Prothomalo:
2025-04-06@08:27:54 GMT

হানিফের দাঁত 

Published: 3rd, March 2025 GMT

ওখানে লোকজন তেমন আসত না: খাদেম নেই, লালসালু প্রায় পচে গিয়েছিল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটা কবরের ওপর নামিয়ে দিয়েছিল এলোমেলো ঝুরি। বাগহাটার মতো জায়গায় মহাসড়কের পাশে অমন অনাদরে একটা মাজার পড়ে থাকবে, ঘরামি হানিফ না দেখলে বিশ্বাস করত না। দক্ষিণের মানুষের কাছে পুণ্যভূমি বাগহাটা, হজরত খান নাহুম আলীর দরগাহ জেলাটিকে আলাদা মাহাত্ম্য দিয়েছিল, যাকে লোকে বলে বড় দরগাহ, কিন্তু অজস্র ছোটখাটো দরগাহও চোখে পড়ত এখানে–ওখানে, দেশের বিবিধ প্রান্তের লোকজন ভিড় জমাত, এমনকি নদীঘাটায় ঝুলন্ত দানবাক্সগুলো বাতাসে নাচলেও শোনা যেত ঝনঝন আওয়াজ। সেই জনশূন্য ভগ্নপ্রায় মাজারটায় এক বর্ষার দুপুরে হানিফ আশ্রয় নিয়েছিল প্রাচীন নোনাধরা সিঁড়ি একদিকে কাত হয়ে আছে, সেখানে যদিও বেশিক্ষণ বসার উপায় ছিল না, ঝেঁপে বৃষ্টি নামলে তাকে ভেতরে গিয়ে উঠতে হয়েছিল। 

অন্ধকার চারধার। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। কাদা আর বাদাড়ের এমন তীব্র ঘ্রাণ যে অনুভূতি ভোঁতা করে দেয়। মাজারের ছাউনির নিচে একা দাঁড়িয়ে থেকে কেমন এক বিপন্নতা জমাট বাঁধছিল মনে। ঠিক তখনই লোকটাকে সে দেখে যে মাজারকে খাদেমহীন মনে করেছিল, সেখানে রীতিমতো এক জিন্দাপীরের মতো দৃশ্যমান হয়েছিলেন উনি। শুকনো লম্বাটে শরীর, ছোট মুখ, থুতনিতে একগুচ্ছ সাদা দাড়ি। চোখের সাদা অংশ এমন ধবধবে যে চমক জাগে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি। হাতে একটা কেরোসিনের লম্পো জ্বলছে—বৃষ্টির ছাঁটে যা নিভে গেলেও ভ্রুক্ষেপ করবেন না, এমন ভঙ্গি। মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ। 

‘কিডা তুই? এইখেনে কী?’ 

‘জি এমনিই.

..আইছিলাম এক কাজে...আটকায়ে পড়লাম বিষ্টির জন্যি।’ হানিফের কণ্ঠ কেঁপেছিল ভয়ে। লোকটাকে অমন দৃশ্যপটে ঠিক স্বাভাবিক লাগছিল না। হয়তো বুঝতে পেরেই উনি বলেছিলেন, ‘ভয় পাইসনে। আমারে যা ভাবতিছিস, হতি পারি আমি তা–ই, কিন্তু না হলিও–বা কী? তোর জন্য এতে মন্দ কিছু নেই।’

এই সাক্ষাৎকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভেবে এসেছে এর পর থেকে হানিফ। কত বছর পার হয়ে গেল, সুদূর অতীতের ওই স্মৃতি মলিন হয়নি ধুলাপরিমাণ। ওনার এক ভবিষ্যদ্বাণী, যা তার জীবনকে খুব অর্থময় করে তুলেছিল যৌবনে, যদিও দিনের পর দিন গেছে, সেই বাণী বাস্তবে ফলে যাওয়ার কোনো সম্ভাব্যতা সে দেখেনি। গত শতাব্দীর সেই বৃষ্টির মৌসুমে বাগহাটায় সে গিয়েছিল কর্মের টানে, চুক্তিমতো পারিশ্রমিক না পেয়ে মন খারাপ করে বসে ছিল পরিত্যক্ত মাজারটিতে। তারপরই সেই সাক্ষাৎ। পুব পাড়ায় ফিরে আর কখনো পেশাগত বিপদে পড়তে হয়নি তাকে, পরপর কয়েকটি গ্রাম আর গ্রাম ছাড়িয়ে বহু দূরে দূরেও তার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিন বউ, অনেকগুলো সন্তানের বিরাট সংসারের ব্যাপ্ত চাহিদা—অবস্থাপন্ন হয়ে ওঠার মতো বিষয় তার সঙ্গে ঘটেনি, কিন্তু হানিফের জীবনে কখনো অবসরও আসেনি। গোলপাতায় ঘরের চাল ছেয়ে দেওয়া বা বেড়ার কাজ কমে গেছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু চালু লোক সে, কাঠের কাজ আর টিনের ছাদ বসানোতেও হয়ে উঠেছিল ওস্তাদ। সঙ্গে ছিল শীতকালীন পেশা, পুবপাড়া আর মল্লিকপাড়ার যত খেজুরগাছ, ওগুলো কেটে রস ঝরাত সে। গাছি হিসেবেও তার নাম ছড়িয়েছিল দারুণ। 

আজ প্রচণ্ড দাঁতব্যথায় কাবু হয়ে সে কুণ্ডলী পাকিয়ে উবু হয়ে আছে বিকেলের শেষ রোদে পিঠ মেলে। কাছেই চুলা জ্বলছে, জ্বাল দেওয়া খেজুরের রসের মাদকীয় মিঠে ঘ্রাণও তার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। কিন্তু এসবের মধ্যেই জিন্দাপীরের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের স্মৃতি তার ব্যথায় টনটন করতে থাকা মাড়ি, মাথার শিরা–উপশিরা আর সারা দেহে কেমন যেন একটু উপশমের ভ্রম তৈরি করে দেয়। ওই এক ভবিষ্যদ্বাণী, তার পর থেকে নিজেকে বিশেষ কেউ মনে করার অভ্যাসও তার মধ্যে গজিয়ে উঠেছিল একটা বুনো ঝোপের মতো। যাকে ছেঁটে ফেলে যায়, কিন্তু আবার গজায়। যেন জীবনে তার অন্যদের চেয়ে আলাদা উদ্দেশ্য আছে, তাই চারপাশের যেকোনো ঘটনায় নিজেকে সে জড়িয়ে ফেলত। এমন সব ভাবনার মাঝখানেই আখলাক মেম্বারকে গলা চড়িয়ে তার নাম ধরে ডাকতে শোনা গেল, ‘এ কাকা, বাড়ি আছ নাকি? আসপো ভেতরে?’ 

নদীর কাছাকাছি খোলা মাঠের মতো একটা জায়গায় হানিফের বাড়ি, এঁটেল মাটির দাওয়ার ওপর তোলা দুটি টিনশেড কাঠের ঘর, রাস্তা থেকে বেশ কিছু দূর হেঁটে আসতে হয়। এতটা এসে তাই আর অনুমতি নেওয়ার কিছু থাকে না, উঠানে দাঁড়ানো আখলাক মেম্বারের প্রশ্নে হানিফ মাথা তুলে তাকায়। ‘কউ ভাইপো, হইছে কী? দাঁতে খুব জ্বালাচ্ছে, বুঝলা। হেবি যন্ত্রণা।’

‘আজমির ডাক্তাররে দেখাও না কেন? নাকি গিছিলা?’ 

‘গিছিলাম। দিছে ওষুদ। কইছে টাইম লাগবে।’

‘ও, আচ্ছা। তা কাকা, এখ্যান ঝামেলা হইছে যে।’

‘কী ঝামেলা?’ 

