আশির দশকে জাতীয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। এখন আরও কয়েকটি পত্রিকার পাঠক হলাম। আগের গুণীজন লেখকদের একজন তাঁর একটি নিবন্ধে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, আমাদের জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণ করা গেল না। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় জীবনের কর্মবীরদের আমরা যথাযথ সম্মানের আসনে বসাতে পারি না। আজও তা অপ্রাসঙ্গিক। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য দলের শীর্ষ নেতানেত্রীকে জানতে হয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে তাঁর অপরাপর যোগ্যদের সন্মান জানানোর সক্ষমতা থাকতে হয়। আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে অনেক সময় সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাবে উদারতার পরিচয় মেলে না। আর শীর্ষ নেতৃত্বের তৈল মর্দনকারী স্তাবকদের সদম্ভ উপস্থিতি এবং তাদের বাগাড়ম্বড়তা ও স্তুতির কারণে জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণের কাজটি পথ হারায়। যেমন বিগত সরকারের শাসনামলে শীর্ষনেত্রীর তৈল মর্দন করতে গিয়ে এক পণ্ডিতপ্রবর নেতার মুখে শোনা গেল শান্তিতে নোবেল প্রদানের বিষয়ে অমিয় বাণী।
আমাদের দেশে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসা বড় দুটি দল শীর্ষ নেতানেত্রীর স্তব গানে মশগুল থাকত অনেকে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, হাইকমান্ডের বাইরে অন্য নেতারা ও সেখানে অসহায়। ১/১১ এর পূর্বে দুই দলের পক্ষ থেকে জননেতা আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মুখনিঃসৃত বাণী উভয়ের অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের রিমোট কন্ট্রোল করার ইঙ্গিতপূর্ণ উক্তি। এমনিতর অবস্থায় চলে দলের শিষ্য নেতৃত্বের খুশি করার প্রতিযোগিতা। আরও চলে মাত্রাতিরিক্ত মুজিব ও জিয়া বন্দনা।
ক্ষমতাসীন হলেও একটি দলের নেতাকর্মীর সমর্থক সর্বোচ্চ শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। বাদবাকিরা তো আমজনতা। তারা ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ডকে করে সদা অবলোকন, তাদের নির্মোহ মূল্যায়ন মনে হতে পারে অস্বস্তিকর। সেদিকে কর্ণপাত করে নাকো কোনো দলাসক্ত দলান্ধ জন। গত বছর প্রায় এক মাস আমার কলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলে সেখানে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাস, বিধান রায় চৌধুরী, সুভাষ চন্দ্রসহ সরাই বিরাজে। সুভাষ চন্দ্র বসুসহ বিপ্লবীদের কে তারা বেশি করে মনে রেখেছে যারা ব্রিটিশ বিতাড়নে আত্মাহুতি দিয়েছে।
একালে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, যার পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শিক সংঘাত ছিল। নাথুরাম গডসে ছিলেন তাদেরই একজন, মুসলমানদের প্রতি দুর্বলতা ও নমনীয়তার অভিযোগে তাঁকে হত্যা করে। আজ কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপি ক্ষমতায় এসে সর্বভারতীয় ওই নেতাকে জাতির জনকের সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। বিজেপি আবদুল কালামকে রাষ্ট্রপতি বানাতেও বিরোধিতা করেনি। জাতির স্বার্থে জাতীয় জীবনের অগ্রদূতদের সম্মান দানে তারা একাট্টা। আমাদের পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা যাকে ভারতবর্ষ মিত্রভাবে তাঁর প্রশ্নে তারা সর্বদলীয় সভা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারল তারা নিজ স্বার্থেই হয়তো সে কাজটি করল। কিন্তু স্বজাতির স্বার্থে সে ক্ষেত্রে আজ আমরা কোথায়? এত প্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যাহোক মহাত্মা গান্ধী স্বাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়তে চেয়েছেন, মুসলমানদের স্বার্থে উচ্চকিত হয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণ না করে হয়তো বিতর্কিত হননি অবিকৃত থেকেছেন। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বলেই হয়তো বিতর্কিত হয়েছেন। তাই বলে কি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, সংগঠক ও স্থপতি হিসেবে উভয় নেতাকে কী অস্বীকার করা যায় বা তাদের নাম কখনও মুছে ফেলার অপচেষ্টা কী সমীচীন হয়?
