ইয়াহিয়া যেভাবে মুজিবকে ধোঁকা দিয়েছিলেন
Published: 3rd, March 2025 GMT
...
৭ মার্চের জনসভায় গণ-আন্দোলন জোরদার করে তোলার যে আহ্বান শেখ মুজিব করেছিলেন, সেই অনুসারে ৬ দফায় বর্ণিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বদলে ‘এক দফা’র দাবি, অর্থাৎ স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র ও যুবকদের মিছিল ও বিক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের পরিসর বাড়ার ফলে দেশের দুই অংশের মধ্যে সব রকম যোগাযোগ কার্যত বন্ধই হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী পশ্চিম পাকিস্তানি ধনী ব্যক্তিদের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক বাড়ল।
ইয়াহিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এতই বৃদ্ধি পেল যে প্রতিদিনই নতুন নতুন গুজব ও তত্ত্ব তৈরি হতে থাকল। শেষে প্রায় বিনা ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরদিন থেকে ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। পরবর্তী ছয় দিন তাঁদের বৈঠক চলতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ এবং একই সঙ্গে আরও বেশি বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠতে থাকে।
শীর্ষ পর্যায়ে আপস-মীমাংসার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছিল। আবার অসহযোগ আন্দোলনও অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে স্থানে স্থানে সংঘর্ষ চলছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনই নতুন সেনা ইউনিট আকাশপথে পূর্ব পাকিস্তানে আসছিল। বিদেশি কূটনীতিকদের দেশ ছাড়ার হারও বেড়ে চলছিল।
শহরের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা নতুন নতুন চৌকি আর ক্ষুদ্র বাঙ্কার তৈরি অব্যাহত রেখেছিল। খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত নামে একটি জাহাজে করে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ এসে পৌঁছেছে। বেসামরিক প্রতিরোধের কারণে সেগুলো খালাসের অপেক্ষায় আছে।
বন্ধু আনোয়ারুল আলম তাঁর চাকরির সুবাদে অনেক বছর চট্টগ্রামে ছিলেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি তাই ওয়াকিবহাল থাকতেন। কয়েকবারই তিনি জানালেন, সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক অফিসার তাঁদের সৈনিকদের গোপনে গোপনে সংগঠিত করছেন এবং ঢাকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুমতি পেলেই তাঁরা বড় কিছু একটা করবেন।
ইয়াহিয়া খানের এই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা স্পষ্টতই সফল হয়েছিল। ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতারা কনফেডারেশনের নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আমন্ত্রণের জন্য সারা দিন প্রেসিডেন্ট ভবনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ঢাকা আক্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে চুপিসারে সন্ধ্যাবেলা ঢাকা ত্যাগ করেন।ইয়াহিয়ার সঙ্গে যেসব সামরিক অধিনায়ক ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কেও সন্দেহ গভীরতর হতে শুরু করে। কারণ, আপসরফার রাজনৈতিক আলোচনায় তাঁদের কোনো ভূমিকা ছিল না।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের প্রথম পাঁচ-ছয় দিনে বাইরে থেকে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। ২২ মার্চ সহসা খবর ছড়িয়ে পড়ে, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার কাছে তাঁর শাসনতান্ত্রিক দাবি আগের তুলনায় কঠোরতর করেছেন।
জানা গেল, এর আগে থেকেই কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) হল থেকে যেসব যুব ও ছাত্রনেতা সব ধরনের আপস-মীমাংসার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁদের চাপে কেন্দ্রীয় সরকারে অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে নতুন করে শেখ মুজিব কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াহিয়াকে চাপ দিয়েছেন। ফলে শঙ্কা সৃষ্টি হলো যে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে যেতে পারে।
শঙ্কাটি পরে ওই দিনই কিছুটা হ্রাস পায়, যখন ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছয়-সাতটি বৈঠকের পটভূমিতে সংশয়ী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব জোর দিয়ে বলেন, যথেষ্ট অগ্রগতি না হলে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যেতেন না। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা অত্যুৎসাহে দাবি করতে শুরু করেন, সামরিক সরকার তাঁদের কনফেডারেশনের প্রস্তাব প্রায় মেনেই নিয়েছে অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
পরদিন ২৩ মার্চ ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিশাল যৌথ সমাবেশে শেখ মুজিব নিজেও বলেন, যে নেতা বিনা রক্তপাতে তাঁর দাবি আদায় করে নিতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ নেতা।
তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর এ কথায় পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল যে সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তা শুধু স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। এসব বিবৃতি দেশের প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্রে ২৪ মার্চ প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এসব খবর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে আলোকিত অংশকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান তখন গুলশানের উত্তর প্রান্তে থাকতেন। আমার বাসা ছিল গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের পেছন দিকে। ২৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে তিনি আমার বাসায় এসে এক ঘণ্টা পর তাঁর বাসায় রাতের খাবারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমি সেখানে পৌঁছে দেখি ড.
প্রস্তুত করছিলেন।
তখনকার বিপরীতধর্মী নানা চিত্র লক্ষ করে আমি বিশাল ধাঁধার মধ্যে ছিলাম। একদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সামরিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও ঢাকার উপকণ্ঠ মিরপুরে সেনাবাহিনী ও অবাঙালিদের (বিহারি) সঙ্গে বাঙালিদের সংঘাতও হঠাৎ বেড়ে ওঠে। অন্যদিকে সরকারের মতিগতি পরিবর্তনের ফলে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ফলপ্রসূ হওয়ার খবরও আওয়ামী লীগ মহল থেকে মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকে।
এর আগে ২২ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান আমার বাসায় এসেছিলেন। সেদিন তিনি আমাকে ও অপরাপর অভ্যাগতদের যা বলেছিলেন, সেটা শুনে ব্যাপারটি তখন থেকেই আমার কাছে গোলমেলে মনে হয়েছিল।
ওয়ালী খান বলেছিলেন, সেদিন সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি প্রেসিডেন্টকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি (ইয়াহিয়া) যে অবস্থায় পৌঁছেছেন, সেখান থেকে বেরোনোর জন্য কোন পথে এগোতে চান। জবাবে ইয়াহিয়াও সরাসরি বলেন, তাঁর জন্য একটি পথই তো খোলা, আর তা হচ্ছে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাওয়া। ওয়ালী খান আমাদের বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে তিনি ইয়াহিয়ার এই উক্তি সঙ্গে সঙ্গেই অবহিত করেছিলেন।
ওয়ালী খান উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক কিংবদন্তি নেতা খান আবদুল গাফফার খানের ছেলে। তিনি নিজেও সত্যনিষ্ঠ অকপট পাঠান হিসেবে পরিচিত।
পরস্পরবিরোধী আশঙ্কা ও সম্ভাবনার এসব বিভ্রান্তি লাঘব করার জন্য আমি আওয়ামী লীগের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কামাল হোসেনের কাছ থেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার সুযোগটি গ্রহণ করি।
রেহমান সোবহানের বাসায় সেদিন যখন কামাল হোসেন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর টোকিও প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছিলেন, সালমা সোবহান ও হামিদা হোসেনও সেখানে উপস্থিত। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সংবাদদাতাকে কামাল হোসেন আশাব্যঞ্জক কথা শুনিয়ে বললেন, সেনাবাহিনীর উগ্র অংশটির চাপে পরিস্থিতি মাঝেমধ্যে অনিশ্চিত হয়ে পড়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সর্বশেষ প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই; তাঁকে সামরিক আইন তুলে নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; অবশ্য ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার সাময়িকভাবে পরিচালিত হতে পারে। ইতিমধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় সংসদকে প্রাদেশিক ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।
কামাল হোসেন জানালেন, এই সবকিছুর ভিত্তিতে আর এক-দুই দিনের মধ্যেই ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে চলেছে। কামাল হোসেনকে আমি আওয়ামী লীগের একজন মেধাবী নেতা বলেই মনে করতাম।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর পরিস্থিতি মূল্যায়নকে আমি সঠিক বলে গ্রহণ করতে পারিনি। দলের প্রধানের আশাবাদ তাঁকেও এভাবে প্রভাবিত করেছে দেখে কিছুটা বরং বিরক্ত হই। পুরোটা সময় আমি বিস্ময়ে নিশ্চুপ ছিলাম। কিন্তু সেই সংবাদপত্র প্রতিনিধি পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার মত জানতে চাপাচাপি করতে থাকে।
অবশেষে ভেতরে জমে ওঠা বাষ্প বের করে দিয়ে আমি বলি, পরিস্থিতি সম্পর্কে যা শুনলাম তা অনেকটা এ রকম: একজন লোক এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে পা পিছলে সবেগে নিচে পড়ে যাচ্ছিল; পড়তে পড়তে মাটির কাছাকাছি কোনো একটি তলার জানালায় একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল, ‘সো ফার সো গুড!’
২৪ মার্চের দিনটিতে সমঝোতার বিষয়ে ইয়াহিয়ার দেওয়া আশাবাদ দৃশ্যমানভাবে ফিকে হয়ে উঠতে শুরু করে। শেখ মুজিব তখন সংবাদমাধ্যমকে আবার বলেন, এরপর তিনি কোথায় থাকবেন তা জানেন না, কিন্তু সংগ্রাম অবশ্যই চলবে।
আমার মনে হয়েছিল, আমাদের কিছু অজানা বিষয় তাঁর বিচার-বিবেচনাকে তখন অনেকখানি প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। আর তাঁর নিজস্ব বিচার-বিবেচনাই ছিল তাঁর দলের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক।
আমার এ রকম সংশয়ের সত্যতা খুঁজে পাই বেশ কয়েক বছর বাদে, ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনার মূল দলিল, ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর একটি কপি দেখতে পাই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সেই গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ১৮ মার্চ।
সেই পরিকল্পনার একটি অবশ্যকরণীয় অংশে বলা হয়েছিল—সেখান থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘উচ্চতর পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। এমনকি শেখ মুজিবকে ধোঁকাও দেওয়া যেতে পারে। ভুট্টো রাজি না হলেও প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করবেন যে ২৫ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের দাবিদাওয়া মেনে নিতে চলেছেন।’*
ইয়াহিয়া খানের এই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা স্পষ্টতই সফল হয়েছিল। ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতারা কনফেডারেশনের নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আমন্ত্রণের জন্য সারা দিন প্রেসিডেন্ট ভবনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ঢাকা আক্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে চুপিসারে সন্ধ্যাবেলা ঢাকা ত্যাগ করেন।
তাঁর ঢাকা ত্যাগের সংবাদ বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারার পরও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রায় নিশ্চেষ্ট থাকেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় পাওয়ার পরও কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা উচিত, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও সংগঠনকে অবহিত করা বা নির্দেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
নির্দেশ পাওয়ার জন্য যাঁরা শেখ মুজিবের কাছে এসেছিলেন, তাঁদের সবাইকে বলা হলো শহর থেকে সরে যেতে। আর সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি নিজে রয়ে গেলেন আপন গৃহে। এমনই এক হতবিহ্বল পরিস্থিতির মধ্যে এ দেশের নিরস্ত্র জনগণের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম অহিংস আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ।
মঈদুল হাসান লেখক ও গবেষক
সিদ্দিক সালিক, উইটনেস টু সারেন্ডার, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ২২৮
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত র পর স র জন য হয় ছ ল কর ছ ল সরক র অবস থ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করল যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন, যাকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তান ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে।
নতুন করে উচ্চ মাত্রায় এই শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে উপস্থিত সাংবাদিকসহ সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্যের শুরুতেই ট্রাম্প বলেন, ‘আজ খুব ভালো খবর’ থাকবে। এ সময় দর্শক সারি থেকে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
এই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ অভিহিত করেন ট্রাম্প। নতুন শুল্ক আরোপকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, এই দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করছে।
ট্রাম্পের পাল্টা এই শুল্ক আরোপে ভারতের পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৪ শতাংশ।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ, তাইওয়ানের পণ্যে ৩২ শতাংশ, জাপানের পণ্যে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের পণ্যে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের পণ্যে ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের পণ্যে ১০ শতাংশ, ইসরায়েলের পণ্যে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের পণ্যে ১৭ শতাংশ, চিলির পণ্যে ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্কের পণ্যে ১০ শতাংশ, কলম্বিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে।
অন্যান্য যেসব দেশের পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ এবং মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
পাল্টা এই শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে থাকা ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ‘বন্ধু শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়’।
যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের বিদেশি গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব গাড়ি উৎপাদন করা হয় তার ৮০ শতাংশের বেশি সেদেশে বিক্রি হয়। আর জাপানে যেসব গাড়ি বিক্রি হয় সেগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি সেদেশে তৈরি হয়। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি বিক্রি হয় খুব সামান্য।
মার্কিন কোম্পানি ফোর্ড অন্যান্য দেশে খুব কম গাড়ি বিক্রি করে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, অন্য যে কোনো দেশে তৈরি মোটরযানের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে এবং এটা আজ মধ্যরাত থেকেই কার্যকর হবে।
শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, আজকের দিনকে আমেরিকান শিল্পের ‘পুনর্জন্ম’ এবং আমেরিকাকে ‘আবার সম্পদশালী’ করার দিন হিসেবে স্মরণ করা হবে।
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বাধার মুখে রয়েছে।
অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা আরও খারাপ অবস্থা তৈরি করেছে।
বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মেধাসত্ত চুরিসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ করেছেন তিনি।