‘কী আর কব’, আখলাকের কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসে, ‘মধ্যমপাড়ার মেকানিক বদরুলরে তো চেনো? ওর শালির পেট বাঁধায় দিছে ওইগে পাশের বাড়ির আইনাল। মেয়েটা বলতিছে, আইনাল তারে ভালোবাসার কথা বলত, বিয়ের আশ্বাস দেখাইয়ে মিলামিশা করত তার সঙ্গে। এদিকি আইনাল আবার পুরো ব্যাপারটারেই অস্বীকার করতিছে। বিচার আনিছে বদরুল। এহনে তুমি কিছু কউ, তুমার কী মনে হয়?’ 

ঘরামি হানিফ তার দাড়িবিহীন দুই গালে দুই হাতের তালু চেপে ধরে। যন্ত্রণা দিচ্ছে ডান দিকে ওপরের পাটির একটা দাঁত। এখন মাথায়ও ভীষণ দপদপে একটা বেদনা টের পায়। কিছুটা সামলে নিয়ে আখলাক মেম্বারকে সে জানায়, ‘বাজারে যাচ্ছ না? রাতে বাসায় ফিরার সুমায় এদিক হইয়ে যাইয়েনে। আমি এট্টু ভাইবে দেখি।’

‘দেখো কাকা, কী সব যে হচ্ছে গিরামে।’

গ্রামে অনেক কিছুই হয়, যা হানিফের আজকাল তেমন জানা হয় না আগের মতো। তবে যা–ই হোক, পুরোনো দিনের চেয়ে ভিন্ন কিছু যে ঘটে না, সে বোঝে। দুনিয়ায় দুর্ঘটনার ধরন কখনো বদলায় না। উষ্ণ লবণপানি এনে দেয় তার বড় বউ, অনেকক্ষণ ধরে কুলি করে সে। মন থেকে অস্থিরতার ভাবটাও কাটতে চায় না। ঘরজুড়ে হইচই, কেউ না কেউ ঝগড়া করছেই। তার মেজ মেয়েটা চলে এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। কেন, সে আর জিজ্ঞেস করেনি। কিছুদিন আগেই তার এক ছেলে কুণ্ডুপাড়ার কোন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে উধাও হয়েছে—এসব বিষয় তাকে এখন আর সেভাবে স্পর্শও  করতে পারে না।  

এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার সময় আখলাক মেম্বারের সঙ্গে তার আবার দেখা হয়ে যায়। ভৈরবের তীরে একটা বাবলাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে লোকটার সঙ্গে সে পরামর্শ করে। চাপ চাপ অন্ধকার নেমেছে পুবপাড়ার বুকে, ঘাটের এনার্জি সেভিং বাল্বের আলো এত দূর আসে না, ‘শোনো মেম্বার, তুমি এট্টু খোঁজ নিয়ে দেখো দিন। মেকানিক বদরুল আর আইনালের মধ্যে আগের কোনো গ্যাঞ্জাম আছে কি না। ধরো জমিজমার ঝামেলা বা পারিবারিক কোনো কোন্দল, এসব। এইডে খুঁইজে বাইর করো, দেখবা অর্ধেক সমস্যা মিটে গেছে।’ আখলাক অবাক হয়ে বলে, ‘কাকা, তুমার মাথা এমন খেলে, অবাক লাগে বুঝিছ। সেই আব্বার আমলেও দেখিছি। তুমি এখ্যান মাল।’

