পেঁয়াজ চাষের মাধ্যমে কৃষক যেভাবে উপকৃত হতে পারেন
Published: 3rd, March 2025 GMT
মানবসভ্যতার ইতিহাসে আদি যুগ থেকেই পেঁয়াজের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, রান্নায় যার বিকল্প নেই। খাবার তৈরিতে পেঁয়াজের জুড়ি নেই। পেঁয়াজ সাধারণত সরাসরি খাওয়া হয় না, বরং কুচি বা ফালি করে কাঁচা অবস্থায় সালাদ তৈরি অথবা রান্নায় উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজ বিভিন্ন রকমের হতে পারে– ঝাঁঝালো, মিষ্টি, তিতা। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রধান দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। তবে আমাদের দেশেও প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করা উত্তম।
উর্বর বেলে-দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য অতি উত্তম হয়। গ্রীষ্মে পেঁয়াজ চাষের জন্য উঁচু জমি দরকার, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না। জমিতে সেচ ও পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাই উপযুক্ত জমি ও মাটি নির্বাচন পেঁয়াজ চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে এখনও দেশি জাতের পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে বারি পেঁয়াজ-১ শীতকালীন, বারি পেঁয়াজ-২ গ্রীষ্মকালীন, বারি পেঁয়াজ-৩ গ্রীষ্মকালীন, বারি পেঁয়াজ-৪ শীতকালীন, বারি পেঁয়াজ-৫ গ্রীষ্মকালীন ও বারি পেঁয়াজ-৬ শীতকালীন নামে ৬টি জাতের পেঁয়াজ মুক্তায়িত রয়েছে বলে জানা যায়। এসব জাতের পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়। তাই কৃষকরা এসব জাতের পেঁয়াজ চাষ করতে পারেন।
স্থানীয় জাতের মধ্যে ভাতি, ঝিটকা, কৈলাসনগর উল্লেখযোগ্য। আগাম রবি মৌসুমে এ জাত দুটির ফলন দ্বিগুণ হয় এবং কন্দের মানও উন্নত হয়। উদ্ভাবিত ও উল্লিখিত পেঁয়াজের জাত দুটি উত্তরবঙ্গ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন উঁচু অঞ্চল, যশোর ও ফরিদপুরে ব্যবসায়িকভাবে চাষের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। হাইব্রিড পেঁয়াজের মধ্যে বর্তমানে লাল তীর, ফেরোমন, সুপ্রিম সিডসহ কয়েকটি কোম্পানি হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের বীজ মার্কেটিং করছে। অধিক ফলন পেতে এসব জাত কৃষকদের নজরে রয়েছে। এ জাতের পেঁয়াজের ফলন সাধারণত বেশি হয়।
পার্পল ব্লচ ব্লাইট রোগে পেঁয়াজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। যে কোনো বয়সে গাছের পাতা ও কাণ্ড আক্রান্ত হয়। অধিক আক্রমণে পেঁয়াজে ফুল আসে না ও ফসলের উৎপাদন কম হয়। আক্রান্ত বীজ বেশিদিন গুদামে রাখা যায় না, বাজারমূল্য কমে যায়। অল্টারনারিয়া পোরি ও স্টেমফাইলিয়াম বট্রাইওসাম নামে ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। এর কাণ্ডে প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানি ভেজা হালকা বেগুনি রঙের দাগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। দাগগুলো বৃদ্ধি পেয়ে বড় দাগে পরিণত হয় এবং আক্রান্ত স্থান খড়ের মতো হয়ে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা ক্রমান্বয়ে ওপরের দিক থেকে মরতে শুরু করে এবং পাতা বা কাণ্ডের গোড়ায় আক্রান্ত স্থানের দাগ বেড়ে হঠাৎ পাতা বা বীজবাহী কাণ্ড ভেঙে পড়ে। এতে বীজ অপুষ্ট হয় এবং ফলন কম হয়। বৃষ্টি হলে এ রোগ আরও দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত বীজ, গাছের পরিত্যক্ত অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। রোগ প্রতিরোধের জন্য সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে। ফসল পর্যায় অনুসরণ করা অর্থাৎ একই জমিতে পরপর কমপক্ষে চার বছর পেঁয়াজ চাষ না করা। পেঁয়াজ গাছের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ধ্বংস করতে হবে। প্রোভ্যাক্স বা অটোস্টিন (কার্বেন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল বা এন্ট্রাকল ২ গ্রাম বা ফলিকিউর (টেবুকোনাজল) ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। স্কেলরোসিয়াম রলফসি ও ফিউজারিয়াম নামে ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়। যে কোনো বয়সে গাছ এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। কন্দ ও শিকড়ে এর আক্রমণ হয়। আক্রান্ত কন্দে পচন ধরে এবং আক্রান্ত কন্দ গুদামজাত করে বেশি দিন রাখা যায় না।
