প্রশ্নটা আবার উঠেছে। কোনো পুরোনা প্রশ্ন নয়। কিন্তু প্রশ্নটির সমাধান হয়নি বলেই তা নতুন করে আসছে। প্রশ্ন আসলে একটি নয়, দুটি—কেন নারীর অবদানকে স্বীকার করা হয় না এবং কেন নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়? কয় দিন পরপরই ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণীর’ মতো প্রশ্ন দুটি উঠে আসে। সেগুলো উঠে এলেই আমরা একটু নড়েচড়ে বসি, দু–চারটে অঙ্গীকারের কথা আবার জোরেশোরে বলা হয়। তারপর আবার সবকিছুই ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’।

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দুটি আবারও উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘জুলাইয়ের নারীরা’ কোথায় হারালেন? এ প্রশ্ন করা হয়েছে নারীদেরই এক সমাবেশে। অথচ ছয় মাস আগে জুলাই অভ্যুত্থানে মেয়েদের বীরত্বগাথা কী করে ভুলি? কী করে ভুলি সেই মেয়েটির কথা, যে তার ভাইয়ের গ্রেপ্তাররোধে পুলিশের গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে সে গাড়ি আটকাতে চেয়েছিল? কিংবা সেই যে রিকশার ওপরের দুটি মেয়ে, যারা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দিচ্ছিল? কোনো সন্দেহ নেই যে জুলাইয়ের আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনে নারীদের অংশগ্রহণ বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন অনেকেই বলছেন, সার্বিকভাবে অভ্যুত্থানের পর নারীদের আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ‘জুলাইয়ের নারীরা’ কোথায় হারালেন?

অতি সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য আহূত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে কোনো নারীকে দেখা যায়নি বলে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ঐকমত্যটি কি তবে পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? পুরুষে পুরুষে ঐকমত্যই কি যথেষ্ট? আবার এ প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ভূমিকা নেওয়া উচিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তা একটা কথার কথা। সেই সঙ্গে এটাও তো ঠিক যে জাতীয় আয়ে নারীর গৃহকর্মের অবদানের কোনো স্বীকৃতি নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পুরুষ নারীর অবদানকে স্বীকার করে না?

শুধু নারীদের অবদানকে খাটো করা নয়, সেই সঙ্গে মেয়েদের অধিকার খর্ব করার ঘটনাও তো ঘটছে। কয় দিন আগে মেয়েদের ফুটবল খেলার ওপরে আঘাত এসেছে। মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সেবায় তাদের অভিগম্যতার অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেন পুরুষ নারীর অধিকার হনন করতে চায়? কেন পুরুষ নারীকে বন্দী করতে চেয়েছে চিরায়ত কাল ধরে?’ এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, অন্তর্নিহিতভাবেই পুরুষের দেহজ গঠন, মন–মানসিকতা, অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক ক্রমধারার কারণেই পুরুষ নারীর প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক ও নির্যাতক হয়ে ওঠে।

প্রথমত, নারী যেখানে মনোবলে বলীয়ান, পুরুষ সেখানে দেহবলে বলীয়ান। এটা তো জানা কথা যে দেহবলে বলীয়ান মানুষ তার পেশিশক্তি ব্যবহার করবেই এবং পুরুষ সেটা প্রতিনিয়ত করে। দেহবলই পুরুষকে উন্মত্ত করে, যুক্তিবিবর্জিত করে, সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। দেহবলকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে পুরুষের মনে একটি অহংবোধের জন্ম নেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নারীর মনোবল শক্তিশালী হওয়ার কারণে পুরুষের অহংবোধ ঠুনকো, ভঙ্গুর এবং খুব স্পর্শকাতর হয়। খুব অল্প কারণেই সে অহংবোধে আঘাত লাগে। সেই অহংবোধ থেকেই পুরুষ নারীর অবদানকে খাটো করার চেষ্টা করে এবং সেই সঙ্গে নারীকে শাসন করার সুতীব্র ইচ্ছা পুরুষ সামলাতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, পুরুষ বহির্মুখী ও অস্থির, যেখানে নারী অন্তর্মুখী ও স্থির। পুরুষ ভাঙতে চায়, নারী গড়তে চায়। পুরুষ ছুটে যেতে চায়, নারী ধরে রাখতে চায়। নারী যেখানে সবার কথা ভাবে, পুরুষ সেখানে বড় বেশি নিজের কথা ভাবে। স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত সেখানে অনিবার্য। এই পুরো দ্বন্দ্বে পুরুষ নারীকে তার ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখে। অতএব এমন বাধাকে তো শৃঙ্খলিত করতেই হবে পুরুষকে।

তৃতীয়ত, প্রথাগত ধারণার বিপরীতে বহু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটা প্রমানিত হয়েছে, নারী অনেক বাস্তববাদী ও যুক্তিনির্ভর, যেখানে পুরুষ অনেক বেশি স্বাপ্নিক ও আবেগপ্রবণ। সুতরাং পুরুষের অনেক অবাস্তব স্বপ্ন ও অপ্রয়োজনীয় আবেগ নারীর বাস্তববাদী যুক্তির ছুরিতে প্রায়ই খণ্ডবিখণ্ড হয়। এটা পুরুষকে ক্ষিপ্ত করে এবং তখন সে নারীকে বন্দী করার জন্য ব্রতী হয়।

