আরব নেতাদের যাচাইয়ের মুহূর্ত এখন আর মাত্র ১০ দিন দূরে। ৪ মার্চেই সেই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন কায়রোয় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২১ ফেব্রুয়ারি রিয়াদে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ‘ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায় যৌথ প্রচেষ্টা’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ওপরের সংবাদটি এসেছে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে। সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবিও ছিল। ছবিতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশে জর্ডান, মিসর, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন ও কুয়েতের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।

এই সাত দেশের মধ্যে মিসর ও জর্ডান বহু আগেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।

অন্যদিকে সৌদি আরব ও কাতারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখে। তাই এই নেতারা যখন ট্রাম্পের গাজায় জাতিগত নিধনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন, তখন তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। অতীতে এ ধরনের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ছিল। এই সন্দেহ আজও রয়ে গেছে।

আগামী কায়রো সম্মেলনে স্পষ্ট হবে, আরব নেতারা কি সত্যিই গাজার পক্ষে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি আগের মতোই কেবল কথার ফুলঝুরি শোনাবেন।

সাম্প্রতিক দিনগুলোয় অনেক বিশ্লেষক আরব দেশগুলোর অবস্থান খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। মিসর ও জর্ডানের ক্ষেত্রে মূল উদ্বেগ হলো গাজার ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বিতাড়ন। এ আশঙ্কা বাস্তব হলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনিরা এই সম্ভাবনাকে ‘নাকবা-২’ (দ্বিতীয় বিপর্যয়) বলে অভিহিত করছে। ঘোষণা দিয়েছে প্রতিরোধের।

কাতার দীর্ঘদিন ধরে গাজাকে বিশাল অঙ্কের অনুদান দিয়ে সহায়তা করে আসছে। অন্যদিকে সৌদি যুবরাজ নাকি বলেছেন, তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রস্তুত। তবে শর্ত হলো ‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের’ জন্য একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা।

আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তারাও ভবিষ্যতে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে সমর্থন করার কথা বলেছে। আসলে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত বরাবরই চরমপন্থী আরব গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে সতর্ক ছিল। কারণ, এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পিত ‘জাতিগত নিধন’ বাস্তবায়িত হলে এসব গোষ্ঠী নতুন শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আরও নড়বড়ে হবে।

তবে উপসাগরীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের নাজুক সম্পর্ক কীভাবে সামলাতে হয়, তা ভালোই জানেন। যখন সৌদি আরব ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিল, তখন একই সময়ে সৌদির সার্বভৌম সম্পদ তহবিল যুক্তরাষ্ট্রে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি ‘মিডল ইস্ট রিভিয়েরা’ গড়ে তোলার ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন কুশনার। তাঁর সঙ্গেই ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফ।

এই দুই ব্যক্তি ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। দাবি করেছেন, আসলে তা গাজার ফিলিস্তিনিদের কল্যাণের জন্যই করা হয়েছে। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, যদি ফিলিস্তিনিরা গাজায় থেকে যায়, তবে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হতে পারে। তবে তারা কখনোই ‘জোরপূর্বক বিতাড়ন’ বা ‘জাতিগত নিধন’ শব্দগুলো ব্যবহার করেননি।

ট্রাম্প ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর জাতিগত উৎখাত ধারণা উত্থাপন করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার। এতে ফিলিস্তিনিদের গাজার ভেতরেই কিছু নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে নতুন অবকাঠামো ও বসতবাড়ি নির্মাণ শুরু করা হবে।

তবে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বহু আগেই ইসরায়েলের নিজস্ব জাতিগত উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল। যার কারণে ইসরায়েল গাজার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলোকে নিশানা বানিয়েছে পরিকল্পিতভাবে। ইসরায়েলি বাহিনী পানির সরবরাহ ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকেন্দ্রগুলোও ধ্বংস করেছে। আর তা শুধু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা এবং ফিলিস্তিনে জিম্মি নেওয়ার ঘটনাকে প্রতিহত করার জন্য করা হয়নি; তা বরং দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনার অংশ।

কায়রোয় অনুষ্ঠেয় আরব লিগের সম্মেলনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, গাজার পুনর্গঠন ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে আরব নেতারা কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা কি কেবল বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন, নাকি বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন—তা তখনই বোঝা যাবে।

এখন, হামাসের ভবিষ্যৎ কী হবে? যদি কোনো চুক্তি হয়, গাজার শাসনভার কে নেবে? হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে যে শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিশ্চিত করতে তারা প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে। তবে তাদের জায়গায় কে আসবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। একই সঙ্গে হামাস জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের বিকল্পটি ধরে রাখবে।

আরব আমিরাতের ইচ্ছা পশ্চিম তীর শাসনকারী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজার শাসনভার নিক। যদিও অন্য আরব দেশগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসন মেনে নেবেন না।

এসব প্রশ্নই প্রমাণ করে, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেকোনো আলোচনা অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও অনিশ্চিত। আপাতত শুধু এটাই আশা, আগামী ১৫ মাস গাজার জন্য আগের ভয়াবহ ১৫ মাসের মতো হবে না।

আব্বাস নাসির ডনের সাবেক সম্পাদক

ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র আরব ন ত র জন য জ ত গত

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের ‘স্বাধীনতা দিবস’ বুধবার, অধিকাংশ পণ্যে ২০% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেবেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক বিভিন্ন দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে আসছেন। চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্র কানাডা এবং যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের ঐতিহাসিক মিত্র দেশগুলোকেও ছাড়েননি। এ জন্য পাল্টাও খেয়ে চলেছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি আবার নতুন একগুচ্ছ শুল্ক প্রস্তাবের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। আগামীকাল বুধবার এই ঘোষণা দেবেন, যা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।

কিন্তু বুধবার ট্রাম্প কি ঘোষণা করতে পারেন তা নিয়ে যেন জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। কারণ, তিনি এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন যে ছোট–বড় নির্বিশেষ কোনো দেশকেই ছাড়বেন না। সেটি বুঝা যায়, ট্রাম্পের বক্তব্যে। তিনি এই বুধবারকে ‘লিবারেশন ডে’ বা ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট আজ মঙ্গলবার জানিয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্যালয় হোয়াইট হাউসের কর্মীরা নতুন করে শুল্ক আরোপের একটি প্রস্তাব তৈরি করেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয়, এ রকম পণ্যের বেশির ভাগের ওপরই প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হবে।

নতুন শুল্ক আরোপের প্রস্তাব তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন তিনজন ব্যক্তিকে উদ্ধৃত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টারা সতর্ক করে দিয়েছেন যে শুল্ক আরোপের বিষয়ে বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে; যার অর্থ ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর না–ও হতে পারে। সংবাদ মাধ্যমটির মতে, এমন একটি বিকল্প পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে।

আগামীকাল ২ এপ্রিল বুধবার বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বৃহত্তর পরিকল্পনা ঘোষণা করতে চলেছেন। এই ঘোষণা অবশ্য আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে ওয়াল স্ট্রিট তথা যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কারণ, শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিক্রি ও মুনাফায় সরাসরি প্রভাব পড়বে, এমন আশঙ্কায় তাদের শেয়ারের দর কমছে। বিনিয়োগকারীরা ভয় ও আতঙ্কে এসব কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিয়ে সেফ হ্যাভেন বা বিনিয়োগের জন্য ‘নিরাপদ স্বর্গ’ খ্যাত সোনায় বিনিয়োগ করছেন। ফলে সোনার দাম বেড়ে ইতিমধ্যে প্রতি আউন্স ৩ হাজার ১৪৮ মার্কিন ডলারে উঠেছে। এটি সোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। এই প্রবণতা বিশ্বে আবার মন্দার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে শুল্ক আরোপ নিয়ে যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, আগামীকাল সেগুলোকে নতুন পরিকল্পনায় আরও বিস্তৃত স্থায়ী করার কথা বলতে পারেন। তা অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু দেশ বা শিল্পকে লক্ষ্য করে হবে না। ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা বলে আসছেন যে তাঁদের লক্ষ্য হলো, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরও ন্যায়সংগত তথা সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা; যাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ে।

কতিপয় অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে দিয়েছেন, নতুন শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। আবার বিভিন্ন দেশও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নিতে পারে।

ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিয়োগকারী, ভোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের আস্থাকে আঘাত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ে গেছে। নাসড্যাক সমন্বিত সূচক তো রীতিমতো ১০ দশমকি ৪ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া ভোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের ওপর পরিচালিত এক জরিপেও বলা হয়েছে, চলতি ২০২৫ সালের শুরু থেকে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ক্রমে বাড়ছে।

হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্রের সঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সূত্র: সিএনবিসি, ডয়চে ভেলে, এএফপি ও বিবিসি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