তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা যখন কার্যত পথ হারিয়েছে এবং প্রায় এক দশক ধরে যখন নদীটিতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত ও চীনের দ্বৈরথ যখন পাল্টাপাল্টিতে ঠেকেছে; তখন বিএনপি এক কর্মসূচি দিয়ে কার্যত তিন পাখি মারতে সক্ষম হয়েছে।
প্রথমত, গত ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তা নদী নিয়ে তিস্তাপারেই টানা ৪৮ ঘণ্টার যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে, সেটা নানা দিক দিয়ে অভিনব। আঠারো শতকে তিস্তা অববাহিকার কৃষক বিদ্রোহের নেতা
নূরলদীনের ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়’ অবলম্বনে এই কর্মসূচিরও স্লোগান ছিল ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’। তিস্তা অববাহিকার পাঁচ জেলার–নীলফামারী,
লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা– ১১টি পয়েন্টে পদযাত্রাসহ অবস্থান নিয়ে যেভাবে আলোচনা, গ্রামীণ খেলাধুলা, গান-বাজনাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে, নদী আন্দোলনের গতানুগতিক ধারা থেকে সেটি যথেষ্ট ভিন্ন এবং স্বাভাবিকভাবেই এই ‘নতুনত্ব’ বাড়তি সাড়া জাগিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে পর থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দেখা গেছে, রংপুর অঞ্চলে জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বিএনপির চেয়ে এগিয়ে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেহেতু ভোটের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলনের সুযোগ ছিল না, এই এক দশকে বিএনপির ভোট অন্যদের তুলনায় বেড়েছে কিনা আলোচনাসাপেক্ষ। এটা নিশ্চিত যে, তিস্তা কর্মসূচিটির মধ্য দিয়ে বিএনপির প্রতি রংপুর অঞ্চলের ভোটারদের সমর্থন অনেক বাড়বে। কারণ, আর্থসামাজিক কারণেই নদীটি ওই অঞ্চলের ‘প্রাণপ্রবাহ’ বিবেচিত।
এছাড়া, বিএনপির কর্মসূচির মাত্র দিন দশেক আগে, ৯ ফেব্রুয়ারি, অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে তিস্তাপারে গণশুনানির আয়োজন হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জাতীয় নাগরিক কমিটির এবং বর্তমানে সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ জানাক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। প্রসঙ্গত, আখতারের পৈতৃক বাড়িও তিস্তাপারেই। ঘোষিত উদ্দেশ্য যাই হোক, ওই কর্মসূচির রাজনৈতিক সুফল জাতীয় নাগরিক পার্টির ঝুলিতে আসার সম্ভাবনা ছিল ষোল আনা। পরবর্তীকালের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে সেটার ১২ আনাই বিএনপি নিয়ে নিয়েছে।
তৃতীয়ত, তিস্তা নিয়ে এবারের কর্মসূচিটি সর্বজনীন করে তোলার ক্ষেত্রে বিএনপির চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। এর আগেও ২০১৪ সালের ২২-২৩ এপ্রিল বিএনপি ঢাকা থেকে তিস্তা পর্যন্ত লং মার্চ কর্মসূচি পালন করেছিল। সেটা আনুষ্ঠানিকভাবেই ছিল দলীয় কর্মসূচি। এবার দেখা যাচ্ছে, যেসব পোস্টার ও লিফলেট তৈরি হয়েছে, সেখানে আয়োজক হিসেবে নাম ছিল ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’। ফলে বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ও জোট শরিকদের বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্যও সংহতি জানিয়ে অংশগ্রহণ সহজ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিস্তা ইস্যুতে বিএনপি নিজেকে প্রধান অংশীজন করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
বস্তুত দুই দিনের কর্মসূচির সমাপনীতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান তিস্তা নিয়ে কিছু সিদ্ধান্তমূলক অবস্থানও ব্যক্ত করেছেন– ‘রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে বিএনপি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। এ ছাড়া তিস্তার পাশাপাশি অন্য নদীগুলোকে খননসহ পানি সংরক্ষণাগার ও জলাধার নির্মাণ করা হবে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল কাটা প্রকল্প শুরু করা হবে’ (সমকাল, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
তারেক রহমান আরও বলেন– ‘প্রতিবেশী দেশ যদি পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়, কিংবা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সায় না দেয়, তাহলে আমাদেরই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনে জাতিসংঘসহ সব ফোরামে এই তিস্তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে’ (সমকাল, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
আমরা জানি, দুই দেশের অভিন্ন বা আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে কূটনৈতিক দরকষাকষির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেখা গেছে, গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ের দরকষাকষিতে সুবিধা করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দুই সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উভয়ই তখনকার বিরোধী দলগুলোকে মাঠের আন্দোলনের বার্তা পাঠিয়েছেন। বলা বাহুল্য, বিএনপির কর্মসূচিটির সুফল অন্তর্বর্তী সরকারও পাবে; তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং নদীটির পানি বণ্টন নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারির তিস্তা বাঁচাও কর্মসূচিটি কি বিএনপির জন্য ‘ভিনি ভিডি ভিসি’ বা এলাম, দেখলাম, জয় করলাম? বাস্তবে বিষয়টি জটিল। কারণ, নদীটি নিয়ে বিএনপির বর্তমান অবস্থান নিছক
‘রাজনৈতিক চাপ’ দেওয়ার নয়। পরবর্তী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে বিএনপিই ক্ষমতার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দাবিদার। সবকিছু ঠিক থাকলে, তখনই টেবিলের এপাশে দাঁড়িয়ে তোলা তিস্তা বাঁচানোর দাবিটি টেবিলের ওপাশে বসে বাস্তবায়ন করে দেখানোর দায়িত্বে পরিণত হবে। সেটি বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়।
আর ক্ষমতার বাইরে থাকাকাল তিস্তাপারের জনগণের মধ্যে আশা জাগিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে নিরাশ করা বরং বুমেরাং হতে পারে। আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে বারবার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের শিকার তিস্তাপারের জনগণ গণশুনানিতে দুই উপদেষ্টার সামনে বলেছিলেন, ‘এবার হামাক ঠকান না বাহে’!