প্রশংসাটা হানিফ উপভোগ করে। কিন্তু বাসায় ফেরার পর দাঁতের ব্যথাটা এতই তীব্রতা পায় যে চোখে পানি চলে আসে। কোনোরকম রাতটা কাটিয়ে ভোরের দিকে রেডি হয় সে। একটা জীর্ণ ক্যাম্বিসের ব্যাগে ভরে নেয় ব্যথানাশক হোমিওপ্যাথির শিশি, বাড়তি একটা সোয়েটার আর লুঙ্গি–গামছা, ছোট্ট বোতলে শর্ষের তেল। গায়ে আকাশি পলিস্টারের পাঞ্জাবি আর সুতির পাজামার ওপর মোটা খাকি শাল, পায়ে প্লাস্টিকের মোড়া জুতা, মাথায় কানটুপি। দক্ষিণের শীত এসব ভেদ করেও তার হাড়ে ভালোই কামড় বসায়। বাগহাটায় সে পৌঁছায় সকাল ১০টার দিকে। এরপর সেই মাজারটা খুঁজতে থাকে এবং খোঁজেও দুপুর পর্যন্ত। এলাকাটি যে আমূল বদলে গেছে এমন নয়, কিন্তু মাজারের চেয়ে মসজিদই বেশি চোখে পড়ে। ওই জায়গা খুঁজে পেলেও–বা কী লাভ হতো, জিন্দাপীর এত বছর পর কি আর জিন্দা আছেন? এসব বিড়বিড় করে নিজেকে সে সান্ত্বনা দেয়। তবে শিগগিরই পুবপাড়ায় ফেরত যাবে, এ রকম মনে হয় না। হজরত খান নাহুম আলীর দরগায়তে বেশ কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয় হানিফ। কিসের আশায় তা নিজেও হয়তো পরিষ্কার বুঝে  উঠতে পারে না। দরগাহ লাগোয়া বিরাট দিঘি আর সেই দিঘির পাড়ে কুমিরগুলোকে ঘুমাতে দেখে সে বিস্ময় নিয়ে। দরগাহয় তৃতীয় রাত্রিতে তার বোধোদয় হয়, এখানে এমন এত দূরে যদি মরে যায় পরিবার–পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন, একা আর সম্বলহীন অবস্থায়—এ মরণ তাকে বিশেষ কীভাবে করে তুলবে? এমন কি সে চায়? 

তাই একদিন বিকেলে পুবপাড়ায় পা রাখে সে। জানতে পারে যে মেকানিক বদরুলের আনা সালিসিটার মীমাংসা হয়ে গেছে। আইনাল নাকি সব স্বীকার করেছে, বদরুলের শালির সঙ্গে বিয়ে বসতে রাজি হয়েছে লোকটা। আগামী শুক্রবারেই বিয়ে। শারীরিক অস্বস্তির মধ্যেও খবরটা শুনে তার কিছু স্বস্তিই লাগে। বাসায় ফিরে সে দেখে, মেজ বউ আর ছোট বউ একে অন্যকে সমানে খিস্তি করছে, ঝগড়া লেগেছে কয়েকটা দয়া কলা নিয়ে, ঘরের কোনো এক সদস্য লুকিয়ে কলাগুলো খেয়ে ফেলেছে। ওদের দিকে আচমকা একটা চেলাকাঠ নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারে হানিফ, ঘটনার আকস্মিকতায় দুই প্রৌঢ়া বউ বিহ্বল হয়ে যায় মুহূর্তের জন্য। তারপর নিজের ঘরটায় ঢুকে কিছুক্ষণ লেপ মুড়ি দিয়ে সে শুয়ে থাকে। কোনো ওষুধেই যখন কাজ হচ্ছে না, একটা সমধানের কথা খেলে যায় তার মনে। এমন যন্ত্রণা আর সহ্য করা অসম্ভব। বিছানা থেকে উঠে খাটের নিচ থেকে যন্ত্রপাতির বাক্সটা ধীরে টেনে আনে হানিফ। পুরোনো প্লায়ার্সটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসে, এতে হবে। বেড়ার গায়ে লাগানো আয়নাটার সামনে দাঁড়ায় সে। অপরাধী যে দাঁতটা এত দিন কষ্ট দিচ্ছিল, প্লায়ার্সের কয়েকটা টানে নড়িয়ে চড়িয়ে উপড়ে আনে ওটাকে—বিবর্ণ, ক্ষয়িষ্ণু। মাথা টলে ওঠে কিছু সময়ের জন্য। একবার মনে হয় আয়নাটার ওপর ছপ করে কেউ পানের পিক ফেলায় জিনিসটা একেবারেই লাল হয়ে গেছে হুট করে। 

গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে তেমন সময় লাগে না, রাতের প্রথম প্রহরেই ঘটে বিষয়টা। ওর বউয়েরা স্বভাবতই ভয় পেয়ে গেলে হানিফ জানায়, ‘তুরা অযথা চিন্তে করতিছিস, এই সামান্য অসুখে আমার কিছুই হবে না, পীরের হুকুম আছে।’ তবে দুই দিনের বেশি ওদের চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করতে করতেই ডিসেম্বরের এক মধ্যরাতে ঘরামি হানিফের স্মরণ হয় জিন্দাপীরের সেই ভবিষ্যদ্বাণী, যাকে অনুসরণ করতে গিয়ে আজ বেঁচে থাকার এই পর্যায়ে সে পৌঁছাল, ‘হানিফ, তোর মিরিত্যু হবে আলাদা, আর সবার চেয়ে এক ব্যতিক্রমী কারণে মারা পড়বি তুই। খ্যাতি হবে তোর।’ 

সেই একই রাতে মেকানিক বদরুলের কিশোরী শালিকে ঘরে ঢুকে খুন করে যায় আততায়ী। ভরামাসের পোয়াতি ছিল মেয়েটা। তবে দিনের পর দিন এই দুঃখজনক বিষয়টি সামলাতে পুবপাড়ার লোকজন যেনবা ঘরামি হানিফের মৃত্যুকে সামনে নিয়ে আসে বারবার, একটা লোক প্লায়ার্স দিয়ে টেনে নিজেই নিজের নষ্ট দাঁত তুলেছে আর সেই ঘটনার ফলে মরে গেছে, ব্যাপারটি তাদের মনে দুঃখ জাগায় না, এমন নয়; কিন্তু ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে অনেকেই হেসে ফেলে। হাসি গিলে ফেলে কেউ কেউ বলে, এটাই বাস্তব।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ক ন ক বদর ল র জন য র ওপর আইন ল দরগ হ

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা-দিল্লির পদক্ষেপই ঠিক করবে সম্পর্কের গতিপথ

ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের সম্পর্কের ‘চরম টানাপোড়েন’ দূর করতে নিজেদের উদ্বেগের বিষয়গুলো একে অন্যকে বলেছেন। কোনো কোনো ইস্যুতে দুই নেতা পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। আবার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ও আলোচনায় এসেছে।

তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আর ভারতের শীর্ষ নেতারা দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আলোচনায় বলেছেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের কেন্দ্রে মানুষ। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক মানুষের স্বার্থে। সম্পর্কটা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা দলকে ঘিরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে এ বার্তা বাংলাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন নরেন্দ্র মোদি।

গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে আধা ঘণ্টার বেশি সময়ের ওই বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা অতীত আর বর্তমানের বিষয়গুলো সামনে এনেছেন সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে। আর আলোচনাজুড়ে ছিল দুই দেশের প্রসঙ্গগুলো।

অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!

শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে যে এটা নির্ভর করছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের ওপর। শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টিও এসেছে।

ইউনূস-মোদির প্রতীক্ষিত বৈঠকটি এমন এক সময়ে হলো, যার ঠিক এক সপ্তাহ আগে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বেইজিংয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বেইজিংয়ের সেই বৈঠকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর তিস্তার প্রস্তাবিত প্রকল্পে চীনের ঠিকাদারদের স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। অধ্যাপক ইউনূস চীনের কাছে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে কি চীন প্রসঙ্গটি ব্যাংককের আলোচনায় ঊহ্য থেকে গেল!