আক্রান্ত গাছের পাতা হলদে হয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। টান দিলে আক্রান্ত গাছ খুব সহজে মাটি থেকে কন্দসহ উঠে আসে এবং আক্রান্ত স্থানে সাদা সাদা ছত্রাক ও বাদামি বর্ণের গোলাকার ছত্রাক গুটিকা (স্কেলরোসিয়াম) হয়। অধিক তাপ ও আর্দ্রতাপূর্ণ মাটিতে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ক্ষেতে সেচ দিলেও এ রোগ বৃদ্ধি পায়। এ রোগের জীবাণু মাটিতে বসবাস করে বিধায় সেচের পানির মাধ্যমে ও মাটিতে আন্তঃপরিচর্যার সময় কাজের হাতিয়ারের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার হয়। আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করতে হবে। মাটি সব সময় স্যাঁতসেঁতে রাখা যাবে না। আক্রান্ত জমিতে প্রতিবছর পেঁয়াজ-রসুন চাষ করা যাবে না। প্রোভ্যাক্স বা অটোস্টিন (কার্বেন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল বা এন্ট্রাকল ২ গ্রাম হারে বা ফলিকিউর (টেবুকোনাজল) ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পেঁয়াজ গাছ পরিপক্ব বা ওঠানোর উপযোগী হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলুদ হয়ে হেলে পড়ে। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ গাছের এ অবস্থা হলে পেঁয়াজ তোলার উপযোগী হবে। পেঁয়াজ গাছের ঘাড় বা অগ্রভাগ শুকিয়ে হলুদ বর্ণ বা নরম মনে হলে বুঝতে হবে যে পেঁয়াজের উত্তোলনের সময় হয়েছে। বীজ বপন থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত পেঁয়াজ চাষে ১১০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগতে পারে। বর্ষা মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন এবং রবি মৌসুমে ৪০-৫৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়, রবি মৌসুমে পেঁয়াজের পাতা মরে গেলে গলা চিকন হলে গাছসহ পেঁয়াজ তুলে এনে পাতা শুকিয়ে মরা পাতা কেটে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ফলন রবিতে ১২-১৬ টন ও খরিপ ১০-১২ টন। এতে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও সামান্য ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এটি উত্তেজক হিসেবে কাজ করে, শ্বাসনালির মিউকাস কমায়, হজমি নালার জ্বালা কমায়, রক্ত পরিশোধন করে, অ্যাজমা ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়, পোকার কামড়ে বিশুদ্ধ মধুসহ প্রলেপ দিলে জ্বালা কমায়, কাঁচা পেঁয়াজের রস চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং সঠিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারবে। তাই সতর্কতার সঙ্গে পেঁয়াজ চাষ করা উচিত।
ড.
বি এম শহীদুল ইসলাম: শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
যমুনা তীরের বালু বিক্রি ভাঙনের শঙ্কা
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে যমুনা নদীর তীরের বালু তুলে অবাধে বিক্রি করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এতে নদীতে পানি বাড়লে ওই সব এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে বলে এলাকাবাসীর শঙ্কা।
স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কাউকে তোয়াক্কা না করে নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে দিন-রাত এ বালু বিক্রি করছেন। এভাবে বালু বিক্রি করায় হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা ও নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নদী তীরবর্তী এলাকার কয়েকজন জানান, উপজেলার যমুনা তীরের রৌহা ও বাগুলি এলাকায় বালু তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। এ বালু বিক্রি করছেন লেবু শেখসহ ছয়-সাতজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু বিক্রি করলেও যেন দেখার কেউ নেই।
এলাকার আরিফ শেখ, হেলাল উদ্দিনসহ কয়েকজন জানান, বালু ব্যবসায়ীরা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে সাহস পান না। অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো ও হয়রানি করা হয়। এ ব্যাপারে স্থানীয়রা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শাহিনুর শেখ বলেন, এলাকার অনেককে ম্যানেজ করে নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রশাসন এলে বালু তোলা বন্ধ রাখতে হয়। প্রশাসন অভিযানে আসার আগেই তারা অগ্রিম সংবাদ পেয়ে থাকেন। এ কারণে তাদের তেমন ঝামেলা হয় না। সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য তারা কয়েকজন সাংবাদিককেও কিছু টাকা মাসোহারা দেন।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহসান আলম বলেন, অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রির বিষয়টি তাঁকে কেউ জানায়নি। নদী থেকে কেউ বালু বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে চার-পাঁচবার অভিযান চালিয়ে বালু তোলার ড্রেজার ও ড্রেজারের পাইপ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাদের অভিযান চলছে।