কট্টরবাদীদের জয়ে জার্মানির ভবিষ্যৎ কোন দিকে
Published: 2nd, March 2025 GMT
বর্তমানে জার্মানি ও ইউরোপে নব্য নাৎসি বা কট্টর জনতুষ্টিবাদীদের মূল জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘শরণার্থী আর অভিবাসী হটাও’। একসময় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা শত বছরের বেশি সময় ধরে এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। তারা এসব দেশে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধে মদদ দিয়ে সেখানকার মানুষকে গৃহহারা করেছে। অথচ এখন তারা শরণার্থী ও অভিবাসীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ইউরোপে রাজনীতি করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, অ্যাডলফ হিটলারের গঠিত ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দল’ (এনএসডিএপি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই দলের আদর্শ ও কর্মসূচি ছিল উগ্র জাতিবিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল দলগুলোর বিরোধিতা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দলটি জার্মানির একমাত্র অনুমোদিত দল ছিল এবং তথাকথিত তৃতীয় রাইখের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল।
প্রায় ৮০ বছর পর জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচনে সেই আদর্শের অনুসারী কট্টরপন্থীরা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। জার্মান পার্লামেন্টের ৬৩০টি আসনের মধ্যে নব্য নাৎসি কট্টরবাদী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন পেয়েছে। যদিও তারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তবে দলটি পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন জার্মানিজুড়ে অভিবাসনবিরোধী দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা গণতান্ত্রিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা এএফডির সঙ্গে কোনো ধরনের জোট গঠন না করে। তবে এসব প্রতিবাদ সত্ত্বেও দলটির উত্থান ঠেকানো যায়নি।
জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার করোনা-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সমস্যা ও মুদ্রাস্ফীতি, তিন দলের জোটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব, জলবায়ু নীতি নিয়ে বিতর্ক এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ—এসব কারণে শলৎজের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।
নির্বাচনের পর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস জার্মান অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য ক্ষমতাসীন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের লজ্জাজনক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক এএফডির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেলের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও শেয়ার করেন। জার্মান রাজনীতিবিদরা একে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।চার বছর আগে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ও সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি ও ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি মিলে তিন দলীয় জোট সরকার গঠন করে। তবে জোটের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি সরকার থেকে বেরিয়ে গেলে ওলাফ শলৎজের সরকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এই কারণেই জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচন ছয় মাস এগিয়ে আনা হয়।
নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ ও সিএসইউ) ২০৮টি আসন, অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ১২০টি আসন, গ্রিন পার্টি ৮৫টি আসন এবং বাম দল দ্য লিংকে ৬৪টি আসন পেয়েছে।
এএফডির উত্থানের পেছনে জার্মানির দুই প্রধান দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভুল নীতি কাজ করেছে। শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ে তাদের অবস্থান অনেক সময় অস্পষ্ট ছিল। নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরে মাগডেবুর্গে একজন সৌদি নাগরিকের ক্রিসমাস মার্কেটে হামলা এবং নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে একজন আফগান নাগরিকের হামলা কট্টরপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী প্রচারকে আরও জোরদার করেছে। অর্থনৈতিক সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি দলটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।
বর্তমানে জার্মানির বড় অংশ এএফডিকে একটি ‘স্বাভাবিক’ দল হিসেবে দেখছে। জরিপে দেখা গেছে, এএফডির সমর্থকেরা অভিবাসীদের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সম্প্রতি জার্মান অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউ) একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৩ সময়কালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে রপ্তানি এখন আর জার্মান অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি নয়। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা জার্মানির অর্থনীতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য ক্ষমতাসীন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের লজ্জাজনক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক এএফডির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেলের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও শেয়ার করেন। জার্মান রাজনীতিবিদরা একে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গ্রিন পার্টি একটি শক্তিশালী জোট সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে। সম্ভাব্য নতুন চ্যান্সেলর হতে যাচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস। এখন দেখার বিষয়, নতুন সরকার জার্মানির চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পারে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শলৎজ র এএফড র র জন ত সরক র দলট র
এছাড়াও পড়ুন:
বিচার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দাবি
সাভারে রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পূর্ণ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। ক্ষোভ আর কান্নায় নিহতদের স্মরণ করা হয়েছে। এ ঘটনার বিচার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন চেয়েছেন নিহতের স্বজন, আহত ব্যক্তি ও বিশিষ্টজন।
সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। সকাল ৭টায় বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে এসে শেষ হয়। পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার শ্রমিক আন্দোলন, গার্মেন্টস টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন ও গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র শ্রদ্ধা জানায়।
এ সময় টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির আয়োজনে রানা প্লাজার সামনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিদেশি সংস্থাগুলো উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে চাইলে শেখ হাসিনা রাজি হননি। এ সময় তিনি এই দিনটিকে জাতীয় শ্রমিক দিবস ঘোষণার দাবি জানান।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘ভবন মালিক এক যুগ ধরে জেলে আছেন, বিচারকাজ শেষ হয়নি। কারখানা মালিকরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক যুগেও জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী শ্রমিক শিলা বেগম। তিনি জানান, সেদিন তার ডান হাতের রগ কেটে যায়। পেটে ভিম পড়ে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। ভেঙে যায় মেরুদণ্ড। এখন অন্যের সহায়তায় বেঁচে আছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারছেন না। তাদের পুনর্বাসন করা না হলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনে বসবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
দোষীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আরেক শ্রমিক ইয়ানুর বলেন, ‘আমরা আর্থিক সহযোগিতা, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন চাই।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুব আলম ইসমাইল বলেন, রানার জায়গা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আহত এবং নিহত শ্রমিক পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে।
ক্ষতিপূরণ পাওয়া শ্রমিকের অধিকার
ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের আজীবন আয়ের মানদণ্ডে ক্ষতিপূরণ পাওয়াকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে ‘কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কনভেনশন ২০২৫’ অনুষ্ঠানে তারা এ দাবি জানান। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের উদ্যোগে এ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুলের পরিচালনায় কনভেনশনে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী। বক্তব্য রাখেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ, মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, স্কপের যুগ্ম সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন, চৌধুরী আশিকুল আলম, এনসিসিডাব্লিউইর চেয়ারম্যান বাদল খান, জিআইজেড সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের সদস্য সচিব সিকান্দার আলী মিনা প্রমুখ।
দ্রুত বিচার চায় আইবিসি
দায়ীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ আট দফা দাবি তুলে ধরেছে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)। নেতারা বলেছেন, রানা প্লাজা নিছক ভবনধস নয়, এটি ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শিল্প কাঠামোর প্রতীক। এই ভবন ধসের ১২ বছর পরও শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কণ্ঠস্বর এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গতকাল ডিআরইউ মিলনায়তনে আইবিসি আয়োজিত ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছর, শ্রদ্ধা, উপলব্ধি ও করণীয়’ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইবিসির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন। উপস্থিত ছিলেন আইবিসির সভাপতি তৌহিদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক মারা যায় এবং আহত হয় প্রায় ২ হাজার শ্রমিক।