বনরক্ষীদের ঘুষের বলি টেংরাগিরি বনাঞ্চল ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যভান্ডার
Published: 3rd, March 2025 GMT
বরগুনার তালতলী উপজেলার সংরক্ষিত টেংরাগিরি বনাঞ্চলের বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে বনের গাছ কাটতে দেওয়া এবং বনসংলগ্ন নদীতে অবৈধ খুঁটা জাল দিয়ে মাছ শিকারে সহায়তা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে ঘুষের টাকার দর-কষাকষি নিয়ে বনরক্ষীদের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর সরেজমিনে গিয়ে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
টেংরাগিরি বনাঞ্চলটি সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বনটি বরগুনার তালতলী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় বন স্থানীয়ভাবে ফাতরার বন নামে পরিচিত। পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী—দক্ষিণের এই তিন বড় নদ-নদী এখান থেকে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। দেশের নদ-নদীতে সাগর থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ৬০ ভাগ এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করে। এই বনাঞ্চলের ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দূরে গোড়াপদ্মা উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী এবং ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পাথরঘাটা উপজেলায় হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবস্থিত। বনাঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। মাছের প্রজনন ও চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে শত শত জেলে বন বিভাগকে ম্যানেজ করে ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে প্রতিদিন মাছ ধরায় একদিকে দেশের বিশাল মৎস্যভান্ডার শূন্য হচ্ছে, অপর দিকে হুমকির মুখে পড়ছে শ্বাসমূলীয় এই বনাঞ্চল।
জেলের সঙ্গে বনরক্ষীদের দর-কষাকষির ওই ভিডিওতে দেখা যায়, টেংরাগিরি বনাঞ্চলের নলবুনিয়া বিটের শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতে একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ওই বিটের জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এ সময় তিনি হায়দার মিয়া নামের এক জেলেকে বলেন, ‘ওই দেহি জাল পাতা, দেহি কার, তা পাতা এহন কোলোম কাটতে যামু, কতা সোজা বাংলা।’ উত্তরে ওই জেলে বলেন, ‘মোর জাল উঠাইয়া আনছি, কার তা জানি না।’ এ সময় পাশেই চেয়ারে বসা দেখা যায় নলবুনিয়া বিটের বনপ্রহরী জহিরুল হককে। জহিরুল হক বলেন, ‘ও (জেলে) কইতে আছে কি জানেন, আমাগো টাকা দেছে পনের শ।’ জাহাঙ্গীর হোসেনকে এ সময় বলতে শোনা যায়, ‘তুই (জেলে) কার কাছে টাকা দেছ? কিসের টাকা?’ উত্তরে ওই জেলেকে বলতে শোনা যায়, ‘জাল পাতি এই জন্য টাকা দিছি। প্রথমে আলমগীর ভাইয়ের হাত দিয়ে দিছি এক হাজার, পরে উত্তম বাবু (নলবুনিয়া বিটের বাগানমালি) হে আনছে ৫০০।’ এ সময় জাহাঙ্গীর হোসেন ওই জেলেকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘কথা বুজতে পারছ, এহোন এই সিজনে (মৌসুম) টাকা দেবা দুই হাজার, তা হইলে জাল পাতবা, না হইলে কথা এক্কেবারে কাটছিট।’
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীর হোসেন বন বিভাগের কেউ নন। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা ও বন বিভাগের হয়ে ঘুষের টাকা সংগ্রহ ও দেনদরবার করেন। ঘুষ নিয়ে দেনদরবার করা ব্যক্তি হায়দার মিয়া পেশায় জেলে। তিনি নলবুনিয়া এলাকার আবদুল হাই মিয়ার ছেলে। কথোপকথনের বিষয়ে হায়দার মিয়ার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারমু না। তাইলে বন বিভাগের স্যারেরা আমারে মামলায় ফাঁসাইবে।’
স্থানীয় অন্তত সাতজন জেলে জানান, এই বনসংলগ্ন তিন নদ-নদীতে কয়েক শ জেলে ছোট ফাঁসের খুঁটা জাল দিয়ে মাছ ধরেন। এ জন্য জেলেরা এই বনের গাছ কেটে এসব জালের খুঁটা তৈরি করেন। এ জন্য প্রত্যেক জেলেকে জালপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বনরক্ষীদের। তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া বিট কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।
টেংরাগিরি বনাঞ্চলের গাছ কেটে এভাবে সাবাড় করা হচ্ছে বন। নলবুনিয়া এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার তোলা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বনরক ষ দ র বন ব ভ গ এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
মনটা বাড়িতে পড়ে থাকলেও তাঁদের ঈদ কাটে বনে-বাদাড়ে
সারা দেশ যখন ঈদের আনন্দে ভাসছে, সবাই পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করছেন, তখনো দায়িত্বের ডোরে বাঁধা একদল মানুষ। তাঁরা পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেন না, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে ঈদের সেমাই খাওয়ারও সুযোগ হয় না। এমন মানুষের দলে আছেন সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বন বিভাগের কর্মীরা। সুন্দরবনকে ভালো রাখতে তাঁরা নীরবে নিজেদের ঈদ উৎসর্গ করেন।
সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো. মফিজুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘ভাই, মনটা পড়ে আছে পরিবারের লোকজনের কাছে আর দেহটা সুন্দরবনে। সবার ঈদ কাটে পরিবারে, আমাদের কাটে বনে-বাদাড়ে। আসলে চাকরির জন্য সবকিছু মেনে নিতে হয়। আজ ঈদের দিনেও টহল করছি। আমরা স্টাফরা মিলে একটি মুরগি জবাই করেছি। আর একটু সেমাই রান্না করে নিজেদের মতো করে ঈদ উদ্যাপন করছি।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ঈদের সময় চোরা শিকারি চক্র সুন্দরবনে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকারের অপতৎপরতা চালায়। তাই ঈদের সময় সুন্দরবনে বন বিভাগে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর ছুটি সীমিত করে কর্মস্থলে থেকে সার্বক্ষণিক টহলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সোমবার ঈদের দিন সকালে সুন্দরবনের বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়ির কয়েকজন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, তাঁদের ঈদ হচ্ছে সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তা ছাড়া সবাই একসঙ্গে ছুটিতে গেলে বনে নজরদারি করবে কে? পরিবারের সঙ্গে না থাকতে পারলেও বনের নিরাপত্তায় কাজ করছেন, এটাই তাঁদের জন্য বড় পাওয়া।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গহিন সুন্দরবনের নীলকমল এলাকায় আছেন ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। লোকালয় থেকে সেখানে পৌঁছাতে নৌযানে সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে। আটজন সহকর্মী নিয়ে সেখানেই ঈদ উদ্যাপন করছেন তিনি। বলেন, ‘আমার বাড়ি জামালপুরে। মা-বাবাসহ পরিবার সেখানেই থাকেন। আমার জঙ্গলে চাকরির গত পাঁচ বছরের অধিকাংশ ঈদ পরিবার ছাড়া জঙ্গলেই কেটেছে।’
ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ঈদের সময়ে সুন্দরবনে অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ কারণে ঈদের সময়টায় যাতে কেউ সুন্দরবনের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সারাক্ষণ টহলে থাকতে হয়। গতকাল রোববার সারা রাত টহল দিয়েছেন। সুন্দরবনের গহিনে হলেও এখানে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে। এ জন্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’
সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো. জুয়েল রানা বলেন, আজ পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে সবাই যখন ঈদ আনন্দ উপভোগ করছেন, ঠিক তখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা নির্জন বনে অবস্থান করছেন। জঙ্গলের মধ্যে বসে সেমাই খেয়েছেন। এখন আবার টহলে বের হতে হবে। পরিবার ছাড়া ঈদ করা খুবই কষ্টের। তবে মানিয়ে নিতে হয়। পরিবারের সদস্যরাও এখন বিষয়টি মেনে নিয়েছেন।
জুয়েল রানা আরও বলেন, ‘দুর্গম ও ভয়ংকর বনাঞ্চলে আমাদের সব সময় জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে বেতন ছাড়া অন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রেশন–সুবিধাও পাই না আমরা।’
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. আল-আমীন বলেন, তাঁর স্টেশনটি লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছেন। গহিন সুন্দরবনের মধ্যে পাতকোষ্টা, কাগাদোবেকি, গেওয়াখালী, আদাচাই, ভদ্রা, পাশাখালীসহ তাঁদের অনেক টহল ফাঁড়ি আছে। সেখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ওই সব জায়গায় যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা ঈদের নামাজও পড়তে পারেন না। ঈদের কয়েক দিন আগে লোকালয়ে এসে খাবার পানি আর বাজারসদাই নিয়ে যান। পরিবার ছাড়া বনে-বাদাড়ে বসেই হয়তো তাঁরা আজ নিজেরাই সেমাই রান্না করে খাচ্ছেন।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঈদের ছুটিতে সুন্দরবনের বনরক্ষীদের অধিকাংশই বাড়িতে চলে গেলে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে হরিণশিকারিরা ঈদের ছুটির কয়েকটা দিনকে নিরাপদ সময় মনে করছে। এ জন্য এবার ঈদে সুন্দরবনে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বনরক্ষীদের ছুটি সীমিত করা হয়েছে। বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ছুটি দেওয়া হয়নি। অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সুযোগ পেলেও বন বিভাগের অধিকাংশ কর্মী বনজ সম্পদ রক্ষার তাগিদে বনের গহিনে নির্জনে পরিবারবিহীন ঈদ করছেন।