‘পরিবারে পাগলি (মানসিক প্রতিবন্ধী) মা ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমিই রান্না করে মাকে খাওয়াই। মানুষের জমিতে কাজ না করলে ভাত জোটে না। অথচ ওরা (আসামিরা) আমার চোখ নষ্ট করে দিছে, পায়ের রগ কাটি দিছে। তিন দিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়িতে আসি শুয়ে আছি। পেটে খাব কী, ওষুধই–বা কী দিয়ে কিনব?’

আজ সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের রাওতা গ্রামের মৃত আকবর আলীর ছেলে রুবেল হোসেন (৩০)।

মাদক চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় স্থানীয় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী গত বুধবার মধ্যরাতে রুবেল হোসেনকে একটি বইমেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যান। দুষ্কৃতকারীরা তাঁর ডান চোখে চাকু ঢুকিয়ে দেন এবং ডান পায়ে জখম করেন। ঘটনার পর থেকে তিনি ওই চোখে দেখতে পারছেন না।

এ ঘটনায় রোববার দুপুরে রুবেলের চাচা হাসান আলী বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে আশরাফুল ইসলাম নামের একজনকে আটক করে পুলিশে দিলে তাঁকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আজ দুপুরে রুবেল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ঘরের ভেতরে বয়স্ক কয়েকজন নারী রুবেলকে ঘিরে আর্তনাদ করছেন। তিনি নিজেও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। রুবেল জানান, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলির সঙ্গে লাগোয়া দুটি গ্রাম রাওতা ও নটাবাড়িয়া। এখানে মাদকের ছড়াছড়ি। মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এলাকাবাসীর সঙ্গে নটাবাড়িয়ার বাসিন্দা সাধু, মামুন, তারিকুল এবং মুলাডুলির বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম (২২), মো.

শিহাব (২০) ও চ্যাপা সজীবের (২১) বিরোধ আছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মুলাডুলি থেকে সাধুর বাড়িতে মাদক কিনতে এলে গ্রামবাসী তাঁদের ধাওয়া দেন এবং আশরাফুলকে মারধর করেন। এর জের ধরে তাঁরা রুবেল ও তাঁর চাচাতো ভাই সোহেলকে মারার হুমকি দেন।

রুবেল হোসেন বলেন, গত বুধবার তিনিসহ গ্রামের কিছু যুবক পাশের রাজাপুরের বইমেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যান। সেখানে রাত ১২টার কিছু পরে তারিকুল ও তাঁর সহযোগীরা তাঁকে একটি দোকানের পেছনে তুলে নিয়ে যান। তাঁরা রুবেলের ডান চোখে চাকু ঢুকিয়ে মণি উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। তবে ধস্তাধস্তির কারণে চোখের দুটি রগ কেটে যায়। এ সময় তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচে জখম করে রাস্তায় ফেলে রেখে যান।

রুবেলের ভগ্নিপতি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘রক্তাক্ত রুবেলকে আমি বৃহস্পতিবার ভোরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। ওই দিন তাঁর ডান চোখে অপারেশন করা হয়।’

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে আলমগীর বলেন, চোখের ভেতরের দুটি রগ কেটে গেছে। দুটি পাইপ লাগানো হয়েছে। এক মাস পর আবার অপারেশন করতে হবে। তখন চিকিৎসক বলবেন রুবেল আদৌ আর ওই চোখে দেখতে পারবেন কি না।

রুবেল হোসেনের হাসপাতালের প্রেসক্রিপশনে লেখা আছে ‘ডান চোখের ওপর আঘাত’। এ ছাড়া তিনি ‘ফিজিক্যাল অ্যাসল্টের’ কারণে ‘মাইনর হেড ইনজুরি’ নিয়ে ভর্তি ছিলেন বলে প্রেসক্রিপশনে লেখা আছে।

হামলার বিষয়ে কথা বলার জন্য অভিযুক্ত সাধু ও তারিকুলের মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার পর থেকে তাঁরা আত্মগোপন আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ও জরুরি বিভাগের ইনচার্জ শংকর কে বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি বিভাগের কাগজপত্র অনুসারে রুবেলকে গত বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার সন্ধ্যায় তাঁকে বাড়িতে পাঠানো হয়। তাঁর চোখের ও পায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলতে পারবেন। ১৫ দিন পর সেলাই কাটার জন্য রুবেলকে আবার হাসপাতালে আসতে হবে।