শেখ মুজিবুর রহমান যাদের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন, যারা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দীক্ষাগুরু ছিলেন যাদের দেখানো পথে তিনি অগ্রসর হলেন সেই মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হককে জাতি ভুলে থাকে কী করে? শেরেবাংলা সেকালে কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র, ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। তেমনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত ডেপুটি মেয়র, ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার তিনিও ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে আমরা জানি তিনিও রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেননি। তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলেও তিনি পদ ও ঢাকাতে একটি প্লট গ্রহণ করেননি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তাদের জীবন ও কর্মকে ভুলে থাকা আত্মপ্রবঞ্চনা ।
তাদের গঠিত দল ক্ষমতায় থাকলেও পরিবারতন্ত্র সেখানে প্রবল হওয়ায় তারা অপ্রস্তুত হয়েছেন, ক্ষমতাসীন দলের শিষ্য নেতৃত্বের পূর্বপুরুষরাই কেবল সমাদৃত হয়েছেন। বেঁচে থাকলে এমন স্তুতিবাক্যের চর্বিত চর্বণে তারা হয়তো লজ্জা পেতেন। পরপারে থেকে তারাও হয়তো বিব্রতবোধ করে তাদের গুরুজনের সম্মান প্রত্যাশা করছেন। ভারত রাষ্ট্রটি এই মুহূর্তে আমাদের স্বার্থবিরোধী হতে পারে কিন্তু তাদের জাতীয় ঐক্যের চেতনা নয় ফেলনা। তাকে অবজ্ঞা করা চলে না। কাউকে অবহেলা নয়, যার যা প্রাপ্য সম্মান তাকে তা বুঝে দিয়ে আমরা জাতীয় চরিত্র করতে পারি বিনির্মাণ ।
মানবচিত্তের আনন্দ-বেদনা ও আশা-প্রত্যাশা যখন এক সঙ্গে কাজ করে, অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হয় তখন মানবজমিনে ভালো রকমের ফসল ফলে। ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাকে অতিক্রম করে জাতীয় স্বার্থে পরস্পরকে জয় করার বা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণের প্রসূতি। অর্থাৎ বহু মতপথের মানুষের ত্যাগ করা, অনৈক্যের মাঝে ঐক্য গড়ার সক্ষমতাই হতে পারে জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণ করে ইতিবাচক সমাজ গঠনের প্রাণশক্তি। আজ জাতির জীবনে সে কাজটিকে অনিবার্য মনে করি।
ড.
মো. মোস্তাফিজার রহমান: অধ্যক্ষ (অব.) নওগাঁ সরকারি কলেজ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ষমত স ন ক ষমত য আম দ র দল র শ আবদ ল গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
ধানের সরকারি দামে কৃষকের শঙ্কার মেঘ কাটছে না
‘এবার সেচের পানি, সার, বীজ, কীটনাশক ও ধান কাটার খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বর্গা চাষ করলে এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে ৩৫ টাকার বেশি। সরকার বলছে, আগের বছরের চেয়ে দাম বাড়িয়ে ৩৬ টাকায় কিনবে তারা। এই দরে বেচলেও তো আমাদের লোকসান হবে।’–এই দুঃখ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ধূল্যা গ্রামের চাষি রহমান আলীর।
শুধু রহমান আলী নন, এবারও ধান-চালের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে কৃষকের মনে জমা শঙ্কার মেঘ কাটছে না। কৃষি উপকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধানের দাম বাড়ার পরও কৃষক লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন। এবারের বোরো মৌসুমে খাদ্য মন্ত্রণালয় ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, তা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন কৃষক সংগঠন। গত বছর ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ টন। এবার তা সাড়ে ৩ লাখ টন। তবে সরকার ধান-চালের দাম গতবারের চেয়ে কেজিতে ৪ টাকা বাড়িয়েছে।
এর সমালোচনায় বলা হচ্ছে, এই দাম বৃদ্ধি কৃষককে বঞ্চিতই রাখবে, যথারীতি সুবিধা পাবেন মিলাররা।
অবশ্য সরকার বলছে, ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমলেও দাম বেড়েছে। এতে লাভবান হবেন কৃষক। আজ বৃহস্পতিবার থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে এই ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান।
প্রান্তিক চাষিরা বলছেন, দাম বাড়ালেও নানা শর্তের কারণে সরকারি গুদামে ধান দেওয়া যায় না। আর্দ্রতা পরীক্ষা, ব্যাংক হিসাব খোলা, গুদামে ধান দিয়ে আসাসহ নানা বিড়ম্বনার কারণে কৃষক মহাজনের কাছে ধান বিক্রি করেন। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ধান-চাল সংগ্রহ কম, আমদানি বেশি
দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা অটুট রেখে মজুত বাড়াতে প্রতিবছর স্থানীয় বাজার থেকে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। এই সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য সরাসরি কৃষকের পাশে দাঁড়ানো এবং ভোক্তাকে স্বস্তি দেওয়া। এই বোরো মৌসুমে ৩৬ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৩ লাখ টন ধান কেনা হবে। আর ৪৯ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল কেনা হবে ১৪ লাখ টন। গেল বোরো মৌসুমে ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল, ১ লাখ টন আতপ চাল এবং ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা ও সেদ্ধ চাল ৪৫ টাকা ছিল।
এবার আমন মৌসুমে সরকার ৫.৫০ লাখ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সংগ্রহ হয়েছে ৪.৩৫ লাখ টন। আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ৮৪ হাজার ৬১ টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ টন। চাল মূলত মিলাররা দেন।
ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩.৫০ লাখ টন। সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৬ হাজার ৭১৪ টন। বাজারদরের চেয়ে সরকার নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্য কম হওয়ায় আমন মৌসুমে খাদ্য অধিদপ্তর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি পূরণে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ৮ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য ঠিক করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৫.১৮ লাখ টন চাল আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, যার বেশির ভাগ এরই মধ্যে দেশে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে বছরে চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। উদ্বৃত্ত থাকার পরও চাল আমদানির কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা, পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল আমদানি করতে হয়।
ব্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে শুধু শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ২১ শতাংশ, ২০২০ সালে ৩৩ ও ২০২১ সালে ৫৪ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়।
সরকারকে ধান দিতে কৃষকের অনীহা
সেচ যন্ত্রের জ্বালানি ডিজেল ও বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি বেড়েছে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি। এতে বোরো ধান চাষে খরচও বাড়ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, বোরো ধানের উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে কৃষকের ধান ও চালের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কৃষক আবদুর রহমান বলেন, এবার বোরো ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো উৎপাদনে খরচ ছিল প্রায় ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এ বছর তা দাঁড়াবে ১৮ হাজারেরও বেশি।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার কৃষক মাহফুজুল হক বলেন, ‘হিসাব অত সোজা না। এই ধরেন, যদি আমি নিজের জমি চাষ করি, তা হইলে হিসাব এক রকম। আর যদি অন্যের জমি বর্গা নিই, তা হইলে খরচ আরও বেশি।’
ধান সংগ্রহে এখনকার পদ্ধতিতে কিছু অসংগতির কারণে কৃষক ভোগান্তিতে পড়ছেন। গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। তবে ব্যবসায়ীর কাছে ধান বিক্রিতে তেমন বেগ পেতে হয় না। সরকারি গুদামে ধান দিতে গেলে অনেক সময় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে দুই দফা পরিবহন খরচ হয়।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নের ভূঁইয়ার হাটের কৃষক দুলাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘সরকারের কাছে অ্যাপস ও ব্যাংকের মাধ্যমে ধান বেচতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। আর্দ্রতা পরীক্ষার নামে হয়রানি তো আছেই।’
চাল ও ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা আছে। এতে ১৫টি শর্ত দেওয়া আছে মিলার ও কৃষকদের জন্য। কুষ্টিয়ার আলামপুর এলাকার কৃষক এনামুল হক বলেন, গুদামে ধান নিয়ে গেলে আর্দ্রতা মাপা হয়। ভেজা হলে সেই ধান আবার শুকাতে হয়। এর পর ওজনে কম হলে আবার বাড়ি থেকে বাড়তি ধান এনে সেটা পূরণ করতে হয়। গাড়ি ভাড়া নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। আবার চেক নিয়ে ব্যাংকে যেতে হয়। সরকার যদি প্রতি ইউনিয়ন থেকে ধান কেনে, তাহলে ভালো হয়।
কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া এলাকার কৃষক রহিম মণ্ডল ও আবেদ আলী বলেন, মৌসুমের শুরুতেই প্রান্তিক কৃষক টাকার জন্য কম দামে ধান বিক্রি করেন। সেই ধান ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে মিল মালিকদের কাছে চলে যায়। কৃষকদের ঘরে যখন কোনো ধান থাকে না, তখন দাম বাড়তে থাকে। হাওরে এখন ধানের মণ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। এখন বড় বড় মিল মালিকরা কম দামের এসব ধান কিনে গুদাম বোঝাই করতে শুরু করেছেন।
কারা কী বলছেন
সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, চাল উৎপাদনে বোরোর অবস্থান শীর্ষে। অথচ এই মৌসুমে গত বছরের চেয়ে দেড় লাখ টন কম ধান সংগ্রহ করা হবে। এতে কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি না করে খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে আগ্রহী হবে। চালকল মালিকরা ধান কিনতে বাজারে আসার আগেই সরকার ব্যবস্থা না নিলে আগের মতো এবারও ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
গত ১২ এপ্রিল দেশের ৪৩ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, কৃষককে বঞ্চিত করে মিলারদের সুবিধা দিতে ধান সংগ্রহের পরিমাণ কমানো হয়েছে। ১৩ এপ্রিল সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, ধান-চাল কেনার এই সিদ্ধান্তে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারও যে অতীতের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেই পরিচালিত হচ্ছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
তবে খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, ধানের উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে ধান-চাল সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় সেই খরচ নিরূপণ করে। এবার চাল আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত। ধান কিনলে সেটা ভাঙানো ও মজুত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরের। ধানের দাম এবার ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে বলে জানান তিনি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানা]