‘গুলি করি। মরে একটা। আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।’ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এভাবে জুলাই গণহত্যার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এ ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। গত ৫ আগস্টের পর ওই ভিডিওর ঘটনাস্থলে থাকা প্রায় সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. আলমগীর হোসেনের হদিস ছিল না গত ছয় মাস।
কর্মস্থলে না এসে ও মন্ত্রীর পিএস পদে না থেকেও তিনি নিয়মিত বেতন তুলেছেন। এই সময়ে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তাঁর সম্পর্কে জানতে দুই মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও কিছু জানতে পারেনি সমকাল। অথচ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপপরিচালক করে প্রেষণে পদায়ন করা হয়। এর পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের পরিচালক পদে বদলি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে যারা ছিলেন, তারা কোথায়?
ভিডিওটি যখন করা হয়, সেখানে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল-মামুন, মন্ত্রীর পিএস মো.
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আসাদুজ্জামান ভারতে পালিয়ে গেছেন। সচিব, আইজিপি ও ভিডিওতে কথা বলা পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর নাখালপাড়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িটি স্থানীয় জনতা ঘিরে ফেলে। ওই বাড়িতে থাকা মন্ত্রীর পিএস আলমগীর দেয়াল টপকে পালান। এর পর থেকে তাঁর খোঁজ মেলেনি। এতদিন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
মন্ত্রী না থাকলে পিএস থাকেন কি?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস আলমগীর হোসেনের নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী যতদিন এ পদ অলংকৃত করবেন অথবা তাদের জন্য পদায়নকৃত পিএস ওই পদে বহাল রাখার অভিপ্রায় পোষণ করবেন, ততদিন এ নিয়োগ কার্যকর থাকবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিলুপ্ত হওয়ায় প্রজ্ঞাপনের শর্ত অনুযায়ী পিএসের নিয়োগ বাতিল হয়।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পিএস হিসেবে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বকাউলকে গত বছরের ২০ আগস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ সরকারি কর্মচারী বাতায়নে মো. আলমগীরকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রীর পিএস হিসেবে দেখানো হয়েছে। কর্মস্থলে উপস্থিত না হলেও ছয় মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হিসেবে বেতন তুলেছেন। গত ৬ আগস্ট থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করেও তাঁর হদিস পাওয়া যায়নি।
জনপ্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, গত ১৯ জানুয়ারি এই প্রতিবেদক আলমগীরের বিষয়ে জানতে চেয়ে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর উত্তরে ২৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে জানায়, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত হওয়ায় তথ্য প্রদান করা যায়নি।’
গত ৯ ফেব্রুয়ারি আলমগীরকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপপরিচালক করে প্রেষণে পদায়নের প্রজ্ঞাপনে তাঁর নামের নিচে লেখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়া। ফলে মন্ত্রণালয় তাঁর বিষয়ে তথ্য গোপনের চেষ্টা চালিয়েছে– তা স্পষ্ট।
পিএসকে ৬ মাসের বিরতি ভেঙে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া এবং সপ্তাহ না পেরোতে আরেক জায়গায় বদলি করা হয়। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের ইদানীং কয়েকবার বদলি করা হচ্ছে, যাতে তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
ছিলেন ডিসি ফিট লিস্টের তালিকায়ও
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নতুনদের বসাতে ফিট লিস্ট তৈরির উদ্যোগ নেয়। গত ২৯ আগস্ট সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যে তালিকা করা হয়, তাতে ১ নম্বরে ছিল আলমগীর হোসেনের নাম। পরে অবশ্য সেই তালিকা অনুযায়ী এগোয়নি সরকার।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
এ বিষয়ে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা উপসচিব আলমগীর হোসেন সমকালকে বলেন, ‘আমি নিরিবিলি মানুষ, পিএস হতে চাইনি কখনোই। পিএসগিরি করে তো আমার লাভ নেই।’ ছয় মাস পিএস হিসেবে বেতন নেওয়া এবং সরকারি বাতায়নে তথ্য হালনাগাদ না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের সরকার পতনের পরপর তো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছি। জনপ্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নতুন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অন্য অনেক কাজে থাকায় হয়তো এ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি। এ জন্য হালনাগাদ করা হয়ে ওঠেনি। এভাবে এতদিন চলেছে।’
দুই মন্ত্রণালয়ের একে অন্যের দিকে ঠেলে দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘এখানে তথ্য গোপনের চেষ্টা হয়নি।’ জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলে আসছেন, প্রশাসনে নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনাসহ জনপ্রশাসনে কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এ অবস্থায় ছয় মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত এবং কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পদায়ন অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে যায় কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে চাননি তিনি।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে বলেছে, তার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, তাই তথ্য দেওয়া যায়নি, তারা ঠিক বলেনি। মন্ত্রিত্ব যখন চলে গেছে, তখন তার আর স্বরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কাজেই জনপ্রশাসনের এটি বলার সুযোগ থাকে না। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হিসেবে বেতন নিয়ে থাকলে সেটিও সঠিক হয়নি।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণহত য আলমগ র হ স ন র প এস হ স ব কর মকর ত ন মন ত র ৫ আগস ট ন র পর ছয় ম স অন য য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে সচিবালয়ে শিক্ষার্থীরা
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে জাতীয় সচিবালয় এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তাঁরা আওয়ামী লীগসহ দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও জুলাই গণহত্যাসহ সব অপকর্মের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান।
আজ সোমবার বেলা ২টার পর শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নিতে শুরু করেন। তবে সচিবালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকায় পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরে যেতে অনুরোধ জানালে শিক্ষার্থীরা রাস্তার বিপরীত পাশে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন।
অবস্থান কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীদের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল আইন উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিতে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ। দলে আরও রয়েছেন সাদিক আল আরমান, রাফিদ এম ভুইয়া, সালেহ মাহমুদ রায়হান এবং মাসুদ রানা।
স্মারকলিপি দিতে সচিবালয়ে প্রবেশের আগে মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এর আগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার দাবি জানিয়েছি। আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের সব অপকর্মের বিচার চেয়েছি। কিন্তু, সরকার কর্ণপাত করেনি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চান না, এটিকে সমীচীন মনে করেন না। সর্বশেষ ফরমাল প্রক্রিয়া হিসেবে আমরা স্মারকলিপি নিয়ে এসেছি। এরপরও দাবি আদায় না হলে আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।’
মোসাদ্দিক জানান, তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন এলাকার গ্রুপকে এক করার চেষ্টা করা হয়েছে। আন্দোলন শুরু করার প্রক্রিয়া হিসেবে স্মারকলিপি নিয়ে আসা হয়েছে। দাবি মেনে না নিলে শিগগিরই পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।