বছর ঘুরে আবার ফিরে এল পবিত্র মাহে রমজান। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। এরপর রাতে এশার নামাজের পর ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মসজিদে তারাবিহর নামাজ জামাতে আদায় করেন।
মূলত তারাবিহ আদায়ের মাধ্যমে রোজার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। আর ভোররাতে সাহ্রি খেয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সিয়াম পালন বা রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।
মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহারে বিরত থেকে এই একটি মাস আত্মশুদ্ধির সাধনায় নিবেদিত থাকবেন। রোজা রাখার পাশাপাশি সাধ্যমতো দান-খয়রাত, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং বেশি বেশি নফল ইবাদতের মধ্য দিয়ে এই রমজান মাস অতিবাহিত করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। আজ ২ মার্চ থেকে রমজান মাস শুরু হওয়ায় আগামী ২৭ মার্চ দিবাগত রাতে পবিত্র শবে কদর পালিত হবে।
মহান আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত ও ক্ষমালাভের জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারা বছর এই মাসের প্রতীক্ষায় থাকেন। রহমত ও বরকতের দিক দিয়ে রমজান মাস বছরের অন্য ১১ মাস থেকে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
সাহ্রি, ইফতার আর কর্মস্থলের নতুন সময়সূচিতে আজ রোববার থেকে এক মাসের জন্য বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রা। পবিত্র মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে গতকাল সকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকায় বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। এই র্যালি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ গেটে গিয়ে শেষ হয়।
পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল এক বাণীতে বলেন, পবিত্র এ মাসে আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে, সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্য লাভ ও ক্ষমালাভের অপূর্ব সুযোগ হয়। সিয়াম ধনী-গরিব সবার মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আসুন, পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-বিদ্বেষ, উচ্ছলতা ও সংঘাত পরিহার করি এবং জীবনের সর্বস্তরের পরিমিতিবোধ, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রমজ ন ম স
এছাড়াও পড়ুন:
মাহে রমজানের ইবাদতের প্রস্তুতি
পবিত্র রমজান মাস মুমিনদের জন্য আনন্দের; রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এই মাসে আল্লাহর রহমত ব্যাপকভাবে বর্ষিত হয়। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। ফলে রোজা, নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা, ফিতরা, জাকাত, জিকির-আসকারের মতো যাবতীয় ইবাদত সহজে তাদিকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন সম্ভব হয়। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস! যে মাসে মানুষের জন্য পথনির্দেশ, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন রোজা পালন করে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম বা রোজা পালন ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত—এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নাই, আর হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজব্রত পালন করা এবং রমজান মাসে সিয়াম পালন করা।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৭)
রমজানকে কেবল ভোজের আয়োজনের উৎসব হিসেবে পরিণত করা উচিত নয়। পানাহারের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগী না হয়ে যাতে ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবেরমজান মাস তাকওয়া বা সংযম অর্জনের মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপরেও, যাতে তোমরা তাকওয়া লাভ করতে পারো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন, অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। এই সংযম সব শ্রেণির মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা মুনাফার অতিরিক্ত লোভ থেকে বিরত থাকবেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি থেকে দূরে থাকবেন, ভোক্তা ও ক্রেতারা অহেতুক অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন, এবং সরকার ও প্রশাসন জনকল্যাণে ব্রতী হবে। তবেই রমজানের উদ্দেশ্য সফল হবে। তখন রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ হবে।
মাহে রমজানে ফরজ সিয়ামের পরিপূরক আমলসমূহ
নিয়মিত ২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ পড়া, সাহ্রি খাওয়া, ইফতার করা, কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করা এবং রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা। বিশেষভাবে অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ ও বেহুদা কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
পবিত্র রমজানে সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য হলো, ধনীরা যেন অভাবী মানুষের কষ্ট অনুভব করতে পারেন। তাই রমজানকে কেবল ভোজের আয়োজনের উৎসব হিসেবে পরিণত করা উচিত নয়। পানাহারের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগী না হয়ে যাতে ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সামর্থ্যবানেরা যেন অতিরিক্ত বাজার না করেন, যাতে গরিব মানুষ কেনার সুযোগ পায়। এসব পবিত্র রমজানের উদ্দেশ্য ও শিষ্টাচারের পরিপন্থী। বরং আমাদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন যাঁরা অভাবী, তাঁদের ইফতার ও সাহ্রির ব্যবস্থা করা আমাদের ইমানি কর্তব্য।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি পূর্ণ ইমানদার নয়, যে পেট পুরে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তবে সেই রোজাদারের সওয়াব কম হবে না।’
সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘একটা পানিমিশ্রিত দুধের পেয়ালা অথবা একটি খেজুর, অথবা এক ঢোঁক পানি দিয়ে যদি কেউ রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সে সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’ আর যে ব্যক্তি রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে ইফতার করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণামুক্ত করবে। (মুসনাদে আহমাদ)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]