১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন শুধু ভৌগোলিক বিভক্তি ছিল না। এর মাধ্যমে ভারতের বহু সম্প্রদায়িক ও বহু সংস্কৃতির বিভাজনও ঘটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতির পালাবদলে এই উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের ভীত দুর্বল হয়ে যায়। ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে শাসন ক্ষমতা পরিত্যাগ করার সময় ইংরেজ খণ্ডিত ভারত রেখে যায়। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক পরিচিতির ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত কতটা ভয়াবহ ছিল তা এখনো মানুষ প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করে।
দাঙ্গা, বাস্তুচ্যুতি, জবরদখল ইত্যাদি হিংসাত্মক ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের যে সূত্রপাত তখন হয়েছিল তার কারণে উভয় অংশের মানুষই ভিটে ছেড়েছে। দেশত্যাগের কারণে দুই ভূখণ্ডেই উদ্বাস্তু মানুষের চাপ বেড়েছে। দেশভাগ পরবর্তী বাস্তুত্যাগ মানব ইতিহাসে বড় রকমের বিয়োগান্ত এক ঘটনা, যার ফলে ১৪ মিলিয়ন মানুষ দেশছাড়া হয়েছিল। অভিবাসীরা নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেয়েছে। স্থানীয়দের শীতল ও অবন্ধুসুলভ আচরণের মাঝ দিয়েই তারা নতুন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।
মানব ইতিহাসের এই বিপর্যয় নিয়ে রচিত সাহিত্য সংখ্যায় ন্যূন নয়। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষায় রচিত সাহিত্য মানুষের সেই বেদনাকে নানাভাবে ধারণ করেছে। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ফলে বর্ধমানের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর অনেক লেখায় নানাভাবে দেশত্যাগের বেদনা উঠে এসেছে। সেইসব রচনার মান বিচারে ‘শিউলি’ একটু পিছিয়ে থাকলেও তার গুরুত্ব অবহেলা করার মতো নয়।
মধ্যষাটে বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘শিউলি’ লেখা হয়েছিল বলে লেখক হাসান আজিজুল হক জানাচ্ছেন কিন্তু বাকিটা কেন লেখা হয়ে ওঠেনি তা অবশ্য জানাননি। এই উপন্যাসিকা মূলত এক অনূঢ়া নারীর একক সংগ্রামের কাহিনি যে তার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বের মাঝেও দেশভাগে বিপর্যস্ত নিজ পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার জীবনের বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখতে পাই একেবারেই শুরুতে। ‘চোখ দুটো তার আগুন বয়ে বেড়াতো, সর্বনাশের আগুন। মা বোধ হয় সেই আগুন দেখতে পেত।’ এই বর্ণনা থেকেই পাঠক আঁচ করতে পারেন সামনে বড় কোনো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। সেই বিপর্যয় যে আর কিছু নয় দেশভাগ তা পাঠক বুঝতে পারেন কিছু পরে। ‘দেশ ছাড়ার পরে, তার সেই শুকনো প্রসারিত দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম বোধ হয় সে এমন বিকেল লক্ষ করেছে। বিকেলের কথা মনে হলেই সেই প্রশস্ত দেশের মাঠের কথা মনে পড়তো। সেই মাঠে রোদ যেন আরাম করে শুয়ে থাকতো। সেই দেশের স্মৃতির সঙ্গে সেই বিকেলের স্মৃতি। এদেশে আসার পর বিকেল যেন শিউলি কোনোদিনই দেখেনি।’
দেশ ছেড়ে এসে এক ভাই আর এক বোনকে নিয়ে শিউলি অন্যত্র, আর খোকন-টুলু-রিনাকে নিয়ে তাদের বাবা-মা থাকেন দিনাজপুর। ফেলে আসা ভিটে, লোকালয়, মানুষ বারবারই টানে, তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না, কিংবা নতুন বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। তাই এই দুইয়ের দ্বান্দ্বিকতায় নতুন প্রশ্ন জাগে মনে। ‘জীবন নতুন করে আরম্ভ করা যায় না? জীবন নতুন করে আরম্ভ করা যায় না? জীবন-জীবন- নতুন করে, নতুন নতুন?’ মূল এই দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে এই উপন্যাসিকা। নতুন জায়গায় এসে, নতুন পেশায় যোগ দিয়ে, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয় শিউলিকে। ফেলে আসা দিন তাড়া করে চলে অবিরত, সেখানে ফিরে যাওয়া যায় না, কিন্তু স্মৃতির কাছে আত্মসমর্পণে বাধা নেই। শিউলি তার কাছে কি খোঁজে- আশ্রয়, নাকি সান্ত্বনা? তার কান্না কি হারানোর বেদনা নাকি নতুন জায়গায় মানিয়ে না নিতে পারার হতাশা? নাকি এই দুই-ই? নাকি জীবনের কোনো অপ্রাপ্তিকে ঘিরে বেদনা? নাকি কনিষ্ঠদের মানুষ করার দায়িত্ববোধের নিচে চাপা পড়া নিজের স্বপ্নের জন্য বিষণ্নতা? নাকি এ সবই?
কেন মানুষ বারবার স্মৃতির কাছে ফিরে যায়? তা তো সতত সুখের নয়। তাহলে? তার মাঝে মিশে থাকে অস্তিত্বের এমন এক গল্প যাকে অবজ্ঞা করা যায় না। ৩৬ বছর বয়সের অনূঢ়া শিউলির স্বপ্ন কী? নতুন জীবনের? ঘর সংসারের? সংসার ছাড়া তখন কি মেয়েদের জীবন ভাবা যেত? তখনকার সমাজের মানুষের মনস্তত্ত্ব সেভাবে গড়ে উঠেছিল? পৃথিবী তার কাছে বারবার হারায়, আবার গড়ে ওঠে (?) নাকি সে গড়ে তুলতে চায়? ‘দেশ হারিয়ে, এমন কি দেশের স্মৃতি পর্যন্ত হারিয়ে সে এই শহরটার উপকণ্ঠে বাসা নিয়েছে। ৩৬ বছর বয়স হল তার। এই বয়সে বাংলাদেশের মেয়েরা কি করে?’
