পবিত্র রমজান মাসে সারা দিন রোজা রাখার পর অনেকেই লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে গলা ভেজাতে চান। বাজারে তাই লেবুর চাহিদা বেড়েছে। এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা।
সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকার বাজার থেকে এক হালি লেবু আকারভেদে ২০ থেকে ৪০ টাকায় কেনা যেত। গতকাল শনিবার ঢাকার চারটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লেবু বিক্রি হচ্ছে হালিপ্রতি ৫০-৮০ টাকা দরে।
লেবুর মতো দাম বেড়েছে শসা, লম্বা বেগুন এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ফলের। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ইফতারসামগ্রীর দাম চড়া, যা সাধারণ মানুষের খরচ বাড়িয়েছে।
নিত্যপণ্যের মধ্যে চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, আলু, আটা ইত্যাদির দাম স্থিতিশীল আছে। বিশেষ করে মৌসুমের কারণে পেঁয়াজ ও আলুর দাম অনেকটাই কম। চিনির সরবরাহ ভালো, দাম বাড়েনি। বরং গত বছরের তুলনায় দাম এবার কম। তবে সংকট চলছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের। এই সুযোগে খোলা তেলের দাম নির্ধারিত দরের চেয়ে লিটারে ২৮-৩৩ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
চাল ও ডালের দাম আগে থেকেই চড়া। মাছ-মাংসের বাজারেও স্বস্তি নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সায়মা ইসলাম কৃষি মার্কেটে কেনাকাটা করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সারা দিন রোজা থেকে ইফতারে পরিবারের সদস্যরা একটু লেবুর শরবত আর ফল খেতে চান। ফল আর সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। তিনি বলেন, ‘দুদিন আগে দোকানিকে বোতলের সয়াবিন তেল দেওয়ার জন্য বলে রেখেছিলাম। আজ (শনিবার) এসে দেখি, তেল নেই। দোকানদার আরও এক দিন সময় চাইল।’
দাম বেড়েছে যেসব পণ্যেরইফতারে বেগুনি, পেঁয়াজুর মতো ভাজাপোড়া খেতে পছন্দ করেন অনেকে। প্রতিবছরই রোজায় বেগুনের দাম বাড়ে। এবারও বেড়েছে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল মার্কেট, আগারগাঁওয়ের তালতলা বাজার এবং কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত তিন দিনে খুচরা পর্যায়ে লম্বা বেগুনের দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মানভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এবার অবশ্য বেগুন ‘শতক’ হাঁকায়নি।
শসার দামও কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। গতকাল এক কেজি দেশি শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর হাইব্রিড শসা কেনা গেছে ৫০-৬০ টাকা দরে। তবে কাঁচা মরিচের দাম কম। কেজি ৬০-৮০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, কয়েক দিন পরই বেগুন ও শসার দাম কমে যাবে। প্রতিবছরই রোজার প্রথম কয়েক দিন দাম বেশি থাকে, পরে কমে যায়।
বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও গরুর মাংসের দাম। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে
২১০-২২০ টাকা দরে। আর কেজিতে ৩০ টাকার মতো বেড়ে দেশি গরুর মাংস ৭৮০ টাকার আশপাশের দরে বিক্রি করতে দেখা যায়।
মাছের দামও বেড়েছে। খাল, বিল, নদী-নালার মাছ বেলে, পোয়া, বোয়াল, আইড়, শোল ইত্যাদি ৫০০ টাকা কেজির নিচে পাওয়া কঠিন। তাজা ও আকারে বড় হলে দাম হাঁকা হয় ৭০০-৮০০ টাকা।
বাজারে মোটামুটি স্থিতিশীল থাকে তেলাপিয়া, পাঙাশ, চাষের কইয়ের মতো মাছের দাম। এগুলোর দরও কেজিতে ২০ টাকার মতো বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন বিক্রেতারা।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে গতকাল নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের একটি তুলনামূলক মূল্যতালিকা দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, গত বছরের রমজানের সময়ের তুলনায় এবার সব ধরনের চালের দাম ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ভোজ্যতেলের দামও ১১-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে গত রমজানের তুলনায় এবার আটা, ময়দা, চিনি, আলু, টমেটো, আদা ও পেঁয়াজের দাম কমেছে।
ইফতারে মুড়ি লাগেই। মুড়ির দাম এবার বাড়েনি। সাধারণ মানের মুড়ি ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর হাতে ভাজা মুড়ির দাম রাখা হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।
সরকার এবার ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুরসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়। এর সুফল পাওয়া যায় চিনি ও খেজুরের বাজারে। তবে সয়াবিন তেলে সুফল পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল বলেন, গত রমজানের চেয়ে এবার বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে এসেছে, কমেছে। দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পুরো রমজানে অন্তর্বর্তী সরকারের নজর থাকবে।
প্রতিটি বিষয় পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা আশা করছি সাপ্লাই (সরবরাহ) পরিস্থিতি সামনে আরও ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে আশা করা যায়, দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।’
ফলের দাম চড়ারোজায় আপেল, নাশপাতি, আঙুর, কমলা, মাল্টা প্রভৃতি ফলের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু বাড়তি শুল্ক-করের কারণে এ বছর বিদেশি ফল আমদানি কমে গেছে। সর্বশেষ গত মাসে ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। ফলে ভোক্তাদেরও বেশি দাম দিয়ে ফল কিনতে হচ্ছে। আর রমজানে চাহিদা বাড়ায় দাম আরও কিছুটা বেড়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশি ও আমদানি করা উভয় ধরনের ফলের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত তিন-চার দিনের মধ্যে প্রায় সব ধরনের ফলের দাম কেজিতে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যেমন মাল্টা। গতকাল বাজারে এখন এক কেজি মাল্টা বিক্রি হয়েছে ৩০০-৩২০ টাকায়, যা তিন দিন আগেও ২৭০-৩০০ টাকায় কেনা যেত। এভাবে কমলা, আপেল, আঙুর, আনারের মতো বিদেশি ফলের দাম কেজিতে ২০-৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বিদেশি ফলের চড়া দামের সুযোগে বেড়েছে দেশি ফলের দামও। যেমন পেয়ারা। গতকাল ফলটি ১০০-১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগেও এটি ৭০-১০০ টাকায় কেনা যেত। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির কলা, বরই, পাকা পেঁপে ও আনারসের দামও কমবেশি বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা আরশাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রোজায় বাড়তি চাহিদার কারণে ফলের দাম আরও কিছুটা বেড়েছে। এটা হয়তো কয়েক দিন পরে কিছুটা কমবে। কিন্তু সারা বছর যে দাম থাকে, তা–ও অনেক বেশি। কারণ, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে কিনতে হয়।
ফল আমদানিকারকেরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, উচ্চ শুল্ক–কর ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফল আমদানির খরচ অনেক বেশি পড়ে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফল আমদ ন ফল র দ ম পর য য় ২০ ট ক ৮০ ট ক রমজ ন গতক ল ধরন র ইফত র
এছাড়াও পড়ুন:
বদলে গেছে জীবনযাত্রার ছক
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস ছিল গতকাল রোববার। তবে বদলে গিয়েছিল জীবনযাত্রার চেনা ছক। সকালবেলা মুখে কিছু না তুলেই অফিস-কাছারি পথে পা বাড়িয়েছেন লোকজন। জীবন–জীবিকার দায় মেটাতে যাঁর যা কাজ তাতে নিয়োজিত হয়েছেন। এদিকে বেলা যায় তবু ক্ষুধা–তৃষ্ণার কথা মুখে নেই। পবিত্র মাহে রমজান পাল্টে দিয়েছে ব্যক্তিজীবন থেকে ঘরসংসারের গতানুগতিক কাজের ধারা।
শনিবার সন্ধ্যায় রমজান মাসের চাঁদ দেখার ঘোষণার পর থেকেই মূলত মাহে রমজানের আবহ ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম পরিবারগুলোয়। এশার নামাজের পর সারা দেশে মসজিদগুলোয় খতম তারাবিহর প্রথম জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীতে মসজিদগুলোয় এশার ওয়াক্ত থেকেই নামাজিদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। অধিকাংশ বাড়িতেই বরাবরের চেয়ে তুলনামূলক আগেই রাতের খাবার পর্ব শেষ করা হয়। গৃহিণীরা প্রস্তুতি নেন শেষরাতে সাহ্রির খাবারের আয়োজন করতে।
সকালে নাশতা তৈরি নিয়ে যে ব্যস্ততা থাকে, গতকাল তা ছিল না। বেলা গড়ানোর পর থেকে বাড়তে থাকে ইফতারের প্রস্তুতি। প্রথম রোজায় সবাই চেষ্টা করেছেন পরিবারে সবাইকে নিয়ে সাধ্যমতো উপাদেয় খাদ্য-পানীয় দিয়ে ইফতার করতে। রমজান উপলক্ষে অফিসের সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। সে কারণে চাকরিজীবীরা হাতের কাজ শেষ করে দ্রুত বাসাবাড়িতে ফেরার পথ ধরেন। অনেকে ফেরার আগে কাঁচাবাজার, ফলের দোকান, ইফতারির দোকানগুলোয় গেছেন কেনাকাটা করতে।
গতকাল হোটেল–রেস্তোরাঁর ঝাঁপ ছিল বন্ধ। ফুটপাতের চায়ের দোকানগুলোর সামনেও পর্দা ঝুলিয়ে খানাপিনার দৃশ্যে আড়াল টানা হয়। দুপুরের পর পাড়া–মহল্লার মোড়ে, হোটেল–রেস্তোরাঁর সামনে বসে যায় ঝাল-মিষ্টি, ভাজাপোড়ার হরেক রকম উপকরণ সাজিয়ে ইফতারির পসরা।
ইফতারে মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, বুন্দিয়া—এগুলোই বাঙালির প্রধান ও প্রিয় খাবার। এর সঙ্গে থাকে মাংস, সবজির বিভিন্ন ধরনের পদ, পরোটা, বিরিয়ানি ও মিষ্টি। মাংসের অনেক রকমের কাবাব, ভুনা, রোস্ট এসব দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করেন ঢাকার বাসিন্দারা। এর পাশাপাশি হালিমও ইফতারের তালিকায় বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সারা দিনের তৃষ্ণা নিবারণ ও শরীরে পানির ঘাটতি পূরণের জন্য ডাব বা লেবুর শরবতই অনেকের কাছে প্রিয়।
পুরান ঢাকার চকবাজারে চকশাহি মসজিদের সামনে পয়লা রমজান দুপুর থেকে বসে ইফতারির বাজার। বহু বছর ধরে চলছে এই বৈচিত্র্যময় ইফতারসামগ্রীর পসরা। বেইলি রোডের ইফতারিও বিখ্যাত। বিকেলে দেখা গেল ক্যাপিটাল কনফেকশনারির আয়োজনে বসেছে ইফতারির বাজার। এবার এখানে আছে ১০০ রকম পদ। জিলাপির কেজি ৪০০ টাকা। পাশেই নবাবি ভোজের ইফতারির পসরায় আছে ৫০ রকমের পদ। ব্যবস্থাপক ইমাম হোসেন জানালেন, তাঁদের কাচ্চি, মোরগ–পোলাও ৩০০ ও স্পেশাল গরুর তেহারি ৩৫০ টাকা। জ্যাগেরি রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক জানালেন তাঁদের ইফতারির তালিকায় আছে প্রায় ৬০টি পদ। গরুর হালিম ৩৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ আর খাসির হালিম ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। বেইলি পিঠাঘর এখন সাজিয়েছে ৩০ রকমের ইফতারির পসরা।
সেগুনবাগিচায় রয়্যাল অ্যারোমা কারি অ্যান্ড কাবাব তাদের রেস্তোরাঁর সামনে শামিয়ানা টাঙিয়ে তার তলায় সাজিয়েছে প্রায় অর্ধশত পদের ইফতারি। ব্যবস্থাপক সবুজ মিয়া বললেন, তাঁরা দাম বাড়াননি। ইফতারিতে লাভ কম করে বেশি মানুষের হাতে উপাদেয় খাবার তুলে দেওয়ারই চেষ্টা করছেন তাঁরা।
দুপুরের পর থেকেই ইফতারির দোকানগুলোয় বেচাকেনার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। পথে যানজট ও যানবাহনেও যাত্রীদের ভিড়ও ছিল বেশি। বেলা যখন অস্তাচলে, ইফতারি সামনে নিয়ে বসেছেন রোজাদাররা। সারা দিন পানাহারে বিরত থেকে অপেক্ষা মাগরিবের আজানের ধ্বনির জন্য। ইফতারি মুখে তোলার আগে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে নিজেদের রোজা কবুল ও পাপ মার্জনার জন্য সবিনয়ে কাতর প্রার্থনা করেছেন। আরও প্রার্থনা করেছেন, তিনি যেন তৌফিক দেন রমজানের সংযমের শিক্ষায় আত্মশুদ্ধি করে নিতে।