স্থানীয় সরকারের আদি ঐতিহ্য ফিরে আসুক
Published: 3rd, March 2025 GMT
স্থানীয় সরকার কাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক ঐক্য শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের বুনিয়াদি ক্ষেত্র। ক্ষেত্রটিকে একদিকে রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্য সামনে রেখে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ব্যবহার করেছে; অন্যদিকে ব্যুরোক্রেসি এটাকে তাদের অধীনে রেখে ক্ষমতা প্রয়োগ-প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে রাখে। এখানে রাজনৈতিক শক্তি ও বুরোক্রেসির একটি যৌথ আক্রমণ নিষ্পেষণ রয়েছে। আমলারা নিজেদের সরকারের মূল কারিগর মনে করে। তাদের এই ধারণা ব্রিটিশ সরকারই কয়েকশ বছর ধরে সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর রাজনৈতিক দল ও শক্তি তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে স্থানীয় সরকার কাঠামোকে বেছে নেয় ব্রিটিশ শাসনের মতোই। গণতান্ত্রিক স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ কাঠামোকে পুনরায় জাগরিত করে তাতে রাষ্ট্র কাঠামো যুক্ত করার কাজটি কোনো শাসকই আর করেনি। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারের জেনারেল আইয়ুব খান ‘বেসিক ডেমোক্রেসি অর্ডার’ আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটাধিকার প্রাপ্তির ক্ষমতা দিয়ে তাদের সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত করে। বাংলাদেশ গঠনের পর সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করার জন্য কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক’। চমৎকার বাক্যটি সংবিধানে সেভাবেই রয়ে গেছে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটি।
১৯৭৫ সালের পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান গঠন করেন গ্রাম সরকার। সেখানে ব্রিটিশ চৌকিদার মডেলে গ্রাম পুলিশ গঠন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা তাদের মূল দায়িত্ব। তারা জাতীয়তাবাদী দল গঠনে আসল দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ থানাগুলোকে উপজেলায় উন্নীত করে গঠন করেন উপজেলা পরিষদ। সেখানে একজন উপজেলা চেয়ারম্যান, যিনি সরাসরি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন– এমন বিধান রাখা হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চমৎকার ঘোষণা দিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আদালত গঠন করা হয়। আসল কাজ যেটা হয় সেটা হচ্ছে, নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানরা জাতীয় পার্টি গঠনে বড় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকার এটি বাতিল করে দেয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে পুনরায় উপজেলা পরিষদ ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দেন। নখদন্তহীন উপজেলা পরিষদ আবদ্ধ থাকে এমপি, ইউএনও আর জেলা প্রশাসকের হাতে। এমপি আর ইউএনওদের হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে নামমাত্র একজন উপজেলা চেয়ারম্যান করে একটি কার্যালয় প্রাপ্তি ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ ছিল না। এ শাসনে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নির্দলীয় চরিত্রটিও নিঃশেষ করে এটিকে দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্বাধীন সত্তার কফিনে শেষ পেরেকটি শেখ হাসিনা ঠুকে দেন।
মূলত স্থানীয় সরকার কাঠামোর কয়েকটি ক্ষেত্র। একটি গ্রামকেন্দ্রিক ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, নগরকেন্দ্রিক পৌরসভা, শহরকেন্দ্রিক সিটি করপোরেশন। এসব ক্ষেত্রকে প্রাথমিক স্তরে নির্দলীয় চরিত্রে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তরগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, নিরাপত্তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন, সুপেয় পানির সরবরাহ, পরিবেশ রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন, সামাজিক ঐকমত্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ এবং সংগৃহীত রাজস্বের বড় অংশ খরচ করার স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন। রাজস্ব আদায়ের স্বাধীনতা সিটি করপোরেশন এবং কিছু পৌরসভার থাকলেও অন্যান্য সেক্টরে নেই।
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার ব্যবস্থা করাও জরুরি। এবং ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিষয়ে স্থানীয় সরকার কাঠামোর সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বাধ্য– এমন আইন সৃষ্টি করা। কিছু ক্ষেত্র সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে রেখে দেওয়া, যেসব বিষয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে স্থানীয় সরকারের এই কাঠামোগুলো পালন করতে বাধ্য হয়– এমন আইন প্রণয়ন করা। যাতে সরকার ও স্থানীয় সরকার কাঠামো একটি ক্ষমতার ভাগাভাগি করে কাজ করতে সক্ষম হয়। জাতীয় সংসদের সদস্য স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে মূল সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এভাবে যদি ক্ষমতার ক্ষেত্রগুলোকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি করে একটি টিম গঠন করা যায় তাহলে এর সুফল হয়তো আসতে পারে।
স্থানীয় সরকার নিয়ে আমরা যখন এই আলোচনা করছি তখন আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচন– তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চাইছে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, আগস্ট গণআন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা ছাত্রনেতৃত্ব যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে এবং সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে সেই প্রতিনিধিদের নানা প্রলোভন, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের দলটির ভিত্তি তারা দাঁড় করিয়ে ফেলবে। এই সন্দেহের যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে একাধিকবার রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা গেছে।
আমরা চাইব আমাদের গণতান্ত্রিক, মূল্যবোধপূর্ণ, উদার, শান্তিবাদী সমাজ কাঠামোর যে আদি ঐতিহ্যের সংস্কৃতি, তার ভিত্তিতেই স্থানীয় সরকার কাঠামো গঠিত হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
রুস্তম আলী খোকন: লেখক ও সংগঠক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র স থ ন য় সরক র ক ঠ ম য় সরক র র ন উপজ ল ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গতকালের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ার কথা বোঝাতে চেয়েছি: জামায়াত নেতা তাহেরের বিবৃতি
ঢাকা সফররত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে গতকাল রোববার জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মিয়ানমারের আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের এলাকায় ‘ইনডিপেনডেন্ট আরাকান স্টেট’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বৈঠকের পর এ কথা জানিয়েছিলেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তবে আজ সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘আমি যে বক্তব্য দিয়েছি, তাতে মূলত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদভাবে তাঁদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করার ব্যবস্থা ও তাঁদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছি।’
গতকাল বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ১১ বা ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছে; তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের খাদ্য, কাপড় ইত্যাদি দেওয়া কোনো সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ও পুনর্বাসন করতে হবে। সে জন্য আমরা আরাকানকেন্দ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের এলাকায় “ইনডিপেনডেন্ট আরাকান স্টেট” করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
এ বিষয়ে আজ জামায়াতের প্রচার বিভাগের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠকের পর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এ সম্পর্কে যে ব্রিফিং দিয়েছেন, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে আজ বিবৃতি দিয়েছেন। এরপর উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ‘(গতকালের) ব্রিফিংয়ে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি, তাতে মূলত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদভাবে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করার ব্যবস্থা ও তাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছি। আমার বক্তব্যের মাধ্যমে কোনো ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে তা এই বিবৃতির মাধ্যমে নিরসন হবে বলে আশা করি। এটিই জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি।’