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবর রহমান বলেন, রুবেলের চোখে ও পায়ে গুরুতর আঘাতের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় আশরাফুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আশর ফ ল

এছাড়াও পড়ুন:

চারি দিকে দেখো চাহি

“এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
...
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও” (শঙ্খ ঘোষ/ চুপ করো, শব্দহীন হও)

১. চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি 
নৈঃশব্দ্যের কাছে আমার অনেক ঋণ, অনেক ভারমুক্তি, অনুতাপ আর অনুশোচনার সুকঠিন স্তর পেরিয়ে অনেকবার নতুন জীবন লাভ বা পুনর্জীবন প্রাপ্তি। অসংখ্য নির্জন মুহূর্তে শব্দহীন, নিস্তব্ধতার কাছে অস্থির-বিক্ষুব্ধ-সংক্ষুব্ধ সত্তাকে সমর্পিত করে দিয়ে লাভ করেছি এক ধরনের অমোঘ নির্বাণ। জাগতিক অথবা স্বর্গীয় দু’ভাবেই সেই নির্বাণের অস্তিত্ব অনুভব করেছি নিজের মধ্যে, নিজের মতো করে। নৈঃশব্দ্যের আড়াল ছাড়া সে নির্বাণ অর্জন সম্ভব নয়।
নিত্য জীবন যাপনের ক্লেদাক্ত গ্লানি আর অসংখ্য পার্থিব প্রবঞ্চনার পাক সেই নির্বাণের অস্তিত্বকে বারবার মলিন করে দিয়েছে, দিতে চেয়েছে। আবার আমি মন আর শরীর থেকে যাবতীয় অস্বস্তির ধুলা আর অসহায়ত্বের অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে নৈঃশব্দ্যের কাছে নিবেদন করেছি নিজের বলে যা কিছু আছে, তার সবটুকু। অব্যর্থভাবে ফের অর্জন করেছি একই রকম প্রশান্তি আর দৃঢ় শান্ত হৃদয় মন!
গেয়ে উঠেছি আপন মনে: “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,/ দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে…/ চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,/ ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি/ প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে।”
নৈঃশব্দ্যের কাছে আমার আজানু আত্মসমর্পণ আমাকে এভাবে এক অলৌকিক আনন্দের জোগান দেয়। দৈনন্দিনতার একঘেয়েমি আর ক্লান্তির মধ্যেই খুঁজে নিতে সাহায্য করে এক ক্ষুদ্র মানবজীবনের অপূর্ব সৌন্দর্য অনুধাবনের রসদ।
জীবনের নানা পর্যায়ে, বিভিন্ন জটিল/কঠিন/দুরূহ পরিস্থিতিতে নৈঃশব্দ্যের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে যে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, সেসব নিয়ে ভেবেছি অনেকবার। তবে এভাবে বলা হয়নি অকপট যে আমার মানসিক গঠন আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে নৈঃশব্দ্যের বোঝাপড়া চমৎকার। “সকল লোকের মাঝে ব’সে”, সকল কোলাহল উপেক্ষা করে, সকল হলাহল পান করে আমি নৈঃশব্দ্য নামক অমৃতরসে নিজেকে জারিত করে নিতে পারি। হয়ে উঠতে পারি নিজের কাছে নিজে গ্রহণযোগ্য, অবধারিত, নির্ভার।
এই শব্দহীন প্রবাহে জলতরঙ্গের সংগীত যে শুনতে পায়নি/ পায় না, তার কাছে এই বিশেষ মানসিক অবস্থার শব্দজাত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। শব্দের মারপ্যাঁচ আর ঝংকার দিয়ে নৈঃশব্দ্যের অনুরণন তোলা সম্ভব নয়। নৈঃশব্দ্যের সংগীত কেবল একান্ত অনুভবের বিষয়; চোখ বুজে কান পাতলে হৃদয়ের তন্ত্রে সেই অপূর্ব মূর্ছনা ছলকে ওঠে ঐন্দ্রজালিক বিহ্বলতায়!
২. সে আমার গোপন কথা, শুনে যাও সখী
তরুণ বয়সে কলেজের শিক্ষক বনে গেলাম। চাকরির হাড্ডাহাড্ডি পরীক্ষায় অন্য বয়স্ক/অভিজ্ঞ প্রার্থীদের টপকে। বিষয়টা সেই কলেজের শিক্ষকদের কারও কারও মনঃপূত হলো না। কারণ, চাকরিটা আমি এভাবে বাগিয়ে না নিলে আগে থেকে ওই কলেজে চাকরি করে এমন একজনের স্বামীর সেটি হতে পারত। মাঝখানে আমি বাগড়া দিলাম আর মাস্টারি শুরু করার আগেই কয়েকজনের চক্ষুশূলে পরিণত হলাম।
কলেজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনই পেলাম ঠান্ডা শীতল অভিবাদন। অল্প বয়স। স্বল্প অভিজ্ঞতা। শুধু বুঝলাম, সামনের দিনগুলো সুখকর হবে না। কিন্তু চাকরিটা তো আমাকে করতে হবে। টিকে থাকতে হবে এই অপরিচিত আনওয়েলকাম পরিবেশে, পরিস্থিতিতে।
কাজের দিনগুলিতে সাতসকালে দৌড়ে-হেঁটে-বাস ধরে-রিকশাভ্যানে চড়ে সময়মতো কলেজে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। 

