নতুন দলকে নতুন যে রাজনীতি দিতে হবে
Published: 2nd, March 2025 GMT
জনগণের শক্তিকে ভয় পাওয়া অশুভ শক্তি নিজেদের অপকর্ম এবং অন্যায় অবস্থানের জন্য অপরাধবোধ প্রকাশের সৎ সাহস রাখে না। তারাই ইদানীং সমাজের চোরাগলিতে বলাবলি করছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের অবস্থা কী যে হয়ে গেল!
আজকের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, প্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা, রাজনৈতিক অবসাদ এবং সামাজিক অবক্ষয় যে পতিত সরকারের সৃষ্ট এবং রেখে যাওয়া, তা স্বীকার করা দূরে থাক, বিবেকহীনরা তা বুঝতে নারাজ।
যেন হত্যাকাণ্ড, মেগা দুর্নীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি বা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো ঘটনা ঘটেইনি বিগত আমলে! অজ্ঞাত স্থান থেকে কুকর্মকারীদের প্রতিশোধ ও নাশকতার ভার্চ্যুয়াল হুমকি বলে দেয় ক্ষমতার রাজনীতিতে কতটা ভয়ংকর এই ফ্যাসিবাদী শক্তি।
তবু ‘অন্ধকার যুগ বনাম নতুন সম্ভাবনার অনিশ্চিত সময়’ নিয়ে কোনো বিতর্কে আওয়ামী চেতনার ধ্বজাধারীদের যুক্তি অকাট্য হলে তা এত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা কেন বন্ধুরা?
কারণ, ওটাই পুরোনো রাজনীতির নমুনা: নিজের মিথ্যা আড়াল করো এবং আরেকজনের সত্যকে অস্বীকার করতে থাকো; ফলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হবে, প্রতিপক্ষও ভিলেন বনে যাবে। কী সহজ সমীকরণ নির্ণয় করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ! বিএনপি-জামায়াতকে গালাগাল দাও, ক্ষমতায় টেকার নাটক সাজাও।
তিন তিনটি জোচ্চুরির জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার পর ২০২৪-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকার এক সমাবেশে জবরদখলকারী প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটে অংশ নিয়েছে।
বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাঝেও তারা নিজের ভোট নিজে দিয়েছে।’ তাঁর নির্লজ্জ মিথ্যার রাজনীতি ও রাজত্ব শেষ হয় সংক্ষুব্ধ জনতার চূড়ান্ত প্রতিরোধে। ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু এক দিনের ঘটনা নয়, সেটি ছিল নতুন রাজনীতির সূচনালগ্ন।
হাসিনার বিদায়ের অন্যতম সুফল হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি এবং সংস্কারের মাধ্যমে তার উপযোগী পরিবেশ তৈরির তাগিদ।
ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ অবশ্যই আরেকটি ধাপ। এসব বিষয়ে আমরা যে নানা তর্ক-বিতর্ক করছি, সেটি পর্যন্ত অসম্ভব ছিল ফ্যাসিবাদী যুগে। সুতরাং ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। ওই কবিতার মতোই বাংলাদেশ এখন নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে, তা সবাই দেখুক না দেখুক। ‘আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে/ তারপর খুলে-/ মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে/ তারপর তুলে-/ যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে/ যেন না ফেরে।’
যাহোক আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিকেরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না।কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চাননি পুরোনোয় ফিরে যেতে। আমরা ২০২৪-এর আগস্ট-পূর্ববর্তী আমলের রাজনৈতিক ধারায় ফেরার ওকালতি করব কোন মুখে? যে রাজনীতি ছিল মিথ্যুকের বন্দনা, দুর্নীতিবাজের আরাধনা, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দান, ভণ্ডের অশ্রুবিসর্জনের সার্কাস প্রদর্শন, গণশত্রুর শাসন নির্বিঘ্ন এবং চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা, নিষ্ঠুরের জয়গান গাওয়া আর শোনা, বর্বরের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান; সে রাজনীতিতে আমরা কেন ফিরব?
আসলে এই শতাব্দীর শুরুতে একশ্রেণির রাজনীতিকদের নীতিহীন কর্মকাণ্ড ও বিরাজনীতিকীকরণে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্যেই চালাকি, বজ্জাতি আর ভয় দেখানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে মানুষ ভেতরে-ভেতরে প্রত্যাখ্যান করে পুরোনো রাজনীতি অচল হয়ে পড়েছিল অনেক আগেই।
কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিপ্লব ঘটায়, রক্তের অক্ষরে লিখে তুলে ধরে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা। তারপরও সেকেলে মানসিকতার রাজনীতিকদের অপ্রাসঙ্গিকতা আরও পরিষ্কার হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জমানায়। কী বয়ান নিয়ে রাজনীতি করবেন যেখানে দলীয় সরকার নেই, নেই রাজনৈতিক মাঠের সংজ্ঞায়িত শত্রু? তাই কিছু আওয়ামী প্রলাপ এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এখানে-সেখানে।
সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত নতুন রাজনীতির ধারণাটা কী হতে পারে? ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের সমমর্যাদা, সম্ভাবনার বিকাশ, সত্য, শান্তি, সৌহার্দ্য, ন্যায়নিষ্ঠতা, নিয়মকানুন বা সভ্য মূল্যবোধ অনুসরণের জন্য কাজ করবে যে রাজনীতি, তা-ই হয়তো আজকের প্রজন্মের প্রত্যাশা।
২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে যে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরে, তার চ্যালেঞ্জ হবে জনগণকে বিকল্প রাজনীতির মডেল উপহার দেওয়া। পরিবর্তিত সংস্কৃতির দলটি প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি করবে না, কাজ করবে দেশ ও জনগণের চলমান ও ভবিষ্যৎমুখী নানা ইস্যু নিয়ে। সে দলের সব কর্মকাণ্ড হবে স্বচ্ছ এবং নেতৃত্ব সর্বদা অনুসরণ করবে গণতান্ত্রিক পথ। এই আমাদের প্রত্যাশা।
এই দলকে আমরা সেই জায়গায় দেখতে চাই না, যে দল নতুন রাজনীতির ‘সোল এজেন্ট’ হিসেবে নিজেকে দাবি করে বসবে না বরং রাজনৈতিক বিতর্কে ন্যায্য দাবি বা যুক্তি মেনে নিতে নমনীয়তা দেখাবে।
অন্যদিকে আমাদের সেই রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার, যেখানে যে বা যারা বারবার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত করেছে এবং জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই দলের নাম যা-ই হোক, তার ভাবী গণতন্ত্রে রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না।
বিগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলেরও নতুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলা এবং জাতীয় সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ না থাকার কারণ নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াও আধুনিক মানুষ পরিবার, প্রজন্ম, প্রতিবেশ, পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, নৈতিকতা, জনকল্যাণের সামাজিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে চিন্তিত। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ ও বাগাড়ম্বর বাদ দিলেও রাজনীতিকদের ইস্যুর কোনো অভাব হওয়ার কথা নয়।
দেশবাসী আশা করে, রাজনীতি হবে তাদের কল্যাণে এবং রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যা ও মনের ভাব দ্রুতই বুঝতে পারবেন। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এমনটা ছিল না।
যাহোক আমরা যদি ইচ্ছাশক্তি ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নতুন রাজনীতি সমাজ ও জাতিকে আগামীর পথ দেখাবে, রাজনীতিকেরা সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন। এর অন্যথা জনগণের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র র জন ত ক জনগণ র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
রন হক সিকদারের নামে থাকা ১০০ একর জমি জব্দের আদেশ
এবার শিল্পগোষ্ঠী সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদারের নামে পূর্বাচলে বরাদ্দ দেওয়া ১০০ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন আজ সোমবার এ আদেশ দেন।
দুদক আদালতকে বলেছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নামে–বেনামে জনগণের আমানতের অর্থ লুটপাটসহ ঘুষের বিনিময়ে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। সেই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ১৯ নম্বর সেক্টরের ১০০ একর জমি রন হক সিকদারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংয়ের নামে বরাদ্দ দেওয়া। এই জমিতে ১০০ থেকে ১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করার অনুমোদন দেয় রাজউক। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়া হয় তিন হাজার কোটি টাকায়। মাত্র ২৭০ কোটি টাকার একটি কিস্তি দিয়ে ওই সম্পদ নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে দখলের নেন রন হক সিকদার।
দুদক আদালতকে আরও জানিয়েছে, রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই রন হক সিকদারের প্রতিষ্ঠান সেখানে তিনতলা একটি ভবন নির্মাণ করছিল। ভুয়া তথ্য দিয়ে ১১০ কোটি টাকার ঋণ নেয় রন হকের প্রতিষ্ঠান। পরে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই ১০০ একর সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টের আগপর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বেশির ভাগ ছিলেন সিকদার পরিবারের সদস্য। তাঁরা তখন ব্যাংকে থাকা জনগণের আমানতের হাজার হাজার কোটি টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দিয়ে পাচার করেছেন।
এর আগে গত ৯ মার্চ রন হক, তাঁর মা মনোয়ারা সিকদারসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ৪২টি বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।
দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে আরও জানানো হয়, সিকদার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা বিদেশে থেকে বিও হিসাবগুলো হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন।
এর আগে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সিকদার গ্রুপের রন হক, তাঁর মাসহ তাঁদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের নামে থাকা মোট ১৫টি ভবন ও ফ্লোর জব্দের আদেশ দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার। ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই রিক হক সিকদার। তাঁরা জনগণের আমানতের অর্থ আত্মসাৎ করে নিজেদের, পরিবারের সদস্যদের ও নিকট আত্মীস্বজনের নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ গড়েছেন। এমনকি তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির বিপুল অর্থ লুট ও বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।