এনসিপির লক্ষ্য দেশজুড়ে জনভিত্তি ও ভোট
Published: 2nd, March 2025 GMT
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই দেশজুড়ে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটাতে চাইছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতাদের নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচন লক্ষ্য বললেও চলতি মাসেই জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে ভোটের মাঠে থাকবে এনসিপি। জনসমর্থন আদায়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নেবে। ভারতীয় ‘আধিপত্যবাদ’বিরোধী স্বরও চড়া রাখবে। অব্যাহত রাখবে আওয়ামী লীগের প্রতি অনমনীয়তার নীতি।
ডান, বাম, শিবির, কওমিসহ বিভিন্ন ধারা থেকে আসা তরুণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থি বললেও মধ্য ডানপন্থি আদর্শ ধারণ করবে বলে দলটির নেতা এবং সূত্র জানিয়েছে। পরিচিত করাবে বাংলাদেশপন্থি হিসেবে।
এনসিপি নেতারা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও চাঁদাবাজি, দখল ও দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়ে গেছে, যার অধিকাংশ অভিযোগ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। নির্বাচনের মাঠে দলটিকে মোকাবিলায় এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান ও জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাবে। গ্রামগঞ্জে ইস্যুগুলো নিয়ে যাবেন এনসিপির নেতারা।
গত শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বড় জমায়েতে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপি সেদিন রাতেই পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে গতকাল শনিবার পর্যন্ত দিতে পারেনি।
প্রথমে পরিকল্পনা হয় ১৫১ সদস্যের কমিটি হবে। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত পদধারী ২০০ ছাড়িয়েছে। কমিটির আকার ৩০০ ছাড়াতে পারে বলে এনসিপি সূত্র জানিয়েছে।
কাকে, কোন পদে রাখা হবে– এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা এবং বাদপড়াদের ক্ষোভ ও চাপে কমিটির আকার বাড়ছে জানিয়ে সূত্রটি সমকালকে বলেছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশে দু-একদিন লাগতে পারে। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের সব পক্ষকে রাখতে হচ্ছে। সাত দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে জানিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেন, রমজানে বিভিন্ন আয়োজন, ইফতার মাহফিল করা হবে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, সারাদেশে ৫০০ উপজেলা-থানায় রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি (জানাক)। এ কমিটির সদস্যরা রাজনীতি করবেন এবং অন্যদের সমন্বয়ে হবে এনসিপির কমিটি। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যারা আসতে চান, তারাও সুযোগ পাবেন।
যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ সমকালকে বলেছেন, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত এনসিপিকে ছড়িয়ে দিতে কাজ শুরু হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই আহ্বায়ক কমিটির সভায় দলের বিস্তৃতির পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা দল হিসেবে এনসিপি সাধারণ মানুষের কাছেই ফিরবে। যাবে তৃণমূলের কাছে।
ছয় মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের লক্ষ্য এনসিপির। এ জন্য আগামী সপ্তাহ থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাইজিং কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান সমকালকে বলেন, রাইজিংয়ের মাধ্যমে ইউনিয়ন কমিটি গঠন শুরু করব। আমাদের লক্ষ্য ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সব ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে কমিটি গঠন।
রমজানে বড় কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা ভাবছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি। শুধু সব পর্যায়ের কমিটি ইফতার কর্মসূচি করবে। এনসিপির একাধিক নেতা বলেছেন, প্রথম কাজ হবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের যোগ্যতা অর্জন করা। এ জন্য এক-তৃতীয়াংশ জেলা এবং ২০০ উপজেলায় কমিটি ও কার্যকর কার্যালয় থাকতে হবে। উপজেলায় ২০০ ভোটারের সমর্থন লাগবে। নির্বাচন কমিশন নতুন দল নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরুর আগেই এসব প্রাথমিক কাজ সেরে রাখা হবে।
দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব পাওয়া হাসনাত আবদুল্লাহ এবং উত্তরাঞ্চলে একই দায়িত্বে থাকা সারজিস আলমও সাংগঠনিক জেলাগুলোয় কর্মসূচির কথা জানিয়েছেন। হাসনাত ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং বাংলাদেশপন্থি ছাত্র-জনতার সঙ্গে অচিরেই দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ। আপামর ছাত্র-জনতার দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে চাই।’ সারজিস আলম লিখেছেন, দিন আনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী ভাইয়ের কথা শুনতে চাই।
ঠিক হবে স্লোগান-কর্মসূচি, পরে গঠনতন্ত্র
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুললেও এনসিপির দলীয় স্লোগান চূড়ান্ত হয়নি; ঠিক হয়নি কর্মসূচিও। একাধিক নেতা বলেছেন, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এটি দলীয় স্লোগান হতে পারে। আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এ স্লোগানও দেওয়া হয় বারবার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, অভ্যুত্থানের নেতারা চব্বিশের অভ্যুত্থান দিয়ে একাত্তরকে আড়াল করতে চান– এমন প্রচার রয়েছে। তা মোকাবিলায় ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গ্রহণ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন এক নেতা। আরেক নেতা জানান, চব্বিশের অভ্যুত্থানের অন্যতম স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। এটিও থাকতে পারে। আদীব সমকালকে জানান, কমিটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর স্লোগান, কর্মসূচি নির্ধারণ হবে। সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর, চব্বিশকে ধারণ করেই এগোবে এনসিপি।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ও গণপরিষদ
আত্মপ্রকাশের ঘোষণাপত্রে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছিলেন, দলের লক্ষ্য হবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা। তবে কীভাবে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের লক্ষ্য পূরণ হবে, তা স্পষ্ট নয়। দফায় দফায় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে এখন চলছে পঞ্চম রিপাবলিক। বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্র অবসানের পর ১৭৯২ সালে দেশটিতে প্রথম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। পরে আবার রাজতন্ত্র, সামরিক ও স্বৈরশাসন এসেছে। সাংবিধানিক পরিবর্তনও হয়েছে। প্রতিবার পরিবর্তনের সঙ্গে বদল হয়েছে প্রজাতন্ত্রও।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে এনসিপি কী বোঝাচ্ছে, কীভাবে এ লক্ষ্য পূরণ করবে– প্রশ্নে মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক সমকালকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে জনমত গঠনে তৃণমূলে আমরা কাজ করব।’ আদীব বলেন, ‘প্রথম প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর প্রণীত সংবিধানে কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকারপ্রধান কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছেন। তা স্থায়ীভাবে রুখতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। এটিই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র।’
এনসিপি নেতারা বলেছেন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ও নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচনের যে দাবি তোলা হয়েছে, তা দলীয় অবস্থান মাত্র। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কেউ সমাজতন্ত্র চায়, কেউ অন্য কিছু চায়, কেউ হয়তো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চায়। এ রকম অনেক কিছু থাকে বিভিন্ন দলের ঘোষণাপত্রে। নতুন বন্ধুদের সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? রিপাবলিকের লিটার্যাল মানে কী? রিপাবলিক হচ্ছে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তাদের একটি নমিন্যাল অথবা ‘ইলেক্টেড হেড অব দ্য স্টেট’ থাকবে। সেটা কি আমাদের নেই? যারা গণপরিষদ, সেকেন্ড রিপাবলিক সামনে আনছে, তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে।”
কিংস পার্টি হবে না
এনসিপি নেতারা আগে গণপরিষদ নির্বাচন দাবি করলেও দলটির একাধিক সূত্র সমকালকে বলেছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকলে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে। দলের বিস্তার ও গুছিয়ে ওঠার জন্য যা খুবই কম। আবার অতীতে সামরিক শাসনে যেভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দল গঠন করে প্রার্থী দলে আনা হয়েছে, তা বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব নয়।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছর পর সংসদ নির্বাচন দিয়েছিলেন। ফলে সময় নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল থেকে বিএনপি গঠন ও ভোট প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলেন তিনি। সে সময়ে আওয়ামী লীগবিরোধী সব ধারার নেতা যোগ দেওয়ায় বিএনপি দ্রুত বড় দলে পরিণত হয়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় দলটির জন্য নির্বাচনও সহজ হয়েছিল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চার বছর পর সংসদ নির্বাচন দেন। প্রথমে জনদল, পরে আরও কয়েকটি দল নিয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করে শেষে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন ধারার দলছুট নেতারা যুক্ত হন। বিএনপিবিহীন ছিয়াশির নির্বাচনে সফলতা পায় জাপা। যদিও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এনসিপিও ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এনস প স ক ন ড র প বল ক ছ ত র জনত র এনস প র বল ছ ন কম ট র এক ধ ক ব এনপ গঠন ক প রথম সদস য উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যাটারি রিকশা— একটু আস্তে চালান ভাই
রোববার সকালে এক সহকর্মীর ফেসবুকে খবরটি দেখে শঙ্কিত হই। তিনি লিখেছেন, ২৯ মার্চ বাংলামোটরে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁর স্ত্রী ও পুত্র আহত হন। পথচারী ও পুলিশের সহায়তায় তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁরা এখন বাসায় সুস্থ আছেন। রিকশাচালকও সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন ওই সহকর্মী। এ ধরনের ঘটনায় চালকদের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। তিনি রেখেছেন।
কিন্তু ওই চালক ভাই কি নিয়মমতো রিকশা চালিয়েছিলেন? শুনেছি তিনি নিয়ম মানেননি। দ্রুত চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন। নিয়ম মানলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এটা সব যানবাহেনর জন্য সত্য। অধিকাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক বেপরোয়া গতিতে চালান। ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কয়েক দিন আগের খবর। সকালে রমনা পার্কে হাঁটতে বের হয়েছিলেন একজন অভিনেত্রী। হেঁটে বাসায় ফেরার সময় গলির ভেতর হঠাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা তাঁকে ধাক্কা দেয়। তিনি রাস্তায় পড়ে গেলে গায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় অটোরিকশাটি।
মাসখানেক আগে এক সাংবাদিক বন্ধু তেজগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার আসতে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েন। তিনিও ব্যাটারিচালিত রিকশায় ছিলেন। রিকশার সামনে দিয়ে যাওয়া একটি কুকুরকে বাঁচাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সেই রিকশাও চলছিল বেপরোয়া গতিতে।
সাম্প্রতিককালে ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগই মোটর সাইকেলে। এরপরই ব্যটারিচালিত তিন চাকার রিকশা।
ময়মনসিংহের খবরটি খুবই মর্মান্তিক। এক দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু। গৌরীপুরে ট্রাকের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের মা, দুই মেয়ে ও তাদের নানি নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও দুজন। গাজীপুর এলাকার প্রগতি ফিড মিলের সামনে ময়মনসিংহগামী ট্রাকের সঙ্গে গৌরীপুরগামী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পুলিশের ভাষ্য, ঈদের ছুটিতে তাঁরা ময়মনসিংহের বাসা থেকে অটোরিকশায় করে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে অটোরিকশাটিকে ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক ধাক্কা দেয়।
খবরে আরও জানা গেল, অটোরিকশাটি যিনি চালিয়ে নিচ্ছিলেন, তিনি একজন প্রতিবন্ধী। আমরা এমন দেশ করলাম, একজন প্রতিবন্ধীকেও রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের পাশে দাড়ায় না।
গণপরিবহনের স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারা দেশ ছেয়ে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় এক ছাত্রী মারা যান। সে সময়ে অটো রিকশা বন্ধের দাবি জানিয়ে আদালতে রিট করা হয়েছিল। রাস্তায় নেমেছিলেন প্যাডেল চালিত রিকশাচালকেরাও। ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে তাঁদের রোজগার কমে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রিট টেকেনি। এখন ঢাকার রাস্তায় প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত বিকশার সংখ্যা বেশি। এর চালকেরাও গরিব মানুষ।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এর স্টেশনগুলো ঘিরে ব্যাটারিচালিত রিকশার ভিড় বেড়েছে। যানজট থাকলে বিপদ কম; কিন্তু ফাঁকা রাস্তা পেলেই চালকেরা বেপরোয়া গতিতে চালান এবং প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন।
অটো বন্ধ হলে তাদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে আমরা মনে করি, বিকল্প কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ব্যটারিচালিত রিকশা চলুক। তবে চালক ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ থাকবে, একটু আস্তে চালান ভাই। আপনিও বাঁচবেন। যাত্রীও বাঁচবেন।
গত ২১ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বৈধ যানবাহন আছে ৬২ লাখের মতো। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ তিন চাকার যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। অথচ উন্নত দেশগুলোতে মানুষের প্রধান ভরসা গণপরিবহন। সেখানে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে গণপরিবহনে চলাচল করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো সরকারই গণপরিবহনের ওপর গুরুত্ব দেয় না। গণপরিবহন সবল হলে এখন যে পরিবহন খাতে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে সেটা থাকবে না। এ কারণে পরিবহন খাতের মালিক মোক্তারেরা সমস্যা জিইয়ে রাখতে পছন্দত করেন। সরকার বদলের পর চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না। চাঁদার গ্রহিতা বদল হন মাত্র।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। প্রাণহানির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তিন চাকার যানবাহন। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১ হাজার ৯২৪ জন; যা মোট নিহত মানুষের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর তিন চাকার যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, অটোভ্যান ইত্যাদির দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৭ জন মারা গেছেন; যা মোট নিহত মানুষের ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকার নিবন্ধন দেয় না বলে এগুলোকে অবৈধ যানবাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আমাদের দেশে একসময় হাতে টানা রিকশা ছিল। কলকাতায় গেলে এখনো দু–চারটি দেখতে পাওয়া যায়। টানা রিকশার তুলনায় প্যাডেলচালিত রিকশা ছিল একটি ‘বিপ্লব’। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে টেনে নিচ্ছেন, এটা অমানবিক। সে ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আরও বেশি স্বস্তি দিতে পারত, যদি না ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটত।
ব্যাটারিচালিত রিকশা চলুক; তবে নিয়মকানুনের মধ্যে। এই বাহনটি নিরাপদ করতে হলে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গতিসীমা ঠিক করে দিতে হবে। অনেক আগে একটি স্লোগান লেখা থাকত বাসের পেছনে, ‘একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না’। ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় পড়লে চালক ও যাত্রী উভয়ের জীবন বিপন্ন হয়। ময়মনসিংহের যেই পরিবার ঈদে বাড়িতে যাচ্ছিল, তারা কখনোই ভাবতে পারেনি, চার চারটি জীবন এভাবে চলে যাবে।
আমরা আশা করব, এই ঈদের ছুটিতে যানবাহন চালানোর ব্যাপারে সবাই সতর্ক থাকবেন। কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করবেন না। মনে রাখতে হবে, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।’
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]