মাঝে মাঝে দুয়েক মিনিট দেরি হয়ে গেলে শিক্ষক উপস্থিতির খাতায় লাল কালির আঁচড় পড়ে। তিন দিন বিলম্ব হলে নাকি এক দিনের বেতন কেটে নেওয়ার নিয়ম। এই কলেজে এতই কড়াকড়ি, নিয়মের বাড়াবাড়ি।
এ ধরনের আননারভিং কথা সদ্য যোগ দেওয়া আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সিনিয়র অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কেউ কেউ বলেন। বলে আমার ফরসা মুখটা লাল বা কালো বা বিবর্ণ হতে দেখে তাদের এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ হয়। শিশুদের নরম গাল টিপে বা হাতে চিমটি কেটে বড়রা যেমন মজা পায়, অনেকটা সে রকম। রূঢ় কর্কশ জীবনের চাবুকের আঘাত তখনও পিঠে পড়েনি। তবে অ্যাকটিভ ইনস্টিঙ্কট আর ইনটুইশন পাওয়ারের জোরে এসব কিছু কিছু বুঝতে/ধরতে পারি। মানুষের চেয়ে হৃদয়হীন প্রাণী তো আর দ্বিতীয়টি নেই। আবার, কেবল মানুষই নাকি হৃদয় নামক বস্তুটির একচ্ছত্র অধিকারী! চরম বিরোধিতাপূর্ণ অবস্থা আর কী!     
কলেজে ঢোকার পর থেকে ক্লাস নিতে থাকি একটার পর একটা। ক্লাস টেস্ট আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বানাই, খাতা দেখি, ক্লাসের বিরতিতে কলেজের কাছে ক্যান্টিনে গিয়ে চা-শিঙাড়া খাই। বেশির ভাগ সময় একদম একা একা। যদি না আগে থেকেই অন্য দুয়েকজন টিচার ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকেন। তখন তাদের সাথে পাশাপাশি বসতে হয়। তারা এর মধ্যে চা-শিঙাড়া সেরে ফেললেও জুনিয়র হিসেবে আরেকবার অফার করতে হয়। আর অন্য সময় ক্লাস না থাকলে টিচার্স কমন রুমের টেবিলে মাথা রেখে অস্পষ্ট কোনো ভাবনা ভাবি, বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার রুটিন কবে নাগাদ দিতে পারে, এসব নিয়ে চিন্তা করি। প্রিলিমিনারিতে টিকেছি। এটাও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মনোবেদনার কারণ, বুঝতে পারি। বেশি বুঝতে পারা কখনও কখনও অযথা অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর অস্থিরতা তৈরি করে। আমি এসব থেকে নিজের মনকে দূরে রাখার চেষ্টা করেও সব সময় সফল হতে পারি না; ওই বেশি বেশি বুঝতে পারা, মানুষের মন পড়তে পারার দোষে!
দিন এভাবে যেতে থাকে। যেতেই থাকে। দিন এক জায়গায় আটকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই। আমার বিষয় ইংরেজি। একই বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষক আমার পাঠদানে ভুল বের করার চেষ্টা করেন। শুধু ভুল বের করা নয়, সেটা নিয়ে নাটকীয় কায়দায় ছাত্রদের সাথে হাসিঠাট্টা করেন। আমাকে লাফিং স্টক বানাতে চান আর কী!
তার কাছে বাসায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়া কিছু ছাত্রকে আমার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেন। কী উদ্দেশ্য কে জানে? মানুষের এসব হঠকারী আচরণের কার্যকারণ ধরতে পারি না, জীবনে পোড় খাওয়ার পরিমাণ তখনও যথেষ্ট হয়নি বলে।