তিস্তাপারের মানুষকে আওয়ামী লীগের মতো ‘ঠকাতে’ না চাইলে, বিএনপিকে অভিনব কর্মসূচির বাইরে আরও কিছু কাজ করতে হবে। যেমন বুঝতে হবে, শুধু মহাপরিকল্পনা কিংবা শুধু উজানের পানির হিস্যা দিয়ে তিস্তা বাঁচানো কঠিন। কারণ পানি সংকটের পাশাপাশি সেখানকার মানুষের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ নদীভাঙন। পানি পেলেও নদী ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভাঙন ঠেকানো কঠিন। আবার উজান থেকে প্রবাহ নিশ্চিত না করে পানিব্যবস্থাপনা কীভাবে অকার্যকর হতে পারে, সেটি তিস্তায় নির্মিত ডালিয়া ব্যারাজেই স্পষ্ট। ফলে চীন ও ভারত, উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা বা দরকষাকষি করেই তিস্তার প্রবাহ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এক্ষেত্রে চীন ও ভারত তিস্তা নিয়ে একত্রে বসতে অরাজি হবে না। আরও ভালো হবে চীন ও ভারতের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদার করলে। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত গাইডলাইন যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়।
দুই দিনের কর্মসূচির সমাপনীতে তারেক রহমান তিস্তা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক আইন কাজে লাগানোর কথাও বলেছেন। আমরাও অনেক দিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ ১৯৯৭ অনুস্বাক্ষর এবং জাতিসংঘ পানি সনদ ১৯৯২ স্বাক্ষর করা। মুশকিল হচ্ছে, গত প্রায় তিন দশকে সব রাজনৈতিক দলই বিরোধী দলে থাকতে ভাটির দেশের এসব রক্ষাকবচ ব্যবহারের কথা বলে। ক্ষমতায় গিয়ে ভুলে যায়।
খোদ বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ আমলে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদটি অনুস্বাক্ষরের প্রশ্ন উঠেছিল। তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী ও বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম এ বিষয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। কিন্তু প্রায় সবাই ইতিবাচক মত দেওয়ার পরও
রহস্যজনক কারণে বিষয়টি অগ্রসর হয়নি। মজার বিষয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্তবর্তী সরকার– সবাই অনুমানযোগ্য কারণে এ বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
আমরা কি আশা করতে পারি যে, বিএনপি এবার ক্ষমতায় গেলে ভাটির দেশের রক্ষাকবচ দুটি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরে কারও চোখ রাঙানিতেই পিছপা হবে না? আপাতত এতটুকুই হলেই, তিস্তাসহ দেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর জন্য অনেকটুকু কাজ হবে।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক অবস থ ন ব এনপ র ক ষমত য় র জন য র র জন রহম ন সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাগ্বিতণ্ডা ও ইউক্রেনের ভাগ্য
কিয়েভের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। শহর ও দেশজুড়ে এক ধরনের ভয় মিশ্রিত প্রত্যাশা ছিল। সামরিক পদক্ষেপের অবসান কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হবে– প্রত্যাশাটি এমন ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তা মোটেও পরিষ্কার ছিল না, তবে এর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিননীতি পরিবর্তনের সম্পর্ক ছিল।
গতকাল হোয়াইট হাউসের মঞ্চে উৎকণ্ঠা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ট্রাম্প ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে খনিজ পদার্থ বিষয়ক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা এবং তাঁকে অপমান করার আগে করমর্দন, সম্মতিজ্ঞাপন বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাত লাগানো সবই করেছেন। একই সময়ে উত্তর ও পূর্ব ইউক্রেনে বিমান হামলার সাইরেন বাজছিল। ফলাফল, আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল এবং জেলেনস্কি বিদায় নিলেন।
টিভি ক্যামেরার সামনে যা দেখা গেল, তা ছিল দারুণ ও অসাধারণ। জেলেনস্কিকে দেখাচ্ছিল গম্ভীর, রাগান্বিত ও বেপরোয়া। কেননা, একজন উপযুক্ত নেতাকে তাঁর জাতির জন্মগত অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ট্রাম্প নিজেকে একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী দাবি করে বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে জোটবদ্ধ নই। আমি বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।’ তিনি এ সময় জেলেনস্কিকে বলেন, কৃতজ্ঞ হোন। ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তিকে বলছেন, যিনি তাঁর লোকদের খুন হতে দেখেছেন, তাঁর এলাকা দখল ও অবরোধ করতে দেখেছেন। ‘চুক্তি করুন, নইলে আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি।’
পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো। জেলেনস্কি তাঁকে যুদ্ধের নৃশংসতার ছবি দেখান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের পাশে আছেন।’ কিন্তু বাস্তবে এখন কোনো আশা বা প্রত্যাশার সত্যতা দেখছি না। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অসম্মানিত হওয়ায় জেলেনস্কিকে আক্রমণ করেছেন। ট্রাম্প ও ভ্যান্স উভয়েই ক্যামেরার সামনে তাঁকে মৌখিকভাবে তীব্র সমালোচনা করেন। কারণ এটি এখন দরকষাকষির শিল্পের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এখন পক্ষপাত, ভয় প্রদর্শন, রক্তপাতহীন হলেও নির্মম।
কিন্তু ইউক্রেনবাসী এখন বিশ্বাস করে, শান্তিচুক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্টের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না; বরং এই অঞ্চলে মার্কিন জড়িত থাকার বিষয়ে অনেকগুলো ভিন্ন ধারণা বিরাজ করছে। এসব ধারণার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত রয়েছে, তবে তা কখনও রাশিয়ান আগ্রাসনের শিকার এমন একটি দেশকে সমর্থন করার দিকে মনোনিবেশ করে না।
গত দুই সপ্তাহে আমরা দেখেছি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির বিষয়টি এখন বিরল মাটির ধাতু খনির ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। সৌদি আরবে রাশিয়ান-মার্কিন দরকষাকষিতে অংশগ্রহণকারীরাও পৃথিবীর বিরল ধাতু নিষ্কাশন নিয়ে আলোচনা করেছিল। এ সময় তারা কেবল রাশিয়া অঞ্চল ও দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোর সম্পদের ওপর মনোনিবেশ করেছিল। এই পৃথিবীর এ বিরল ধাতুগুলো ইউক্রেন যুদ্ধ ও সামরিক সহায়তার বিষয়টি মিডিয়া মনোযোগের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। সেই জায়গা এখন ডলারে পরিপূর্ণ।
সোভিয়েত ইউনিয়নে বেড়ে ওঠা বয়স্ক ইউক্রেনীয়রা এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিকঠাকভাবে চিনতে পেরেছে। সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা কার্টুনে তাদের লোভী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, দখলদার পুঁজিতান্ত্রিক জাতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল, যারা জটিল সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে শুধু ডলারের অতিলাভের ওপর দৃষ্টিনিবন্ধ করে।
এটি একটি অস্তিত্বের যুদ্ধ এবং নতুন বাস্তবতা। ট্রাম্প বলেছেন, জেলেনস্কি ‘শান্তির জন্য প্রস্তুত নন’, তবে যে কোনো মূল্যে ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প নেই। যে সহায়তা আগে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল, তা এখন কিনতে হবে। টাকা না থাকলে সম্পদ দিয়ে দিতে হয়। রাশিয়ান আগ্রাসনের তিন বছর পর ইউক্রেনে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আর্থিক স্বার্থ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিবর্তে মাঠে নেমেছেন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
জেলেনস্কি সাহসী ছিলেন, কিন্তু আমরা এখন সাহায্যপ্রার্থী। ট্রাম্প ও ক্রেমলিন বারবার স্পষ্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার আলোচনায় ইউক্রেনের অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়। অন্য অনেক কিছুর মতো, বাইডেনের ঘোষিত নীতি বলে, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ইউক্রেন নিয়ে আলাপ হচ্ছে না’, এখন যার পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে শুরু করেছে। জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে সম্পদ হস্তান্তর-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য ডাকা হয়েছিল, কথা বলার জন্য নয়।
ট্রাম্প তাঁর পথ পেয়েছেন। তিনি ইউক্রেনকে একটি কর্তা থেকে একটি কর্মে রূপান্তরিত করেছেন। আর এই হোয়াইট হাউসের অবমাননার পরে ইউক্রেনীয় কিছু লোক নিশ্চিত, ট্রাম্পের শর্তে বিরল মাটির ধাতু নিষ্কাশন হলে তাদের দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘উপনিবেশ’-এ পরিণত হবে। তবুও, অনেক ইউক্রেনীয় রাশিয়ান উপনিবেশের চেয়ে মার্কিন উপনিবেশে থাকতে পছন্দ করবে, যদি সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়।
আন্দ্রে কুরকভ: ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক এবং ডেথ অ্যান্ড দ্য পেঙ্গুইন উপন্যাসের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম।