‘আগামীকাল (আজ) তো মার্চের ৩ তারিখ, মনে আছে সেই দিনের কথা?’

লাহোরের লিবার্টি চকে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীকে প্রশ্নটা করা হলে কেউ তাৎক্ষণিক মনে করতে পারলেন, কেউ একটু সময় নিলেন। তবে মনে হওয়ার পর প্রত্যেকেরই স্মৃতিতে ফিরে এল ১৬ বছর আগের বিভীষিকা। ওই তো, পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে শ্রীলঙ্কা দলের বাস ওই রাস্তা দিয়ে লিবার্টি চকের দিকে আসছিল। তারপর…।

স্থানীয়দের কাছ থেকে তার পরের ঘটনা শুনতেই গতকাল দুপুরে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের অদূরের লিবার্টি চকে যাওয়া। ২০০৯ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৩ মার্চ লাহোরের এই জায়গাতেই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের টিম বাসে সন্ত্রাসীদের বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। গুলিবদ্ধ হন বাসে থাকা ক্রিকেটার থিলান সামারাবীরা, অজন্তা মেন্ডিস, থারাঙ্গা পারাভিতারানা, ৬ পুলিশ সদস্যসহ অনেকে। পরে সেদিনই বিশেষ ব্যবস্থায় মাঠ থেকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল পাকিস্তান ত্যাগ করে। গোটা ক্রিকেট–বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ওই ঘটনার পর প্রায় ছয় বছর আন্তর্জাতিক কোনো ক্রিকেট দল পাকিস্তানে খেলতে আসেনি।

আরও পড়ুনভারতকে যে ‘প্রথম’ উপহার দিলেন হেনরি১১ ঘণ্টা আগে

অন্তত তিনজন চাক্ষুষ সাক্ষীর কাছ থেকে কাল দুপুরে সরাসরি সেদিনের ভয়ংকর ঘটনাটি শুনলাম। তবে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ নাকি স্থানীয়দের বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। ক্যামেরা বা রেকর্ডারের সামনে তাই মুখ খুলতে রাজি হননি কেউ।

আহত শ্রিলঙ্কান খেলোয়াড়েরা ফিরে যাচ্ছেন দেশে.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণ প্রয়োজন

আশির দশকে জাতীয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। এখন আরও কয়েকটি পত্রিকার  পাঠক হলাম। আগের গুণীজন লেখকদের একজন  তাঁর একটি নিবন্ধে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, আমাদের জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণ করা গেল না।  অর্থাৎ আমাদের জাতীয় জীবনের কর্মবীরদের আমরা যথাযথ সম্মানের আসনে বসাতে পারি না। আজও তা অপ্রাসঙ্গিক। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য দলের শীর্ষ নেতানেত্রীকে  জানতে হয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে তাঁর  অপরাপর যোগ্যদের সন্মান  জানানোর  সক্ষমতা থাকতে হয়। আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে অনেক সময় সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাবে উদারতার পরিচয় মেলে না। আর  শীর্ষ নেতৃত্বের তৈল মর্দনকারী স্তাবকদের সদম্ভ উপস্থিতি এবং তাদের বাগাড়ম্বড়তা  ও স্তুতির  কারণে  জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণের কাজটি পথ হারায়। যেমন বিগত সরকারের শাসনামলে শীর্ষনেত্রীর তৈল মর্দন করতে গিয়ে এক পণ্ডিতপ্রবর নেতার মুখে শোনা গেল শান্তিতে নোবেল প্রদানের বিষয়ে অমিয় বাণী। 


আমাদের দেশে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসা বড় দুটি দল শীর্ষ নেতানেত্রীর স্তব গানে মশগুল থাকত অনেকে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, হাইকমান্ডের বাইরে অন্য নেতারা ও সেখানে অসহায়।  ১/১১ এর পূর্বে দুই দলের পক্ষ থেকে জননেতা আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার  সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মুখনিঃসৃত বাণী উভয়ের অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের  রিমোট কন্ট্রোল করার  ইঙ্গিতপূর্ণ উক্তি। এমনিতর অবস্থায় চলে দলের শিষ্য নেতৃত্বের খুশি করার প্রতিযোগিতা।  আরও চলে  মাত্রাতিরিক্ত মুজিব ও জিয়া বন্দনা। 


ক্ষমতাসীন হলেও একটি দলের নেতাকর্মীর সমর্থক সর্বোচ্চ শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। বাদবাকিরা তো আমজনতা। তারা ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ডকে করে সদা অবলোকন, তাদের নির্মোহ মূল্যায়ন মনে  হতে পারে অস্বস্তিকর। সেদিকে  কর্ণপাত করে নাকো কোনো দলাসক্ত দলান্ধ জন। গত বছর প্রায় এক মাস  আমার কলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলে সেখানে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাস, বিধান রায় চৌধুরী, সুভাষ চন্দ্রসহ সরাই বিরাজে।  সুভাষ চন্দ্র বসুসহ বিপ্লবীদের কে তারা বেশি করে মনে রেখেছে যারা ব্রিটিশ বিতাড়নে আত্মাহুতি দিয়েছে।  


একালে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, যার পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শিক সংঘাত ছিল। নাথুরাম গডসে  ছিলেন তাদেরই একজন, মুসলমানদের প্রতি দুর্বলতা ও নমনীয়তার অভিযোগে তাঁকে হত্যা করে। আজ কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপি ক্ষমতায় এসে সর্বভারতীয়  ওই নেতাকে জাতির জনকের সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। বিজেপি আবদুল কালামকে রাষ্ট্রপতি বানাতেও বিরোধিতা করেনি। জাতির স্বার্থে জাতীয় জীবনের অগ্রদূতদের  সম্মান দানে তারা একাট্টা।  আমাদের পতিত  স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা যাকে ভারতবর্ষ মিত্রভাবে তাঁর প্রশ্নে তারা সর্বদলীয় সভা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারল তারা  নিজ  স্বার্থেই হয়তো সে কাজটি করল। কিন্তু  স্বজাতির স্বার্থে সে ক্ষেত্রে আজ আমরা কোথায়? এত প্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।  যাহোক মহাত্মা গান্ধী স্বাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়তে চেয়েছেন, মুসলমানদের স্বার্থে উচ্চকিত হয়েছেন, ক্ষমতা গ্রহণ না করে হয়তো বিতর্কিত হননি অবিকৃত থেকেছেন।  পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বলেই হয়তো  বিতর্কিত হয়েছেন। তাই বলে কি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, সংগঠক ও স্থপতি  হিসেবে   উভয় নেতাকে কী  অস্বীকার করা যায় বা তাদের নাম কখনও  মুছে ফেলার অপচেষ্টা কী সমীচীন হয়? 


শেখ মুজিবুর রহমান যাদের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন,  যারা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে  দীক্ষাগুরু ছিলেন  যাদের দেখানো পথে তিনি অগ্রসর হলেন  সেই মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হককে জাতি ভুলে থাকে কী করে? শেরেবাংলা সেকালে কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র, ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী।  তেমনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত ডেপুটি মেয়র, ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার তিনিও  ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে আমরা জানি তিনিও  রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেননি।  তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগ গঠিত হলেও এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলেও তিনি পদ ও  ঢাকাতে একটি প্লট গ্রহণ করেননি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তাদের জীবন ও কর্মকে ভুলে থাকা আত্মপ্রবঞ্চনা ।


তাদের গঠিত দল ক্ষমতায় থাকলেও পরিবারতন্ত্র সেখানে প্রবল হওয়ায় তারা অপ্রস্তুত হয়েছেন,  ক্ষমতাসীন দলের শিষ্য নেতৃত্বের পূর্বপুরুষরাই কেবল সমাদৃত হয়েছেন। বেঁচে থাকলে এমন স্তুতিবাক্যের চর্বিত চর্বণে  তারা হয়তো লজ্জা পেতেন। পরপারে থেকে তারাও হয়তো  বিব্রতবোধ করে তাদের গুরুজনের সম্মান প্রত্যাশা করছেন।  ভারত রাষ্ট্রটি এই মুহূর্তে আমাদের স্বার্থবিরোধী হতে পারে কিন্তু তাদের জাতীয় ঐক্যের চেতনা নয় ফেলনা।  তাকে অবজ্ঞা করা চলে না।   কাউকে অবহেলা নয়, যার যা প্রাপ্য সম্মান তাকে তা বুঝে দিয়ে আমরা জাতীয় চরিত্র করতে পারি বিনির্মাণ ।  


মানবচিত্তের আনন্দ-বেদনা ও আশা-প্রত্যাশা যখন এক সঙ্গে কাজ করে, অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হয় তখন  মানবজমিনে ভালো রকমের ফসল ফলে।  ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাকে অতিক্রম করে জাতীয় স্বার্থে পরস্পরকে জয় করার বা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণের প্রসূতি। অর্থাৎ বহু মতপথের মানুষের ত্যাগ করা, অনৈক্যের মাঝে ঐক্য গড়ার সক্ষমতাই হতে পারে জাতীয় চরিত্র বিনির্মাণ করে ইতিবাচক সমাজ গঠনের প্রাণশক্তি। আজ জাতির জীবনে সে কাজটিকে অনিবার্য মনে  করি।


ড. মো. মোস্তাফিজার রহমান: অধ্যক্ষ (অব.) নওগাঁ সরকারি কলেজ।


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