অল্প বয়সের আবেগ উছলে পড়ে। গলা পর্যন্ত কান্নার গোলা উঠে আসে। যখন-তখন চোখ ভিজে যায়। টপটপ করে পানি ঝরে পড়ে। সেই পানি আবার অন্যদের দেখানো বারণ। তাই ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে নিজের বিছানায় শুয়ে একপাশ ফিরে কাঁদতে হয়। একা একা। কলেজে মন নরম হয়ে গেলে মুখ ঘুরিয়ে চোখ জানালার বাইরে নিতে হয়। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আবেগ নিয়ন্ত্রণে আসে যতটা আনা সম্ভব।
মন আরও বেশি খারাপ হয় যখন আবিষ্কার করি, সিনিয়র শিক্ষক আমার যে ভুল নিয়ে এত নাটক করলেন, সেটি আসলে তারই ভুল। কিন্তু তিনি সিনিয়র, তিনি অভিজ্ঞ। তার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা আমি, দুই দিনের মাস্টারনি, দেখাতে পারি না। বিষয়টা নিজের কাছে চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু না পেরে একদিন বলে ফেলি। ভুলটা তার, আমার নয়।
“দুইটাই ঠিক।” ধরা পড়ার পর সিনিয়র শিক্ষক বেহায়ার মতো হেঁহেঁ করে আমাকে বলেন। আমি আর কথা বাড়াই না। নির্লজ্জ মানুষের মুখের হাসি বেশিক্ষণ দেখা যায় না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে টেবিলে মাথা রাখি।
ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক সামাদ স্যার টিফিন পিরিয়ডের সময়টুকু বাইরে খেলার মাঠে কাটিয়ে টিচার্স রুমে ঢোকেন। আমার জন্য তার একটু বেশি মায়া। চোখে পড়ার মতো। পাত্তা দিই না। সসম্মানে এড়িয়ে যাই।
“হুসনা ম্যাডামের মনটা কি আজ বেশি খারাপ? নাকি শরীর খারাপ? ক্যান্টিনেও গেলেন না।”
“না, স্যার, শরীর ভালোই আছে। মনটা একটু খারাপ।”
তারপর সংক্ষেপে, সিনিয়র শিক্ষকের ইংরেজি ভুল ধরার কাহিনিটা বর্ণনা করি। দেখলাম, আমি না বললেও চলত। এর মধ্যে কলেজের সবাই বিষয়টা জেনে গেছেন। আমি বোকার হদ্দ ভেবেছি, এসব লজ্জার কথা কাউকে বলার দরকার নেই। আমি না বললে কেউ জানবে না। খামোখা শত্রু বাড়িয়ে লাভ কী। কলেজে জয়েন করেই তো মনে হয় বিশাল অন্যায় করে ফেলেছি। এখন আবার অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ভুল ধরিয়ে দিলে আগুনে ঘি ঢালা হবে। অল্প কথার স্বল্পভাষী আমি চুপচাপ থাকাই উত্তম মনে করি।
“আপনি তো কথাটথাও তেমন একটা বলেন না। কলেজে এসে সোজা ক্লাসে ঢোকেন, পরীক্ষার ডিউটি করেন, বাড়ি চলে যান। একটু কথাটথা বললে, হাসি-তামাশা করলে, আমাদের সাথে গল্পগুজব করলে তো মনটা হালকা থাকে, ফ্রেশ থাকে।”
এ রকম আরও কিছু মন উজ্জীবিত করা বাণী গড়গড় করে সামাদ স্যার আওড়ে যেতে থাকেন। আমার মন হালকা আর ফ্রেশ রাখার কিছু ইনস্ট্যান্ট টনিক আর টোটকা জোর করে আমাকে বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমার দিক থেকে সেসবের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখানো সত্ত্বেও।
আমি পুরোটা সময় মুখ বন্ধ রেখে তার উপদেশবার্তা শুনে যাই। কেবল আমার দিক থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে যখন তিনি থেমে যান, চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে, আমি অল্প সময়ের জন্য মুখ খুলি। ভাবি, স্যারের এত কথা আর সহানুভূতির জবাবে আমার অন্তত কিছু একটা বলা উচিত।
“স্যার, জানেন তো বোবার শত্রু নেই। সারাজীবন আমি এই নীতি মেনে চলার চেষ্টা করছি। তাতে অনেক অহেতুক ঝামেলা এড়ানো যায়।” বলে মুখ টিপে সামান্য হাসি।
তাতেই সামাদ স্যার গলে মোম হয়ে যান।
“তা অবশ্য ঠিক বলেছেন, হুসনা। হান্ড্রেড পারসেন্ট সঠিক। তার পরও আমাদের সাথে একটু কথা বলবেন। তাতে আমাদের, আমার ভালো লাগবে। আপনারও ভালো লাগবে। দু’দিন পরেই তো আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।” ইত্যাদি।
সাড়ে তিন বছরের বেশি সেই কলেজে কাজ করেছি। চলে আসার আগ পর্যন্ত কোনো সহকর্মীর সাথেই তেমন কোনো সখ্য বা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। বয়স একটা ফ্যাক্টর ছিল। আর, প্রথম দিন কলেজ প্রাঙ্গণে পা দিয়েই যে বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেটা একপ্রকার ট্রমা বা ভীতি তৈরি করেছিল আমার ভেতরে। তা থেকে বের হয়ে আসতে সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম নিজের ব্যবহার দিয়ে সবার মন জয় করে, তাদের প্রি-কনসিভড ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে।
একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখি, কলেজের প্রায় প্রত্যেকে আমার কাছে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি বলতে শুরু করেছেন। আরও বলতে শুরু করেছেন একে অন্যের ব্যাপারে তাদের বিশেষ করে মন্দ লাগার বিষয়গুলো। যাকে গিবত বা পরনিন্দা বলে। মুখে কুলুপ এঁটে আমি তাদের একেকজনের সাগা অব সিক্রেট লাইভস শুনতে থাকি আর বিস্ময়ের পারদ চরচর করে উঠতে থাকে। এমনকি সেই মহিলা শিক্ষক আমার কারণে যার স্বামী এখানে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনিও একদিন হাসিমুখে আমার পাশে বসে কাছের বন্ধুর মতো হৃদয়ের অর্গল খুলে দিয়েছেন! 
৩. হিরণ্ময় নীরবতা… 
সব সময় জেনেছি, নীরবতা হিরণ্ময়। এখন আরও ভালো করে জানি। অভিজ্ঞতার পাথরে নিত্য ঘষা খেয়ে, দিব্যি শানিত/প্রাণিত হয়ে সেই অনুধাবন ও উপলব্ধির পলেস্তারা হয়েছে দৃঢ় কঠিন প্রগাঢ়।
আত্মবিশ্বাস নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। মাঝামাঝি মাত্রার এই জিনিস আমার খুব বেশিও নেই, একেবারে কমও নেই। আমার ব্যক্তিচরিত্রের রকমফেরটাই এমন, প্রয়োজনের বাইরে কারও সাথে কথা বলার তাগিদ অনুভব করিনি/ করি না। গুণ বা দোষ যা-ই হোক, বাবার কাছ থেকে জিনসূত্রে পেয়েছি। এটাকে কি এক ধরনের স্বার্থপর মানসিকতা বলা যায়? দরকার ছাড়া মানুষের সংস্পর্শে যেতে চাইছি না যেহেতু।
সেভাবে দেখলে, হয়তো তাই। কিন্তু আমার বিশ্লেষণ অন্যরকম। নীরবতার মাঝে, সীমিত ভাষণের মাঝে আমি দেখতে পাই জীবনের গূঢ় রহস্যের হাতছানি। যা কোলাহলের ভিড়ে হারিয়ে যায়, তাকে সহজে খুঁজে পেতে পারি নিস্তব্ধ মৌন পদচারণার সতর্ক পদক্ষেপে।
বহু বছর আগে তরুণ বয়সে ঘটা কলেজের ঘটনাটি একমাত্র উদাহরণ নয় যখন আমি আরও একবার আবিষ্কার করেছিলাম যে, অযথা কথা কেবল অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা তৈরির একটি মোক্ষম উপলক্ষ মাত্র। আমি তাই যাবতীয় শোরগোল আর হট্টগোল এড়িয়ে নিস্তব্ধ নীরবতাকে প্রশ্রয় দিতে উন্মুখ হয়ে উঠি। নিঃশব্দ আলয়ে “মৌনতার সুতোয়” বুনি হাজার স্বপ্নের ভিত। সেই ভিতের ওপর রচনা করি, সাজিয়ে তুলতে ভালোবাসি ছোট্ট জীবনের কুঁড়েঘর! 

সম্পর্কিত নিবন্ধ