আরও পড়ুনইউনূস–মোদি বৈঠক: যেসব বিষয়ে আলোচনা হলো১৪ ঘণ্টা আগে

ইউনূস-মোদির বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় সরাসরি ‘চীন’ শব্দটি উল্লেখ না থাকলেও বিষয়টি এসেছে। নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়! কাজেই বাংলাদেশের সফলতা, সংকটে সব সময় পাশে থাকার বাসনা ভারতের।

সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর

সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের যে ভূমিকা রয়েছে, সেটা ভারত উল্লেখ করেছে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনা ৫ থেকে ৮ আগস্ট। যার সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় নয়, রাজনৈতিক কারণ জড়িত। তারপরও বাংলাদেশ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে ভারতের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

দুই দেশ ভবিষ্যৎমুখী ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে। তাই খোলাখুলিভাবে শীর্ষ দুই নেতা চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও বলেছেন। কিন্তু গত প্রায় আট মাসের চরম টানাপোড়েনের জেরে ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতীয় ভিসা একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এতে ভারতে তো বটেই, ভারত থেকে তৃতীয় দেশের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর ভিসার হার নেমে আসায় দুই দেশের মধ্যে বাস-ট্রেন যোগাযোগও প্রায় কমে গেছে। অথচ শুক্রবারের আলোচনায় ভিসা আর যোগাযোগের প্রসঙ্গগুলো আসেনি।

নরেন্দ্র মোদি আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, তার অভ্যুদয়—সব মিলিয়ে দুই দেশ একে অন্যকে যতটা জানে, বোঝে, তা নিশ্চয় অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়!

বৈঠকে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সব সময় কষ্ট অনুভব করেন। ভারতকে এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে কেবল অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না, বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সাহায্য করবে।

এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলো ভারতের ভেতরে ঘটে। উভয় নেতা বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ব্যাংককে উপস্থিত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে নেতাদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির কথা হয়েছে। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের সেই অনানুষ্ঠানিক আলোচনার পর দিনের বৈঠকের জন্য একধরনের ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছিল। সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে যোগাযোগটা জরুরি ছিল। এখন ইউনূস-মোদি বৈঠকের পর সময় বলে দেবে, সম্পর্ক এগিয়ে দুই পক্ষ কতটা উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে।

ব্যাংককের আলোচনায় উপস্থিত কয়েকজন কূটনীতিক আভাস দিয়েছেন, এক বৈঠকেই সব সংকট কেটে যাবে, এমন উচ্চাশা কোনো পক্ষই করেনি। বৈঠক হওয়াটাও ইতিবাচক। কারণ, দুই শীর্ষ নেতাই মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। আর বৈঠকের জন্য তৈরি হয়েই ব্যাংককে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে ব্যক্তিগত যোগাযোগের স্মৃতিচারণা। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় দুই নেতা ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার গতিমুখ।

সব মিলিয়ে ব্যাংককে শুক্রবারের আলোচনা ইতিবাচক হলেও দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দুই নেতা প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসে দুই দেশের আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সামনাসামনি বসে এ বিষয়গুলো আলোচনায় উত্থাপনের ফলে তা সুরাহার জন্য তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক একধরনের দায়বোধ তৈরি হতে পারে। ফলে দুই নেতা হয়তোবা নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন। এতে দুই দেশের সম্পর্কে হয়তো গতির সঞ্চার হতে পারে। দুজনের জন্যই সম্পর্ককে সাবলীল রাখার একধরনের চাপ তৈরি হতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংককের বৈঠককে ইতিবাচকই বলা চলে।

এম হুমায়ুন কবীরের মতে, সম্পর্ক খারাপ হয় এমন বক্তব্য পরিহার করার যে প্রসঙ্গ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন, একই বিষয় তাঁদেরও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