিকা কী ভাবছে সেটি নয়, বরং ইউরোপ কী করতে পারে, সেটিই ২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়। ট্রাম্পের নীতি (যদিও এটাকে নীতি বলা ঠিক হবে কি না কে জানে) শুধু অল্প সময়ের জন্য কাজে দেবে; কারণ, এখন কেউ আমেরিকার বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে আমেরিকার সরকারের ভাঙন, অকারণ শুল্ক আর মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া মারাত্মক ক্ষতি করবে।

সব মিলিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করার এখনই সময়। জেলেনস্কির সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা লজ্জাজনক। রাশিয়া এটি খুশি হয়ে দেখেছে।

যদি জেলেনস্কি চাপের কাছে নত হতেন, তাহলেও ইউক্রেনের জন্য ভালো কিছু হতো না। কারণ, আমেরিকা এখন যা করেছে, তাতে বোঝা যায় তারা কার পক্ষে।

ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ইউক্রেনের ওপর ‘ক্রিটিক্যাল মিনারেলস’ নামে একটি চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিলেন। চুক্তিটির প্রথম খসড়া মাফিয়াদের জোরজুলুমের মতো ছিল। জেলেনস্কি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তাঁরা নতুন চুক্তি এনেছিলেন, যা কিনা আগের খসড়ার চেয়ে কিছুটা সম্মানজনক ছিল। আমি অবাক হব না, যদি ট্রাম্প ও ভ্যান্সের ঘৃণ্য আচরণ আমেরিকান জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু ইউরোপীয়দের সেই অবস্থার জন্য অপেক্ষা করা কোনো বিকল্প হতে পারে না।

ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসায় আমেরিকানদের এখন নিজেদেরই এত বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে যে তাদের অন্যদিকে নজর দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই ইউরোপীয়দেরই এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে নিতে হবে।

স্লাভমির সিয়েরাকোভস্কি ক্রিতিকা পোলিটিচনা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক র ইউর প র ইউক র ন র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি

প্রতিবছর সারা বিশ্বে ১ মার্চ আন্তর্জাতিক বৈষম্যবিহীন দিবস হিসেবে পালিত হয়। অর্থাৎ সেদিন নতুন করে উচ্চারিত হয় যে সারা বিশ্ব যেন শূন্য-বৈষম্যের বিশ্ব হয়। অসমতা বা বৈষম্যের আলোচনায় বারবার উঠে আসে অর্থনৈতিক অসমতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য। তাই আয়ের বৈষম্য কিংবা সম্পদের অসমতা নিয়ে সবাই সোচ্চার।

একইভাবে, ফলাফলের অসমতা নিয়ে যত কথা হয়, সুযোগের বৈষম্য নিয়ে তত কথা হয় না। অসমতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অঙ্গনে প্রতিফলিত হতে পারে—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক অঙ্গনে। বৈষম্য ঘটে ঘরে, বাইরে, দেশজ পরিপ্রেক্ষিতে, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে অসমতা কিংবা বৈষম্য শুধু শুদ্ধ অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, এর একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রিকতাও আছে। আসলে বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক ন্যায্যতার দলন ও অন্যায্য পক্ষপাত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বৈষম্য অত্যন্ত গভীর—সত্যটি অতীত ও নিকট অতীতে বারবারই পরিলক্ষিত হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্কের জায়গাটি সরকারি দল কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে দখল করে রাখে ও বিরোধী দলের সব কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত হয়। প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না এবং সেই জায়গায় সরকারি দল একচ্ছত্রভাবে বিরাজ করে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে যেকোনো রকমের বিকল্প মতকে শায়েস্তা করেছে ক্ষমতাসীন দল। জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা, অন্যান্য পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।

ভিন্নতর মত, অন্য রকমের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনোরকমের সমালোচনাই সহ্য করা হতো না।
দেশের নীতিমালা নির্ধারণে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেখানে বিত্ত ও ক্ষমতার পক্ষপাত ছিল সুস্পষ্ট। দরিদ্র, প্রান্তিক গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাশা এবং চাওয়া-পাওয়া কখনো ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।

নানান সময়ে লোকদেখানো অংশগ্রহণমূলক আলাপ-আলোচনার একটা ভাব তৈরী করা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর কোনো জন–অংশগ্রহণ ছিল না। নারী জনগোষ্ঠী নানান সময়ে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু কখনোই তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

দেশের যে জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক অঙ্গনের কণ্ঠস্বরের ক্ষেত্রে প্রান্তিক সীমায় রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা হচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। তাঁদের আমরা সব সময় দেশের ভবিষ্যৎ করে রেখে দিয়েছি, তাঁদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি। তরুণ সমাজের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতাকে আমাদের সমাজ বিবর্তন ও সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারিনি। তরুণ-শক্তির এ অপচয় বৈষম্যের এক বিশাল নেতিবাচক ফলাফল।

সামাজিক দিক থেকে ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, আশরাফ-আতরাফের বৈষম্য আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত। তারা বঞ্চিত সম্পদে, ঋণ সুবিধায়, তথ্যপ্রযুক্তি সেবায়। এ কারণে কর্মনিয়োজন ও আয়ের দিক থেকেও তারা বঞ্চণার শিকার হয়।

পরিবেশ-নাজুক অঞ্চলে যেসব প্রান্তিক মানুষের বাস, তাঁরাও ক্রমবর্ধমান অসমতার শিকার হন। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যকার নিম্নবর্ণের মানুষেরা এবং আশরাফ-আতরাফদের মধ্যে আতরাফেরা সামাজিক বৈষম্যমূলক একটি স্থানে অবস্থান করেন। সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে নগর ও পল্লির মধ্যকার বৈষম্যের কথা সুবিদিত।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে।

