রংপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা নাহিদ হাসানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
Published: 2nd, March 2025 GMT
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর শাখার মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকারের চাঁদাদাবির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগর শাখার মুখ্য সংগঠক আলী মিলনের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, আপনার (নাহিদ হাসান খন্দকার) বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে অবৈধ বালু উত্তোলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির অভিযোগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগরের সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন ওঠে।
সেখানে আরও বলা হয়, বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না। অতএব, অভিযোগ বিষয়ে কেন আপনার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, নোটিশ পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে কারণ ব্যাখ্যা করে নিম্ন স্বাক্ষরকারীর (মুখ্য সংগঠক আলী মিলন) কাছে পৌঁছাতে হবে। নতুবা বিষয়টি সাংগঠনিক নিয়মে নিষ্পন্ন করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর শাখার মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকারের চাঁদা দাবির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ২ মিনিট ৪১ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপে নাহিদকে দেখা গেলেও অপর পাশে থাকা ব্যক্তিকে দেখা যায়নি। এতে এক বালু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তবে নাহিদ বলছেন তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
একটি পুকুর খনন করে বালু উত্তোলন ও পার্ক নির্মাণের বিষয়ে ভিডিওতে কথা হয়। নাহিদকে উদ্দেশ করে এক ব্যক্তি বলেন, ‘তুমি যদি বলো সেখানে বালুর ব্যবসা হচ্ছে, তাহলে সেটা বন্ধ করে দিই। ১ লাখ টাকা দিতে পারব না, ৫ হাজার টাকা দিচ্ছি।’ এ সময় নাহিদ বলেন, ‘ব্যবসা আপনি বন্ধ করবেন কেন, ব্যবসা আপনি চালান। ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। প্রয়োজনে সময় নেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি তো দেখছেন বিষয়টি কোথায় গেছে, ইউএনও-ডিসিকে সামলাতে হচ্ছে। যদি মনে হয় কিছু কমাবেন, তাহলে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। আমি চাই না আপনাদের কোনো সমস্যা হোক। জানেন তো সংগঠন চালাতে হলে কী কী করতে হয়।’ এই ভিডিও শনিবার সকাল থেকে ভাইরাল হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে কল করা হলে নাহিদ বলেন, ‘রংপুর নগরীর হাজিরহাট এলাকায় একটি ইকো পার্কের নামে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে আমরা চারজন সেখানে যাই। আমার উপস্থিতি দেখে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত বেলাল নামে এক ব্যক্তি নগরীর শিমুলবাগ কমিউনিটি সেন্টারে আসতে বলে। আমি সেখানে গেলে তারা বিভিন্নভাবে আমাকে টাকার অফার করেছিল, যা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে। আমরা যেন তাদের ব্যবসায় হাত দিতে না পারি, সে জন্য আমাদের ফাঁসাতে তারা এই কাজটি করেছে।’
এ ব্যাপারে গ্রিন সিটি ইকো পার্কের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমার পার্কে পুকুর তৈরিতে খনন কার্যক্রম চলছিল। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হচ্ছে বলে নাহিদ আমার কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। এ ছাড়া তার চাঁদাদাবির অনেক কলরেকর্ড আমার কাছে আছে, যা দ্রুত প্রকাশ করা হবে।’
গত ২৪ নভেম্বর রংপুর মহানগরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ মাস মেয়াদি আহ্বায়ক কমিটি প্রকাশ করা হয়। এতে রংপুর ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী নাহিদকে মুখপাত্র করা হয়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় ঐক্য যে কারণে জরুরি
ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা, নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং মাঝেমধ্যেই সামরিক হুমকি-ধমকি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার আগ্রাসী প্রবণতা এবং বাংলাদেশবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীকে অবৈধভাবে ভারতে আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার সামর্থ্য কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। কোনো একক রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেও সর্বগ্রাসী এই সুনামি রুখে দেওয়া কঠিন হবে। হয় তারা ভারতের হাতের পুতুল হয়ে আগের সরকারের মতো আত্মঘাতী চুক্তি সই করবে, বাংলাদেশকে ভারতের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করবে অথবা কঠোর হতে গিয়ে ব্যর্থ সরকারে পর্যবসিত হবে। এমন শক্তি মোকাবিলা করার জন্য দরকার সুদৃঢ় দেশপ্রেম, জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্ববরেণ্য কোনো ব্যক্তির নেতৃত্ব।
আজ বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি না থেকে অন্য যে কেউ থাকলে বাংলাদেশকে উগ্র মৌলবাদী দেশের তালিকায় ফেলে দেওয়া হতো। এই লক্ষ্যে ভারতের মদদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, কিন্তু ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং সততার কাছে সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের কথা কখনোই অবিশ্বাস করেন না। তিনি যা বলেন তা-ই তারা গ্রহণ করেন। এটি আমাদের বড় সৌভাগ্য।
এবার রমজানে সম্ভবত গত ৫৪ বছরের বাংলাদেশে এই প্রথম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমেছে, মানুষ স্বস্তিতে আছে। এখানেও আওয়ামী লীগের কর্মীরা সরকারের সততা ও আন্তরিকতার প্রশংসা না করে সমালোচনা করছেন। বলছেন, এত দাম কমে গেলে কৃষক মারা যাবে। কেউ বলছেন, এ বছর মার্চে রোজা হওয়ায় শীতের সবজি এখনও বাজারে আছে, উৎপাদনের মৌসুমে রোজা হয়েছে বলেই কৃষিপণ্যের দাম কম। কিন্তু মার্চ মাসে তো রোজা আরও হয়েছে, প্রতি ৩৫-৩৬ বছরে একবার রোজা পুরো বছর ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসে। কই আর কখনও তো এমন হয়নি।
দাম কমার কারণ দুটি। প্রথমত, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াত যেসব মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যাবসায়ী-সিন্ডিকেট, সেটা ভেঙে পড়েছে। সরকারের সততা এবং সদিচ্ছার কারণেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি খুব ইন্টারেস্টিং, এটা কেউ ভেবে দেখেননি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, মানুষের হাতে ছিল মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ অর্থ। এই অবৈধ অর্থের একটা আগ্রাসী ক্রয়ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো বাজারে। দুর্নীতি কমে আসায় কৃত্রিম চাহিদা এখন বাজারে অনুপস্থিত। কৃষিপণ্যের দাম কমে গেছে, কৃষক মরে যাচ্ছে– এই হা-হুতাশ যারা করেন, তাদের জন্য বলি, আগেও আমরা দেখেছি কৃষক মাথায় করে বাজারে এক টুকরি টমেটো এনেছে, বিক্রি করতে না পেরে বাজারেই ঢেলে ফেলে দিয়ে গেছে, কারণ দাম এত কম যে বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিতেও চায়নি তারা। তখনও কিন্তু শহরের বাজারগুলোতে টমেটোর দাম কমেনি। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দাপট ছিল তীব্র।
আওয়ামী লীগ দাবি করে তাদের ও অঙ্গসংগঠনের কর্মী সংখ্যা কোটির ওপরে। হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাসহ প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ৪৫ হাজারের সঙ্গে আরও অনেকেই অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবেন। তাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে তৈরি করবে, যাতে তারা আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসাতে পারে। দেশের ভেতরে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা ক্রমাগত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করবেন। অতীতের মতো কখনও বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়বেন, কখনও লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালাবেন, শাহবাগী গ্রুপ, ব্লগার গ্রুপ তৈরি করবেন, কখনও ভবনে আগুন দেবেন। এসব নাশকতামূলক কাজ তারা করতেই থাকবেন। এই দ্বিমুখী অরাজকতা এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করা কোনো একক রাজনৈতিক দলের সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
ঠিক এ রকম এক সময়ে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির একটি ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি চীন এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গে কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে।
বৃহৎ ঐক্য টেকসই হবে তখনই যখন ঐক্যবদ্ধ শক্তির সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তাহলে ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। এমনকি কোনো জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার পরেও এই ঐক্য টিকবে না। টেকসই ঐক্য গড়তে হবে একটি জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে।
আমার প্রস্তাব হলো, সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এক হয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হোক। সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি থাকবেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ ১৫ জন, জামায়াতে ইসলামী থেকে ১০ জন, এনসিপি থেকে ১০ জন, অন্যান্য দল থেকে ১৫ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী থাকবেন। এই ৫০ জনের ক্যাবিনেট আগামী পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করবে। মন্ত্রিপরিষদের ওপরে একটি সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। প্রতিটি জেলা থেকে দু’জন প্রতিনিধি, সব রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রিপরিষদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশপ্রধানকে নিয়ে গঠিত হবে সুপ্রিম কাউন্সিল। এই কাউন্সিল জাতীয় সরকারে পার্লামেন্টের ভূমিকা পালন করবে। তবে শুধু রুটিন কাজের বাইরে রাষ্ট্রীয় বড় ইস্যুগুলোতে সুপ্রিম কাউন্সিল মিটিংয়ে বসবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে।
এই পাঁচ বছরের মধ্যে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে হত্যকাণ্ড ঘটানোসহ তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা এবং খুন, গুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ সব অপরাধের বিচার করাও সম্ভব হবে। এরপর একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বাংলাদেশে পুনরায় পার্টি পলিটিকস শুরু করা যাবে।
এই পাঁচ বছরে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো যাবে, বিদেশ নীতিও একটি সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় উঠে যাবে।
কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা