হাতে ভাজা মুড়ি, শাশুড়ির পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অর্চনা
Published: 3rd, March 2025 GMT
হাঁটতে হাঁটতে তিতাস নদীর পাড় পর্যন্ত যেতেই কানে এলো মুড়ি ভাজার শব্দ। কয়েকজন নারী মুড়ি ভাজছেন। পুরাতন পদ্ধতিতে গরম বালুর সঙ্গে খোলায় ভাজা চালের স্পর্শে হাড়িতে মট-মট শব্দে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি।
এখানে হাতে ভাজা মুড়ির মূল কারিগর অর্চনা দাস (৫৫)।
অর্চনা দাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের পাইকপাড়া পাটগুদাম রোড দাস পাড়ার ঝান্টু দাসের স্ত্রী। ঝান্টু দাস পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ি। অর্চনা দাসের চার মেয়ে ও একজন ছেলে। চার মেয়েকেই দিয়েছেন বিয়ে এবং ছেলে এই বছর বিবিএ শেষ করেছে।
অর্চনা দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই শাশুড়ি তরঙ্গ বালা দাস হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতেন। শাশুড়ি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। শাশুড়ির কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমিও মুড়ি ভাজা শিখে ফেলেছি। শাশুড়ি ২০১৯ সালে মারা গেলে ছেলেমেয়েরা মুড়ি ভাজতে নিষেধ করেছিল কিন্তু শাশুড়ির ৫০ বছরের পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই মুড়ি ভাজার দায়িত্বটা আমি কাঁধে নেই।”
মুড়ি ভাজতে উপকরণ হিসেবে তিনি বলেন, “হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতে দেশি চাউল দিয়েও হয় তবে রমজান আসলে মুড়িগুলো সুন্দর করতে ‘শান্তি সিলভার’ নামে এক কোম্পানির চাউল আছে, সেটা ব্যবহার করি। আমি চালগুলো লবণ পানি দিয়ে মেখে দেই। আমার ভাইয়ের মেয়ে সুলেখা দাস লবণ পানি দেওয়া চালগুলো তাওয়াতে ৪-৫ মিনিট গরম করে। তারপর আমার ভাসুরের ছেলের বউ বন্দনা দাস গরম বালুতে সেই চাউলগুলো ঢেলে চিকন কাঠি দিয়ে হাতে নাড়া দিলেই হয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি।”
অর্চনা দাস বলেন, “আমার শাশুড়ির বাড়িতে এসে আমি দেখেছি ১৯৯০ সালে এক কেজি মুড়ি ২৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেন। এখন মুড়ি বিক্রি করি ১২০ টাকা দরে।”
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এক বস্তা চালের দাম ৩৪০০ টাকা, লবণ লাগে ৩০ টাকা, রিকশাভাড়া ৩০ টাকা, ভাজা খরচ ১৪০ টাকা। এক বস্তা চাউলে ৩৮ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে এক দিনে ৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি করতে পারি। রমজান মাস ছাড়া ২৫ কেজি বিক্রি হয়।”
পাইকার ব্যবসায়িরা এক কেজি মুড়ি ৯৫ টাকা ধরে কিনে নিয়ে যায় পাইকাররা কেজি প্রতি ১২০ টাকা বিক্রি করেন।
প্রতিবেশি নিদু দাস বলেন, “আমরা ২০ বছর ধরে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করতাম। বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে পেশাটাকে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের যা কাস্টমার ছিল এখন অর্চনা থেকে মুড়ি নিয়ে যায়। কেমিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই আসে মুড়ি নিতে। রমজান মাসে চাহিদা বেশি থাকে। আগে এখানে ১০টা পরিবারের মতো হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করতেন কিন্তু বর্তমানে লোকবল সংকটের কারণে এই পেশা থেকে মানুষ দূরে চলে গেছে।”
মুড়ি ক্রেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি জাবেদ রহিম বিজন বলেন, “আমি ১০ বছর ধরে তাদের বাড়ি থেকে মুড়ি কিনি। সুস্বাদু ও কেমিকেল মুক্ত হওয়ায় আমার পরিবারের পছন্দ এই মুড়ি। দুই কেজি মুড়ি ২৪০ টাকা দিয়ে কিনেছি।”
কুমারশিল মোড়ের নিউ স্টোরের সত্ত্বাধিকারী হৃদয় রায় বলেন, “পাইকপাড়া থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আমরা কিনে রাখি। হাতে ভাজা মুড়ি পুরাতন কাস্টমার যারা আছে তারা কিনে নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই নিয়ে যায়।”
ঢাকা/টিপু
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
শাশুড়িকে নারীর চোখে ‘দানব’ বানায় কে
সম্প্রতি পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রায় ফ্যাসিস্টের প্রতিমূর্তি মোটিফের প্রতিক্রিয়ার এক নারীর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যেখানে নারীটি মোটিফটির রূপের সঙ্গে তাঁর শাশুড়ির চেহারার মিল খুঁজে পাওয়ার প্রসঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি শুধু তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং সামগ্রিকভাবেই তিনি শাশুড়িদের দানব রূপটির কথা বলেছেন।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই অনেক সমালোচনা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নারীটিকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়েছে, নারীটির স্বামীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ নারীটিকে আইনের আওতায় আনার দাবি পর্যন্ত তুলেছেন।
‘নারীই নারীর শত্রু’ কথাটি যেন এক স্বীকৃত সত্য। অথচ পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধের শীর্ষে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষের জয়জয়কার। ঘটে যাওয়া অপরাধের মাত্রায় পুরুষের আশপাশেও নেই নারী। ঘরের মধ্যে কিংবা বাইরে এক পুরুষ অন্য পুরুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে, মারামারি করছে, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করছে প্রতিনিয়ত। অথচ ‘পুরুষই পুরুষের শত্রু’ এমন কথার কিন্তু প্রচলন হয়নি আজও।বলার অপেক্ষা রাখে না যে শাশুড়ি সম্পর্কে নারীটির বক্তব্যটি ছিল খুবই দুঃখজনক, অশোভন ও অপ্রত্যাশিত। শাশুড়ি সম্পর্কে নারীটির সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির এই প্রকাশ অনেককেই আহত করেছে সন্দেহ নেই, তবে বক্তব্যটিতে নতুন করে খুব অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল বলে আমার মনে হয় না। নারীটির অনুভূতি কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো অনুভূতি নয়। ব্যতিক্রম একটাই যে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাশুড়ির নেতিবচাক রূপটির সঙ্গেই নারীকে পরিচিত করানো হয়েছে। ইতিবাচক শাশুড়ির প্রতিমূর্তি ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই ওই নারীকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, এই ধরনের চিন্তাভাবনা কিংবা অনুভূতি কীভাবে প্রোথিত হয় নারীর মনে? এর পেছনের রাজনীতিটি কী, যেখানে নারীকেই নারীর শত্রু কিংবা দানব হিসেবে চিত্রিত করা হয়? নারীকে নারীর শত্রু ভাবতে শেখার সুফলটি ভোগ করছে কে বা কারা?
‘নারীই নারীর শত্রু’ কথাটি যেন এক স্বীকৃত সত্য। অথচ পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধের শীর্ষে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষের জয়জয়কার। ঘটে যাওয়া অপরাধের মাত্রায় পুরুষের আশপাশেও নেই নারী। ঘরের মধ্যে কিংবা বাইরে এক পুরুষ অন্য পুরুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে, মারামারি করছে, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করছে প্রতিনিয়ত। অথচ ‘পুরুষই পুরুষের শত্রু’ এমন কথার কিন্তু প্রচলন হয়নি আজও।
পুরুষ সহিংস পুরুষের প্রতি, পুরুষ আরও বেশি সহিংস নারীর প্রতি। ২০১৮ সালে পরিচালিত ‘গ্লোবাল স্টাডি অন হোমিসাইড: জেন্ডার রিলেটেড ক্রাইম অন উইমেন অ্যান্ড গার্লস’ শিরোনামে গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন নারী তাঁদের পুরুষসঙ্গী বা পার্টনারদের হাতে খুন হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের পুরুষেরা বিশ্বে চতুর্থ। প্রতিদিন হাজার হাজার নারী ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে বাংলাদেশে মোট ৪০ হাজার ৮৮২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নারী কিংবা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক অন্তত একবার হলেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পুরুষের সহিংস আচরণের কারণে নিজের ঘর নারীর জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ স্থানে পরিণত হলেও ‘পুরুষ নারীর শত্রু’ বলে আখ্যায়িত হননি কখনো; বরং নারী অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ‘নারীর শত্রু’ হিসেবে সর্বমহলে বিবেচিত হয়েছেন।
যেখানে ঘরের বাইরের পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে পুরুষের হানাহানি-মারামারি নিত্যদিনের ঘটনা, সেখানে শাশুড়ি-বউ-ননদ সম্পর্ক কিংবা মামুলি কিছু সমস্যার জন্য কেন এক নারীকে অন্য নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নারীকেই নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে আর পুরুষের অত্যাচার-নির্যাতনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শেখায়। এই চর্চা নারীকে নারীর চোখে শত্রুর কাঠগড়ায় এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দেয় যেন নারী নারীর প্রতি আস্থা হারিয়ে পুরুষের প্রতিই আত্মবিশ্বাসী হন ও আত্মসমর্পণ করেন।
নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থান তাঁকে শেখায়, সংসারটাই তাঁর একমাত্র অবলম্বন। চারদেয়ালের সংসারটাই অনেক নারীর কাছে তাঁর একমাত্র সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিকর্ত্রী তিনি। পুরুষের মতো নারীর নেই বাইরের কোনো জগৎ, নেই কোনো বিনোদন কিংবা কোথাও অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ। তাই তাঁর একমাত্র সাম্রাজ্যের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে নারীতে নারীতে শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বারবারই নারীকে ‘সংকীর্ণ’ আর পুরুষকে ‘উদার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অথচ নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান যদি বিপরীত হতো, অর্থাৎ পুরুষ যদি ঘরে থাকত, আর নারী বাইরে, তবে এই টানাপোড়েন আলাদা হতো বলে মনে হয় না। পার্থক্য একটাই, সে ক্ষেত্রে শ্বশুর রূপটি হয়তো পুরুষের সামনে দানব হিসেবে আবির্ভূত হতো।
তবে সব পুরুষ যেমন পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা করেন না, ঠিক একইভাবে পুরুষতান্ত্রিক এই মানসিকতা যে শুধু পুরুষই লালন করেন, তা-ও কিন্তু নয়। কখনো কখনো নারীর মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক চর্চা প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। যে মানসিকতা একজন নারীকে অন্য একজন নারীর প্রতি সহিংস কিংবা বিরূপ করে তোলে, তার উৎসমূলে পুরুষতান্ত্রিকতা। যার বীজ রোপণ করা হয় শৈশবেই। শৈশব থেকেই একজন নারী অন্য একজন নারীকে হিংসাপরায়ণ হিসেবে ভাবতে শেখেন। এই শিক্ষা পুরুষতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্তভাবে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
নারীকে যতই ‘নারীর শত্রু’বলা হোক না কেন, সত্য এই যে নারী পুরুষকে যেমন ভালোবেসেছেন, ঠিক তেমনি ভালোবেসেছেন নারীকে। তাঁর এই মহানুভবতাই টিকিয়ে রেখেছে সভ্যতা। নারী কখনোই নারীর শত্রু নন, হতে পারেন না। নারী নারীর শত্রু নন; পুরুষও নারীর শত্রু নন। নারীর শত্রু মূলত ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’। তাই দানব যদি কেউ হয়ে থাকে, সে হলো ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’, যা সহিংসতা আর বৈষম্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। তাই পুরুষতান্ত্রিক এই চর্চাকে রুখে দিতে হবে, যার ক্ষতিকর প্রভাব গ্রাস করছে নারী ও পুরুষের সুন্দর ও স্বাভাবিক সম্পর্ককে।
নিশাত সুলতানা
লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]