সমাজ অঙ্গনে ধর্মীয় বৈষম্যের কথা বারবার নানান আলোচনায় উঠে এসেছে। নানান সময়ে নানান ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাহত করার অভিযোগও উঠেছে। এসবই বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ, ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিকেরই সমান অধিকার।

সামাজিক অঙ্গনে অসমতা শুধু সামষ্টিক পর্যায়েই বিরাজ করে না, একধরনের বৈষম্য ব্যষ্টিক ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। যেমন পরিবারের মধ্যে নারীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, খাদ্যগ্রহণ, মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আর্থিক স্বাবলম্বনের ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্যণীয় বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। বয়োকনিষ্ঠদের মতামতও পরিবারের মধ্যে উপেক্ষিত হয়। কর্মক্ষেত্রেও ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে নানান মাত্রিকতার বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়।

সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বহু বৈষম্য লক্ষণীয়। নগর সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র ও সরকার প্রায়ই যতটা উদ্‌গ্রীব থাকে, গ্রামীণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহ অনেক সময়ে ততটা পরিলক্ষিত হয় না। বহু ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিল্প ও সংস্কৃতিকে মূল ধারায় প্রবিষ্ট করার জন্য একটি অনধিকার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তেমনিভাবে যেসব অঞ্চলে

এসব গোষ্ঠী বসবাস করে থাকে, সেখানকার শিক্ষালয়ে শিক্ষা প্রদান সেসব গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় না হয়ে বাংলা মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এ–ও লক্ষ করা গেছে যে ওই সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রীয় সাহায্য, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। এসব মিলিয়েই একটি সাংস্কৃতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একটি সমাজকে সমৃদ্ধ ও বেগবান করে।

বাংলাদেশের সমাজে মানসিক বৈষম্যের কথাও বহুজন বলেছেন। আমাদের সমাজে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধীগোষ্ঠীকে হীন বলে মনে করা হয় এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। তাদের অবস্থাকে আমরা সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে দেখি না, তাদের বিষয়গুলো আমরা সঠিকভাবে বিবেচনা করি না।

তেমনিভাবে মানুষের প্রতি আচরণে আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করি। আমরা বহু সময়ে মানুষের ন্যূনতম সম্মানটুকু মানুষকে দিই না, যদি সেই মানুষটি হয় দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ। এটাও মানসিক বৈষম্যের একটি মাত্রিকতা।

একটি সমাজের অর্থনৈতিক অসমতাও শুধু একটি শুদ্ধ অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, অসমতা সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসলে, সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক পরস্পর পরস্পরকে জোরালো করে। অর্থনৈতিক সম্পদের ভিন্নতা সমাজে ধনী এবং দরিদ্র্য এ প্রান্তিক মানুষের এই অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বিত্তবান ও ক্ষমতাশীল মানুষদের আরও বিত্ত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

এই প্রক্রিয়ায় পুরো ব্যাপারটিই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ী একটি স্থান করে নেয়, যার ফলে রাষ্ট্র নিজেই একটি স্বার্থান্বেষী মহলে পরিণত হয়। এর ফলে, দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারা রাজনৈতিক বলয়ে, সামাজিক গতিময়তায় এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় আরও বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়ে। এমনকি আইনের চোখেও তারা সুবিচার পায় না।

সুতরাং এ অবস্থায় মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায্যতা বিষয়টি শুধু কথার কথায় পর্যবসিত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন অসমতা মানবাধিকার ও মানব–মর্যাদার পরিপন্থী।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষকে একটি জায়গায় বড় সুযোগ দিত হবে, তাঁরা বলবেন কোন কোন অর্থনৈতিক অসমতার প্রতিকার তাঁরা চান। এটা বলার জায়গা ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের থাকতে হবে। আসলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শুধু যে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে অসমতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণকেও তাঁরা প্রভাবিত করতে পারবে।

যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক সেবার বলয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যে শুধু এসব সেবার প্রসারণ ঘটাবে তা–ই নয়, সেই সঙ্গে এসব সেবা সুযোগের গুণগত মান যে ভালো হয়, তা নিশ্চিত করা যাবে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরাও উন্নতমানের সামাজিক সুযোগ পাবেন।

বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হলে, সেটার একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিত থাকতে হবে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের একটা দায়িত্ব থাকা প্রয়োজন। আমাদের চেতনায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে, আমাদের আচার-আচরণে, আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা প্রত্যেকে যদি সমতার প্রতি শ্রদ্ধাবান হই, তাহলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে সেটা একটি বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হতে হবে সমাজের কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রের কার্যক্রমে।

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউক্রেন-রাশিয়ার শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ কী?
  • আপনার আচরণ এমন হবে ভাবিনি: জামিলকে নূনা আফরোজ
  • সরকার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মর্মবস্তু ধারণ করতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে
  • ‘মাফিয়া বসদের মতো’ আচরণ করেছেন ট্রাম্প
  • ক্ষমতা অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় সরকার এড়াতে পারে না: টিআইবি
  • রিয়াল মাদ্রিদকে বড় অঙ্কের জরিমানা উয়েফার
  • গার্দিওলার সঙ্গে সমর্থকদের বাজে আচরণে জরিমানা রিয়ালের
  • তরুণদের আমরা দেশের বর্তমান হয়ে উঠতে দিইনি