ফেলে আসা বর্ধমান বারবার টানে শিউলিকে। কিন্তু সেখানে ফেরা যায় না। সামনেই এগোয় জীবন। তাই শিউলির কিছু করার থাকে না। এক ভাই এক বোনকে কাছে রেখে মানুষ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে সে। স্বার্থপর ভাবনাও ঠাঁই নাই মনে। ‘বকুলকে সে টানবে কেন? তার জীবন আছে। সে তৈরি করছে তার জীবন। সুন্দর করবে সে জীবনকে। পূর্ণ করবে। উপভোগ করবে। তার দ্বিগুণ এখানে ফিরে পাবে।’ কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দেশভাগের পর বর্ধমান ছেড়ে তারা এসেছে নতুন দেশে। বাবা-মা আর বাকি ভাই বোনেরা দিনাজপুরে থাকে। সে কলেজে অধ্যাপনা করে। মাসের প্রথমেই বেতন পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় তাকে। শিউলির বাবা তমিজউদ্দিন সেই টাকায় কোনোরকমে সংসার চালান।
একসময় বর্ধমানের ডিসি অফিসের কেরানি ছিলেন তিনি। খুবই সাদামাটা জীবন। সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে, যেভাবে একটি আস্ত দেশ ভেঙে গিয়ে দু'ভাগ হয়েছে। নতুন দেশে এসে নতুন জীবন সংগ্রাম তাদের যে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সেই অবস্থান থেকে স্বপ্ন দেখতে বড্ড ভয় হয়। ‘জীবনটা অকৃতার্থ মনে হয়, মনে হয় একটা পৃথিবী হারিয়ে গিয়েছে, আরেকটা পৃথিবী গড়ে তোলা যাচ্ছে না, অতীতটাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেও কি আর একটা জীবন আরম্ভ করা যায় না?’ মনে এক অদ্ভুত সংশয় নিয়ে শিউলির জীবন বয়ে যেতে থাকে বহতা নদীর মতো।
একটা সুন্দর জীবনের জন্য আকুতি আছে শিউলির মনে। বর্তমানের এই জীবন তার কাঙ্খিত নয়। দায়িত্বের ভারে তার চাওয়া-পাওয়ার মৃত্যু ঘটে গেছে অনেক আগেই। তাই বারংবার সে ফিরে যায় তার অতীতে। স্মৃতি হাতড়ে নিয়ে আসে শৈশব। নিজের জীবনের যে ঘটনা প্রবাহ সে তুলে নিয়ে আসে আপাত সহজ সরল কিন্তু ভেতরে বড্ড কঠিন। শিউলি তার বাবা মার প্রথম সন্তান। তাদের বিয়ের ছয় বছরের মাথায় শিউলির জন্ম। ছেলের আকাঙ্ক্ষা, মেয়ের আবির্ভাব, প্রতিবেশীদের টিপ্পনি, দ্বান্দ্বিকতা, ছেলে-মেয়ে প্রসঙ্গে অভিভাবকদের প্রথাগত ভাবনা ইত্যাদি তার মনে আসে। তার আবির্ভাব ঘিরে পরিবারে এবং তার বাবার বন্ধুদের মাঝে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তা ওই সমাজে নতুন নয় মোটেও। শিউলির বাবা মেয়েই চেয়েছিলেন বলে যে কথা বলছেন তাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। তার বাবার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় ছানার জিলিপি, পানতোয়া আর হিংয়ের কচুরি খেয়ে সবাই তার জন্মটাকে উদযাপন করেছিল।
এসব ভাবতে ভাবতেই শিউলির মনে হয় সে এখন কোথায়? বাস্তুচ্যুতির বেদনা হানা দেয় তার ভাবনায়। ‘পৃথিবীর কোন অংশে রয়েছে সে? এটা কোন জায়গা? সত্যি করেই এই জায়গাটার কি কোনো ভৌগোলিক অবস্থান আছে? পৃথিবীর একটা অংশ, একটা কাল ভেঙ্গে গেছে, দুমড়ে গেছে, মুছে গেছে।’ শিউলি আজ বদলে যাওয়া পৃথিবীর মানুষ। ত্রিশ বছর আগে তার কাছে পৃথিবীটা ছিল অন্যরকম, ছেলেবেলাটা অন্যরকম। এখন শৈশবের খেলনা পৃথিবী ভারি হয়ে কাঁধের উপর চড়ে বসেছে। এখন সে বোঝা টানার কষ্ট বয়ে বেড়ায়। নামাতে পারে না, কারণ সংসারের বোঝা নামানো যায় না, কোমর ভেঙে গেলেও না। শিউলিও পারেনি। যার জীবনে শুধু গন্ধ বিলোবার কথা ছিল, সে কেমন শুকিয়ে গেল। দেশভাগের ফলে বিপন্ন জীবনের কথা বলতে গিয়ে লেখক স্বল্প পরিসরে মানুষের অদ্ভুত চরিত্রের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন।
শিউলির মার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন প্রতিবেশীরা বলেছিল, ‘আমরা বুঝিতো সব, ঐ রকম সোন্দর মেয়েরা বাঁজা হয় যে।’ আবার যখন শিউলির জন্ম হলো তখন সবাই বলল, ‘আহা! লোকটাকে একটা মেয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর কি ছেলেমেয়ে হয়?’ শিউলির জন্মের ৫ বছর পর যখন তার ভাই রিংকুর জন্ম হলো তখন দারোগা বলেছিল, ‘বছর বিয়োনি হয় এই কেরানীদের বউগুলো।’ এসব শিউলি মনে করেছে কারণ মানুষের স্মৃতিতে সব থাকে; ভালো-মন্দ সব, ভালো মানুষ-মন্দ মানুষ সবাই। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে মন্দ মানুষেরা জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে, যাদের কোনোভাবেই মুছে ফেলা যায় না। হিংসা-হীনম্মন্যতা-কুৎসার প্রতিযোগিতা সবই মানুষের অবচেতনে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। সুযোগ পেলেই মুখ বের করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ভেঙচি কাটে। এসব মনে করে শিউলি বেদনা অনুভব না করলেও ফেলে আসা দিনের স্মৃতি হিসেবে ধারণ করে।
একইসাথে তার মনে পড়েছে অনেক মানবিক মুখ। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার শ্যামল বাবু রোজ ডিসপেনসারি খুলে বসেন রোগী দেখার নাম করে। আসলে ওটা একটা আড্ডাখানাই বটে। সন্ধ্যায় সবাই আসেন, খবরের কাগজ পড়েন, চা খান, রাজনীতির হাতি-ঘোড়া মারেন তারপর যার যার বাড়ি চলে যান। রোগী তেমন একটা আসে না। যারা আসেন, ওষুধ নেন, কিন্তু পয়সা দেন না। কিন্তু তা নিয়ে শ্যামল বাবুর তেমন কোনো অভিযোগ নেই। এভাবে সবার সাথে, সবার পাশে থাকাটাই তিনি উপভোগ করেন। ‘নিজের দারিদ্র্যের অন্ত নেই, রোজগার পাতি নেই, অথচ সমস্ত প্রিয় কাজ করবার জন্য বসে আছেন।’ সাদামাটা সহমর্মী মানুষগুলো শিউলির মনে উঁকি দেয়। স্মৃতির পাতা উল্টে সেই মুখগুলো বারবার দেখে সে।
এই শ্যামল বাবুর ডিসপেন্সারিতে বসেই তখন রাজনীতির আলাপ করতেন তমিজুদ্দিনরা, কিন্তু দেশভাগের আগুনের আঁচ উপলব্ধি করেছিলেন বলে মনে হয় না। ‘তাদের সকলের অন্তরালে কি বিরাট নাটকের মহড়া চলেছে, গান্ধীজি দেশময় একটা তোলপাড় শুরু করেছেন- কায়েদে আজম তখনো মিস্টার জিন্নাহ। কিন্তু ছড়িয়ে পড়েছে তার নামও। একটা জটিল নাটক লিখছেন তখন দেশের হিন্দু মুসলমান নেতারা- তাতে শরিক ব্রিটিশ সরকার, তাতে জড়িত রয়েছে অগণ্য জনসাধারণ, অসংখ্য মানুষের ভাগ্য, প্রাণ, আত্মা- সব জড়িয়ে আছে সেই নাটকে। কে জানত সেই অসংখ্য কুশীলবদের মধ্যে আছেন তমিজ সাহেব- আছেন আরো অনেকে, যাঁদেরকে তিনি চিনতেন, যাঁদেরকে তিনি চিনতেন না।’ না চিনলে কি হবে? রাজনীতির দাবা খেলায় তমিজ উদ্দিন, শ্যামল বাবু, আব্দুর রাজ্জাক তারিনী বাবুরা বড়ে মাত্র। রাজ্য ঠেকাতে তাদের সহজেই উৎসর্গ করা যায়।
ভারতবর্ষে তখন যে রাজনীতির দাবা খেলা চলছে তার শেষ পরিণতি জানতেন না এসব ছাপোষা কেরানিরা যারা ‘শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে চেয়ারে বসে ফাইল ঘাটেন মাত্র।’ ভারতের প্রদেশে প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া দাবানল তাদের তখনও পোড়ায়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে আগুন লাগিয়েছিল তার আঁচ লেগেছিল ভালো মতোই। মানুষের জীবন, ইতিহাসের চাকা ও মানচিত্র বদলের ইঙ্গিত ছিল তার মাঝে। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। যে নতুন বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাক্ষী তারা হয়েছিলেন সেখানে ধ্বংস আর হতাশা ছাড়া তাদের জন্য আর কিছু অপেক্ষা করেনি। শিউলি তাহলে কি করবে? নিজেকেই প্রশ্ন করছে সে, ‘লেবু পাতার গন্ধ শুঁকে শুকে, আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে এক হারানো পৃথিবীর কথা চিন্তা করতে করতে আমাকে জীবনটা নিঃশেষ করতে হবে?’
বর্ধমানের টানাটানির সংসারেও শিউলিরা এক প্রশান্তি নিয়ে বসবাস করত। তমিজুদ্দিনের তেমন কোনো চাহিদা ছিল না, তিনি শুধু চাইতেন তার সন্তানেরা বেঁচে থাক। সংসারের সেই আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ্য শিউলির খুব মনে পড়তো। কিন্তু বর্ধমানের এই ছবি শিউলির জীবনে গেঁথে থাকলেও দেশটা সেভাবে থাকতে পারেনি। এক রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতার কারণে ‘পৃথিবীটাকে হেঁচড়ে হেঁচড়ে টানতে টানতে এসে পৌঁছালো উনিশ শো সাতচল্লিশে।’ নতুন পরিবেশে শিউলি সান্তনা খুঁজেছে এই ভেবে যে, দস্যুতা করে সব লুটে নিলেও স্মৃতি বেঁচে আছে, সেটাই কি কম লাভ?
ছোট ভাই রিংকুর মৃত্যু তাকে নাড়া দেয়, ভীষণ কষ্ট পায় সে। ছোট্ট রিংকু জ্বর বাঁধিয়ে বাড়ি ফিরে আসলে তাকে বিছানা করে শুইয়ে দেয় সে। রাতে জ্বর বাড়লে হঠাৎই শিউলি চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ওমা আমার ভাই বাঁচবে না।’ সত্যিই পরদিন রিংকুর মৃত্যু হলে তার আব্বা বলেছিলেন, ‘শিউলি ভবিষ্যৎবাণী করেছিল সে রাত্রে।’ কেন বলেছিল সে? সত্যিই কি ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাওয়ার কারণে শিউলির কষ্টটা অনেক বেশি!
বয়ঃসন্ধির পর তাকে আর ফ্রক পড়তে দেয়নি তার মা। তাকেও এক পরিবর্তন ঘিরে ধরেছিল। সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল অন্যদের থেকে। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলে এক ধরনের অতিসচেতনতা তৈরি হয় যা অন্যদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে উৎসাহ যোগায়। শিউলির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সে উপলব্ধি করেছিল যে বিচ্ছিন্নতাও এক ধরনের মৃত্যু। তার বাবা দূরে সরে গেলেন। মেয়েকে আর তিনি সেভাবে চিনতে পারেন না। তার মাঝে জন্ম নেওয়া গাম্ভীর্য দূরত্ব তৈরি করে। এর মাঝেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো- জাপানের বার্মায় বোমা হামলা, কলকাতায় বোমা, ইংরেজের পাশে মিত্রশক্তি তাও তারা শংকিত। তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের লম্বা হাত খাটো হয়ে আসার ইঙ্গিত মিলছিল। যুদ্ধ না করেও ভারত দুর্বল হয়ে গেল। ‘যুদ্ধ তার বিষ ছড়িয়ে যেতে থাকলো ঠিকই, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকলো সেই বিষ, আঘাত করলো সমাজের উচ্চতম ব্যক্তি থেকে নিম্নতম কেরানী কৃষক চাষী মজুর পর্যন্ত। যুদ্ধ না করে যুদ্ধের দায় বইতে হয়েছে ভারতকে, মিটিয়ে দিতে হয়েছে তার পাওনা, ভিতরে ভিতরে জীর্ণ হয়ে দাঁড়ালো ভারত পতনের কালো গহ্বরের সামনে। তার মেরুদণ্ড গেল ভেঙে, অর্থনৈতিক কাঠামো গেল বিপর্যস্ত হয়ে, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি গেল নড়বড়ে হয়ে। ইংরেজের শাসনের হাত হয়ে গেল শিথিল।’
এই বিপন্ন পৃথিবীতে শিউলির বিষণ্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন জেনেছিল সংসারের খরচ মেটাতে তার বাবা ঘুষ নিতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাতেও পেরে উঠছিলেন না সংসার সামলাতে। ঘুষ নেওয়া অভ্যাসে দাঁড়ালো, পঙ্কিলতার মাঝে নামলেন তমিজউদ্দিন, কিন্তু তাতেও পরিবারের আবরণ পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলেন না।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেললে কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তমিজ উদ্দিন দের জন্য নতুন যুদ্ধ অপেক্ষা করছিল। দু’বছর পর ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে যখন দুটি নতুন দেশের সৃষ্টি হলো তখন চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে তমিজ উদ্দিন চলে এলেন সম্পূর্ণ নতুন জায়গায়। ‘তারপর সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধের শুরু’- একথা বলার মধ্য দিয়ে উপন্যাসিকাটি শেষ হয়। প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধের কথাই বর্ণনা করে এসেছেন শুরু থেকে, যে যুদ্ধে একাই লড়েছে শিউলি, আর সে লড়াইয়ে সে বিন্দুমাত্র কিছু হটেনি।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতা ও দেশভাগের মিশ্র অনুভূতি তৈরি করেছিল। যাদের ভিটে ছাড়তে হয়নি তাদের কাছে এটা ছিল স্বাধীনতা আর যারা চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল তাদের জন্য ছিল দেশভাগ। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলা আর পাঞ্জাব। এই দুই প্রদেশের মানুষেরা দেশত্যাগ করেছিল বেশি। ধর্মীয় উগ্রবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এই সাম্প্রদায়িক ও ভূতাত্ত্বিক বিভাজন মেনে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তার ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়েছিল মূলত নিরীহ মানুষ। এক নিমেষেই কোটি কোটি মানুষকে তার ভিটেমাটি এবং চিরচেনা পরিবেশ থেকে উচ্ছেদ করে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল অচেনা পরিবেশ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ধর্মের মর্যাদা রক্ষার নামে মানুষের মর্যাদা লুণ্ঠন করা হয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের ভেতর দিয়ে মানবতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। দেশভাগ এখনো এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এই ঘটনাকে অনেকে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি সরল উপসংহার টানার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মোটেও সরল ছিল না। ভারতীয় রাজনীতিকদের সমর্থন ছাড়া এমন একটি অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত শুধু ইংরেজদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। রাজনীতির সেই জটিল-কুটিল দিক সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে থাকলেও এর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া থেকে তারা রক্ষা পায়নি। সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে মানুষেরা একদা ছিলেন বন্ধু, প্রতিবেশী ও সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার তারাই অতি দ্রুত হন্তারকের বেশে হাজির হয়েছে। চিরচেনা মুখটি কি তাহলে ছিল মুখোশ? এই প্রশ্ন আর একরাশ বেদনা নিয়ে অজস্র মানুষ সীমানা অতিক্রম করে পাড়ি দিয়েছে অন্যত্র। রক্ত আর অশ্রুজলে লেখা হয়েছিল তাদের নতুন জীবন-কাহিনি। সংবেদনশীল লেখকরা সাহিত্যের মাধ্যমে অমানবিক ঘটনাপ্রবাহকে নানা মাত্রায় লিপিবদ্ধ করেছেন। হাসান আজিজুল হকের ‘শিউলি’ উপন্যাসিকায় ছোট পরিসরে তেমনই এক বিপন্ন পরিবারের কাহিনি উঠে এসেছে যা একের হলেও অনেকের।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপন য স ক র জন ত ক র জন ত র র জন য পর ব র কর ছ ল থ কল ও কর ছ ন পর ব শ হয় ছ ল ন পর ব জ বন র র জ বন বল ছ ল র জন ম
এছাড়াও পড়ুন:
শিউলি: বাস্তুহারার দহনকথা
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন শুধু ভৌগোলিক বিভক্তি ছিল না। এর মাধ্যমে ভারতের বহু সম্প্রদায়িক ও বহু সংস্কৃতির বিভাজনও ঘটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতির পালাবদলে এই উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের ভীত দুর্বল হয়ে যায়। ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে শাসন ক্ষমতা পরিত্যাগ করার সময় ইংরেজ খণ্ডিত ভারত রেখে যায়। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক পরিচিতির ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত কতটা ভয়াবহ ছিল তা এখনো মানুষ প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করে।
দাঙ্গা, বাস্তুচ্যুতি, জবরদখল ইত্যাদি হিংসাত্মক ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের যে সূত্রপাত তখন হয়েছিল তার কারণে উভয় অংশের মানুষই ভিটে ছেড়েছে। দেশত্যাগের কারণে দুই ভূখণ্ডেই উদ্বাস্তু মানুষের চাপ বেড়েছে। দেশভাগ পরবর্তী বাস্তুত্যাগ মানব ইতিহাসে বড় রকমের বিয়োগান্ত এক ঘটনা, যার ফলে ১৪ মিলিয়ন মানুষ দেশছাড়া হয়েছিল। অভিবাসীরা নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেয়েছে। স্থানীয়দের শীতল ও অবন্ধুসুলভ আচরণের মাঝ দিয়েই তারা নতুন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।
মানব ইতিহাসের এই বিপর্যয় নিয়ে রচিত সাহিত্য সংখ্যায় ন্যূন নয়। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষায় রচিত সাহিত্য মানুষের সেই বেদনাকে নানাভাবে ধারণ করেছে। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের ফলে বর্ধমানের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর অনেক লেখায় নানাভাবে দেশত্যাগের বেদনা উঠে এসেছে। সেইসব রচনার মান বিচারে ‘শিউলি’ একটু পিছিয়ে থাকলেও তার গুরুত্ব অবহেলা করার মতো নয়।
মধ্যষাটে বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘শিউলি’ লেখা হয়েছিল বলে লেখক হাসান আজিজুল হক জানাচ্ছেন কিন্তু বাকিটা কেন লেখা হয়ে ওঠেনি তা অবশ্য জানাননি। এই উপন্যাসিকা মূলত এক অনূঢ়া নারীর একক সংগ্রামের কাহিনি যে তার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বের মাঝেও দেশভাগে বিপর্যস্ত নিজ পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার জীবনের বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখতে পাই একেবারেই শুরুতে। ‘চোখ দুটো তার আগুন বয়ে বেড়াতো, সর্বনাশের আগুন। মা বোধ হয় সেই আগুন দেখতে পেত।’ এই বর্ণনা থেকেই পাঠক আঁচ করতে পারেন সামনে বড় কোনো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। সেই বিপর্যয় যে আর কিছু নয় দেশভাগ তা পাঠক বুঝতে পারেন কিছু পরে। ‘দেশ ছাড়ার পরে, তার সেই শুকনো প্রসারিত দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম বোধ হয় সে এমন বিকেল লক্ষ করেছে। বিকেলের কথা মনে হলেই সেই প্রশস্ত দেশের মাঠের কথা মনে পড়তো। সেই মাঠে রোদ যেন আরাম করে শুয়ে থাকতো। সেই দেশের স্মৃতির সঙ্গে সেই বিকেলের স্মৃতি। এদেশে আসার পর বিকেল যেন শিউলি কোনোদিনই দেখেনি।’
দেশ ছেড়ে এসে এক ভাই আর এক বোনকে নিয়ে শিউলি অন্যত্র, আর খোকন-টুলু-রিনাকে নিয়ে তাদের বাবা-মা থাকেন দিনাজপুর। ফেলে আসা ভিটে, লোকালয়, মানুষ বারবারই টানে, তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না, কিংবা নতুন বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। তাই এই দুইয়ের দ্বান্দ্বিকতায় নতুন প্রশ্ন জাগে মনে। ‘জীবন নতুন করে আরম্ভ করা যায় না? জীবন নতুন করে আরম্ভ করা যায় না? জীবন-জীবন- নতুন করে, নতুন নতুন?’ মূল এই দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে এই উপন্যাসিকা। নতুন জায়গায় এসে, নতুন পেশায় যোগ দিয়ে, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয় শিউলিকে। ফেলে আসা দিন তাড়া করে চলে অবিরত, সেখানে ফিরে যাওয়া যায় না, কিন্তু স্মৃতির কাছে আত্মসমর্পণে বাধা নেই। শিউলি তার কাছে কি খোঁজে- আশ্রয়, নাকি সান্ত্বনা? তার কান্না কি হারানোর বেদনা নাকি নতুন জায়গায় মানিয়ে না নিতে পারার হতাশা? নাকি এই দুই-ই? নাকি জীবনের কোনো অপ্রাপ্তিকে ঘিরে বেদনা? নাকি কনিষ্ঠদের মানুষ করার দায়িত্ববোধের নিচে চাপা পড়া নিজের স্বপ্নের জন্য বিষণ্নতা? নাকি এ সবই?
কেন মানুষ বারবার স্মৃতির কাছে ফিরে যায়? তা তো সতত সুখের নয়। তাহলে? তার মাঝে মিশে থাকে অস্তিত্বের এমন এক গল্প যাকে অবজ্ঞা করা যায় না। ৩৬ বছর বয়সের অনূঢ়া শিউলির স্বপ্ন কী? নতুন জীবনের? ঘর সংসারের? সংসার ছাড়া তখন কি মেয়েদের জীবন ভাবা যেত? তখনকার সমাজের মানুষের মনস্তত্ত্ব সেভাবে গড়ে উঠেছিল? পৃথিবী তার কাছে বারবার হারায়, আবার গড়ে ওঠে (?) নাকি সে গড়ে তুলতে চায়? ‘দেশ হারিয়ে, এমন কি দেশের স্মৃতি পর্যন্ত হারিয়ে সে এই শহরটার উপকণ্ঠে বাসা নিয়েছে। ৩৬ বছর বয়স হল তার। এই বয়সে বাংলাদেশের মেয়েরা কি করে?’
ফেলে আসা বর্ধমান বারবার টানে শিউলিকে। কিন্তু সেখানে ফেরা যায় না। সামনেই এগোয় জীবন। তাই শিউলির কিছু করার থাকে না। এক ভাই এক বোনকে কাছে রেখে মানুষ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে সে। স্বার্থপর ভাবনাও ঠাঁই নাই মনে। ‘বকুলকে সে টানবে কেন? তার জীবন আছে। সে তৈরি করছে তার জীবন। সুন্দর করবে সে জীবনকে। পূর্ণ করবে। উপভোগ করবে। তার দ্বিগুণ এখানে ফিরে পাবে।’ কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দেশভাগের পর বর্ধমান ছেড়ে তারা এসেছে নতুন দেশে। বাবা-মা আর বাকি ভাই বোনেরা দিনাজপুরে থাকে। সে কলেজে অধ্যাপনা করে। মাসের প্রথমেই বেতন পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় তাকে। শিউলির বাবা তমিজউদ্দিন সেই টাকায় কোনোরকমে সংসার চালান।
একসময় বর্ধমানের ডিসি অফিসের কেরানি ছিলেন তিনি। খুবই সাদামাটা জীবন। সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে, যেভাবে একটি আস্ত দেশ ভেঙে গিয়ে দু'ভাগ হয়েছে। নতুন দেশে এসে নতুন জীবন সংগ্রাম তাদের যে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সেই অবস্থান থেকে স্বপ্ন দেখতে বড্ড ভয় হয়। ‘জীবনটা অকৃতার্থ মনে হয়, মনে হয় একটা পৃথিবী হারিয়ে গিয়েছে, আরেকটা পৃথিবী গড়ে তোলা যাচ্ছে না, অতীতটাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেও কি আর একটা জীবন আরম্ভ করা যায় না?’ মনে এক অদ্ভুত সংশয় নিয়ে শিউলির জীবন বয়ে যেতে থাকে বহতা নদীর মতো।
একটা সুন্দর জীবনের জন্য আকুতি আছে শিউলির মনে। বর্তমানের এই জীবন তার কাঙ্খিত নয়। দায়িত্বের ভারে তার চাওয়া-পাওয়ার মৃত্যু ঘটে গেছে অনেক আগেই। তাই বারংবার সে ফিরে যায় তার অতীতে। স্মৃতি হাতড়ে নিয়ে আসে শৈশব। নিজের জীবনের যে ঘটনা প্রবাহ সে তুলে নিয়ে আসে আপাত সহজ সরল কিন্তু ভেতরে বড্ড কঠিন। শিউলি তার বাবা মার প্রথম সন্তান। তাদের বিয়ের ছয় বছরের মাথায় শিউলির জন্ম। ছেলের আকাঙ্ক্ষা, মেয়ের আবির্ভাব, প্রতিবেশীদের টিপ্পনি, দ্বান্দ্বিকতা, ছেলে-মেয়ে প্রসঙ্গে অভিভাবকদের প্রথাগত ভাবনা ইত্যাদি তার মনে আসে। তার আবির্ভাব ঘিরে পরিবারে এবং তার বাবার বন্ধুদের মাঝে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তা ওই সমাজে নতুন নয় মোটেও। শিউলির বাবা মেয়েই চেয়েছিলেন বলে যে কথা বলছেন তাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। তার বাবার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় ছানার জিলিপি, পানতোয়া আর হিংয়ের কচুরি খেয়ে সবাই তার জন্মটাকে উদযাপন করেছিল।
এসব ভাবতে ভাবতেই শিউলির মনে হয় সে এখন কোথায়? বাস্তুচ্যুতির বেদনা হানা দেয় তার ভাবনায়। ‘পৃথিবীর কোন অংশে রয়েছে সে? এটা কোন জায়গা? সত্যি করেই এই জায়গাটার কি কোনো ভৌগোলিক অবস্থান আছে? পৃথিবীর একটা অংশ, একটা কাল ভেঙ্গে গেছে, দুমড়ে গেছে, মুছে গেছে।’ শিউলি আজ বদলে যাওয়া পৃথিবীর মানুষ। ত্রিশ বছর আগে তার কাছে পৃথিবীটা ছিল অন্যরকম, ছেলেবেলাটা অন্যরকম। এখন শৈশবের খেলনা পৃথিবী ভারি হয়ে কাঁধের উপর চড়ে বসেছে। এখন সে বোঝা টানার কষ্ট বয়ে বেড়ায়। নামাতে পারে না, কারণ সংসারের বোঝা নামানো যায় না, কোমর ভেঙে গেলেও না। শিউলিও পারেনি। যার জীবনে শুধু গন্ধ বিলোবার কথা ছিল, সে কেমন শুকিয়ে গেল। দেশভাগের ফলে বিপন্ন জীবনের কথা বলতে গিয়ে লেখক স্বল্প পরিসরে মানুষের অদ্ভুত চরিত্রের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন।
শিউলির মার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন প্রতিবেশীরা বলেছিল, ‘আমরা বুঝিতো সব, ঐ রকম সোন্দর মেয়েরা বাঁজা হয় যে।’ আবার যখন শিউলির জন্ম হলো তখন সবাই বলল, ‘আহা! লোকটাকে একটা মেয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর কি ছেলেমেয়ে হয়?’ শিউলির জন্মের ৫ বছর পর যখন তার ভাই রিংকুর জন্ম হলো তখন দারোগা বলেছিল, ‘বছর বিয়োনি হয় এই কেরানীদের বউগুলো।’ এসব শিউলি মনে করেছে কারণ মানুষের স্মৃতিতে সব থাকে; ভালো-মন্দ সব, ভালো মানুষ-মন্দ মানুষ সবাই। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে মন্দ মানুষেরা জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে, যাদের কোনোভাবেই মুছে ফেলা যায় না। হিংসা-হীনম্মন্যতা-কুৎসার প্রতিযোগিতা সবই মানুষের অবচেতনে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। সুযোগ পেলেই মুখ বের করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ভেঙচি কাটে। এসব মনে করে শিউলি বেদনা অনুভব না করলেও ফেলে আসা দিনের স্মৃতি হিসেবে ধারণ করে।
একইসাথে তার মনে পড়েছে অনেক মানবিক মুখ। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার শ্যামল বাবু রোজ ডিসপেনসারি খুলে বসেন রোগী দেখার নাম করে। আসলে ওটা একটা আড্ডাখানাই বটে। সন্ধ্যায় সবাই আসেন, খবরের কাগজ পড়েন, চা খান, রাজনীতির হাতি-ঘোড়া মারেন তারপর যার যার বাড়ি চলে যান। রোগী তেমন একটা আসে না। যারা আসেন, ওষুধ নেন, কিন্তু পয়সা দেন না। কিন্তু তা নিয়ে শ্যামল বাবুর তেমন কোনো অভিযোগ নেই। এভাবে সবার সাথে, সবার পাশে থাকাটাই তিনি উপভোগ করেন। ‘নিজের দারিদ্র্যের অন্ত নেই, রোজগার পাতি নেই, অথচ সমস্ত প্রিয় কাজ করবার জন্য বসে আছেন।’ সাদামাটা সহমর্মী মানুষগুলো শিউলির মনে উঁকি দেয়। স্মৃতির পাতা উল্টে সেই মুখগুলো বারবার দেখে সে।
এই শ্যামল বাবুর ডিসপেন্সারিতে বসেই তখন রাজনীতির আলাপ করতেন তমিজুদ্দিনরা, কিন্তু দেশভাগের আগুনের আঁচ উপলব্ধি করেছিলেন বলে মনে হয় না। ‘তাদের সকলের অন্তরালে কি বিরাট নাটকের মহড়া চলেছে, গান্ধীজি দেশময় একটা তোলপাড় শুরু করেছেন- কায়েদে আজম তখনো মিস্টার জিন্নাহ। কিন্তু ছড়িয়ে পড়েছে তার নামও। একটা জটিল নাটক লিখছেন তখন দেশের হিন্দু মুসলমান নেতারা- তাতে শরিক ব্রিটিশ সরকার, তাতে জড়িত রয়েছে অগণ্য জনসাধারণ, অসংখ্য মানুষের ভাগ্য, প্রাণ, আত্মা- সব জড়িয়ে আছে সেই নাটকে। কে জানত সেই অসংখ্য কুশীলবদের মধ্যে আছেন তমিজ সাহেব- আছেন আরো অনেকে, যাঁদেরকে তিনি চিনতেন, যাঁদেরকে তিনি চিনতেন না।’ না চিনলে কি হবে? রাজনীতির দাবা খেলায় তমিজ উদ্দিন, শ্যামল বাবু, আব্দুর রাজ্জাক তারিনী বাবুরা বড়ে মাত্র। রাজ্য ঠেকাতে তাদের সহজেই উৎসর্গ করা যায়।
ভারতবর্ষে তখন যে রাজনীতির দাবা খেলা চলছে তার শেষ পরিণতি জানতেন না এসব ছাপোষা কেরানিরা যারা ‘শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে চেয়ারে বসে ফাইল ঘাটেন মাত্র।’ ভারতের প্রদেশে প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া দাবানল তাদের তখনও পোড়ায়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে আগুন লাগিয়েছিল তার আঁচ লেগেছিল ভালো মতোই। মানুষের জীবন, ইতিহাসের চাকা ও মানচিত্র বদলের ইঙ্গিত ছিল তার মাঝে। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। যে নতুন বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাক্ষী তারা হয়েছিলেন সেখানে ধ্বংস আর হতাশা ছাড়া তাদের জন্য আর কিছু অপেক্ষা করেনি। শিউলি তাহলে কি করবে? নিজেকেই প্রশ্ন করছে সে, ‘লেবু পাতার গন্ধ শুঁকে শুকে, আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে এক হারানো পৃথিবীর কথা চিন্তা করতে করতে আমাকে জীবনটা নিঃশেষ করতে হবে?’
বর্ধমানের টানাটানির সংসারেও শিউলিরা এক প্রশান্তি নিয়ে বসবাস করত। তমিজুদ্দিনের তেমন কোনো চাহিদা ছিল না, তিনি শুধু চাইতেন তার সন্তানেরা বেঁচে থাক। সংসারের সেই আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ্য শিউলির খুব মনে পড়তো। কিন্তু বর্ধমানের এই ছবি শিউলির জীবনে গেঁথে থাকলেও দেশটা সেভাবে থাকতে পারেনি। এক রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতার কারণে ‘পৃথিবীটাকে হেঁচড়ে হেঁচড়ে টানতে টানতে এসে পৌঁছালো উনিশ শো সাতচল্লিশে।’ নতুন পরিবেশে শিউলি সান্তনা খুঁজেছে এই ভেবে যে, দস্যুতা করে সব লুটে নিলেও স্মৃতি বেঁচে আছে, সেটাই কি কম লাভ?
ছোট ভাই রিংকুর মৃত্যু তাকে নাড়া দেয়, ভীষণ কষ্ট পায় সে। ছোট্ট রিংকু জ্বর বাঁধিয়ে বাড়ি ফিরে আসলে তাকে বিছানা করে শুইয়ে দেয় সে। রাতে জ্বর বাড়লে হঠাৎই শিউলি চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ওমা আমার ভাই বাঁচবে না।’ সত্যিই পরদিন রিংকুর মৃত্যু হলে তার আব্বা বলেছিলেন, ‘শিউলি ভবিষ্যৎবাণী করেছিল সে রাত্রে।’ কেন বলেছিল সে? সত্যিই কি ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাওয়ার কারণে শিউলির কষ্টটা অনেক বেশি!
বয়ঃসন্ধির পর তাকে আর ফ্রক পড়তে দেয়নি তার মা। তাকেও এক পরিবর্তন ঘিরে ধরেছিল। সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল অন্যদের থেকে। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলে এক ধরনের অতিসচেতনতা তৈরি হয় যা অন্যদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে উৎসাহ যোগায়। শিউলির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সে উপলব্ধি করেছিল যে বিচ্ছিন্নতাও এক ধরনের মৃত্যু। তার বাবা দূরে সরে গেলেন। মেয়েকে আর তিনি সেভাবে চিনতে পারেন না। তার মাঝে জন্ম নেওয়া গাম্ভীর্য দূরত্ব তৈরি করে। এর মাঝেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো- জাপানের বার্মায় বোমা হামলা, কলকাতায় বোমা, ইংরেজের পাশে মিত্রশক্তি তাও তারা শংকিত। তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের লম্বা হাত খাটো হয়ে আসার ইঙ্গিত মিলছিল। যুদ্ধ না করেও ভারত দুর্বল হয়ে গেল। ‘যুদ্ধ তার বিষ ছড়িয়ে যেতে থাকলো ঠিকই, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকলো সেই বিষ, আঘাত করলো সমাজের উচ্চতম ব্যক্তি থেকে নিম্নতম কেরানী কৃষক চাষী মজুর পর্যন্ত। যুদ্ধ না করে যুদ্ধের দায় বইতে হয়েছে ভারতকে, মিটিয়ে দিতে হয়েছে তার পাওনা, ভিতরে ভিতরে জীর্ণ হয়ে দাঁড়ালো ভারত পতনের কালো গহ্বরের সামনে। তার মেরুদণ্ড গেল ভেঙে, অর্থনৈতিক কাঠামো গেল বিপর্যস্ত হয়ে, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি গেল নড়বড়ে হয়ে। ইংরেজের শাসনের হাত হয়ে গেল শিথিল।’
এই বিপন্ন পৃথিবীতে শিউলির বিষণ্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন জেনেছিল সংসারের খরচ মেটাতে তার বাবা ঘুষ নিতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাতেও পেরে উঠছিলেন না সংসার সামলাতে। ঘুষ নেওয়া অভ্যাসে দাঁড়ালো, পঙ্কিলতার মাঝে নামলেন তমিজউদ্দিন, কিন্তু তাতেও পরিবারের আবরণ পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলেন না।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেললে কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তমিজ উদ্দিন দের জন্য নতুন যুদ্ধ অপেক্ষা করছিল। দু’বছর পর ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে যখন দুটি নতুন দেশের সৃষ্টি হলো তখন চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে তমিজ উদ্দিন চলে এলেন সম্পূর্ণ নতুন জায়গায়। ‘তারপর সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধের শুরু’- একথা বলার মধ্য দিয়ে উপন্যাসিকাটি শেষ হয়। প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধের কথাই বর্ণনা করে এসেছেন শুরু থেকে, যে যুদ্ধে একাই লড়েছে শিউলি, আর সে লড়াইয়ে সে বিন্দুমাত্র কিছু হটেনি।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতা ও দেশভাগের মিশ্র অনুভূতি তৈরি করেছিল। যাদের ভিটে ছাড়তে হয়নি তাদের কাছে এটা ছিল স্বাধীনতা আর যারা চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল তাদের জন্য ছিল দেশভাগ। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলা আর পাঞ্জাব। এই দুই প্রদেশের মানুষেরা দেশত্যাগ করেছিল বেশি। ধর্মীয় উগ্রবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এই সাম্প্রদায়িক ও ভূতাত্ত্বিক বিভাজন মেনে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তার ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়েছিল মূলত নিরীহ মানুষ। এক নিমেষেই কোটি কোটি মানুষকে তার ভিটেমাটি এবং চিরচেনা পরিবেশ থেকে উচ্ছেদ করে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল অচেনা পরিবেশ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ধর্মের মর্যাদা রক্ষার নামে মানুষের মর্যাদা লুণ্ঠন করা হয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের ভেতর দিয়ে মানবতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। দেশভাগ এখনো এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এই ঘটনাকে অনেকে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি সরল উপসংহার টানার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মোটেও সরল ছিল না। ভারতীয় রাজনীতিকদের সমর্থন ছাড়া এমন একটি অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত শুধু ইংরেজদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। রাজনীতির সেই জটিল-কুটিল দিক সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে থাকলেও এর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া থেকে তারা রক্ষা পায়নি। সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে মানুষেরা একদা ছিলেন বন্ধু, প্রতিবেশী ও সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার তারাই অতি দ্রুত হন্তারকের বেশে হাজির হয়েছে। চিরচেনা মুখটি কি তাহলে ছিল মুখোশ? এই প্রশ্ন আর একরাশ বেদনা নিয়ে অজস্র মানুষ সীমানা অতিক্রম করে পাড়ি দিয়েছে অন্যত্র। রক্ত আর অশ্রুজলে লেখা হয়েছিল তাদের নতুন জীবন-কাহিনি। সংবেদনশীল লেখকরা সাহিত্যের মাধ্যমে অমানবিক ঘটনাপ্রবাহকে নানা মাত্রায় লিপিবদ্ধ করেছেন। হাসান আজিজুল হকের ‘শিউলি’ উপন্যাসিকায় ছোট পরিসরে তেমনই এক বিপন্ন পরিবারের কাহিনি উঠে এসেছে যা একের হলেও অনেকের।
তারা//