চতুর্থত, জীবনধারায় নারী পুরুষকে পরিপূরক হিসেবে দেখে, কিন্তু পুরুষ নারীকে দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। এ–ও একটা কারণ, যার জন্য পুরুষ নারীর অবদানকে খর্ব করতে চায়। পুরুষের সমস্যা হচ্ছে, সে মনে করে, সে সব বিষয়ে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তার অসাধ্য কিছু নেই। অন্যদিকে নারী জানে, কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা। নারীর দুর্বলতা পুরুষের পরিহাসের বিষয়, আর তার শক্তি পুরুষের অস্বস্তির কারণ। সুতরাং সম্পূরক হতে পুরুষের প্রবল আপত্তি।

পঞ্চমত, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে। ভোগের পণ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তার মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে, তাকে শাসনে রাখতে হয় অবাধ্যতা নির্মূল করার জন্য, তাকে আটকে রাখতে হয় যখন খুশি তখন ভোগ করার জন্য।

নারীর ভেতরে হীনম্মন্যতা বোধ সৃষ্টি ও আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিবেশ পুরুষ সৃষ্টি করে নানাভাবে। ঘরের মধ্যে, কাজের জায়গায়, রাস্তাঘাটে, এককথায় ঘরে-বাইরে, নারীকে উত্ত্যক্ত করে পরিহাসমূলক কথার মাধ্যমে, ইঙ্গিতময় তথাকথিত ঠাট্টার দ্বারা, তাদের শক্তিকে অবজ্ঞা করে এবং তাদের দুর্বলতাকে আঘাতের কেন্দ্র করে, কথার মাধ্যমে তাদের প্রতিনিয়ত খাটো করে। উচ্চকিত স্বরে তাদের বলা হয় যে নারী বুদ্ধি-বিবেচনাহীন, তাদের কাজ মূল্যহীন, তারা দুর্বল ও সদাক্রন্দসী। এ অসম্মানের ভার নারী বহন করে প্রতিক্ষেত্রে, প্রতিনিয়ত।

শেষের কথা বলি। নারীকে অসম্মান করে পুরুষ বড় হয় না, সে আরও ছোট হয়ে যায়। নারীকে শৃঙ্খলিত করে পুরুষ বীর হয় না, তাকে মুক্ত করেই পুরুষ নমস্য হয়। নারীর অধিকার বিনষ্ট করে পুরুষ জয়ী হয় না, সে অধিকারকে নিশ্চিত করেই পুরুষ সম্মানিত হয়। তাই পুরুষ হিসেবে আমাদের কাছে আমাদেরই জিজ্ঞাস্য, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে পুরুষ?’ পুরুষ যদি সেটা না করে, তাহলে সে নিশ্চিত থাকতে পারে, নারীর কণ্ঠে সবলে উচ্চারিত হবে, ‘শুধু শূন্যে চেয়ে রব, কেন নাহি চিনে লব নিজে, সার্থকের পথ?’

সেলিম জাহান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র বল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আহ্বান গণ অধিকার পরিষদের

অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ও আস্থা ধরে রাখতে দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনসহ চারটি দাবিও জানিয়েছে তারা।

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরে আল রাজি কমপ্লেক্সে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে গণ অধিকার পরিষদ। এতে লিখিত বক্তব্যে পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর উল্লিখিত আহ্বান ও দাবি জানান।

গণ অধিকার পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেড় দশকের ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও আগামীর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু দেশি-বিদেশি অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের কারণে সেটি হয়নি। একটি নির্দিষ্ট বলয়কেন্দ্রিক সরকার গঠিত হয়েছে। ফলে গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল, আজ তাতে ফাটল ধরেছে।

সরকারের থাকা তিন ছাত্র উপদেষ্টার মধ্যে একজন পদত্যাগ করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ও জনগণসহ রাজনৈতিক নেতাদের আস্থা ধরে রাখতে সরকারে থাকা অন্য দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ সরকারে প্রতিনিধিত্বকারী সব ছাত্রের পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছি।’

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের দাবি, আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিচিত ছাত্র নেতাদের তদবির, নিয়োগ, টেন্ডার–বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অসংখ্য ঘটনা ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি গতকাল (জাতীয় নাগরিক পার্টি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেও জেলা প্রশাসকের নোটিশে ঢাকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মতো বিষয় দেখা গেছে। গাড়ি সরবরাহে মালিক সমিতি ও পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কোনো একক সংগঠন বা নেতাদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক নেতাদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ, ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। কাজেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী চেতনার বয়ানের মতো কোনো অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক ভাষ্য তৈরি না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

দেশের চলমান সংকট ও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে চার দফা দাবি জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। দাবিগুলো হলো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন। আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন। গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করা।

সংবাদ সম্মেলন গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ফারুক হাসান, শাকিল উজ্জামান, শহিদুল ইসলাম ফাহিম, ফাতিমা তাসনীম, জসিম উদ্দিন, মাহফুজুর রহমান খান, খালিদ হাসান, রবিউল হাসান, ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি মনজুর মোর্শেদ, শ্রমিক অধিকার পরিষদের সভাপতি আবদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউক্রেনের পক্ষে ৪টি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, লন্ডনে সম্মেলন শেষে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী
  • লন্ডন সম্মেলনে ইউক্রেনের পক্ষে চার বিষয়ে মতৈক্য
  • অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আহ্বান গণ অধিকার পরিষদের