ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়কে এমন একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থার থেকে খুব একটা ভিন্ন নয় বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের বিশিষ্ট সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার। গত বৃহস্পতিবার দিল্লি প্রেসক্লাবে এক স্মরণসভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।

হর্ষ মান্দার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে করলেন, যখন এপ্রিলে দলীয় কংগ্রেসের আগে চূড়ান্ত প্রস্তাবের খসড়ায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া—মার্ক্সবাদী (সিপিআই–এম) বলেছে, মোদি সরকারের মধ্যে ‘নব্য ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য’ থাকলেও এটিকে ‘ফ্যাসিবাদী বা নব্য ফ্যাসিবাদী’ শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।

দিল্লির মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস জাকিয়া জাফরির স্মরণে বৃহস্পতিবারের ওই সভার আয়োজন করেছিল। কংগ্রেসদলীয় লোকসভার সংসদ সদস্য (১৯৭৭-৮০) এহসান জাফরির স্ত্রী হচ্ছেন জাকিয়া জাফরি। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় আহসান জাফরিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

স্বামীকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় দীর্ঘ ২০ বছর আইনি লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টে হেরে যান জাকিয়া। এহসানকে পুড়িয়ে হত্যার পেছনে কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল না বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। জাকিয়া জাফরি মারা গেছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি।

জাকিয়ার স্মরণসভায় বৃহস্পতিবার হর্ষ মান্দার বলেন, ‘আমি নাৎসি জার্মানি নিয়ে অনেক দিন ধরে পড়াশোনা করেই বলছি, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়কে এমন একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। এটা অত্যন্ত ভয়ের পরিস্থিতি। অবশ্যই জার্মানির “হলোকাস্ট” বা গণহত্যা আক্ষরিক অর্থে এখানে সম্ভব নয়, কারণ মুসলমানদের সংখ্যাটা এখানে অনেক বড়, ২০ কোটি।’ ১৯৩৩ সালে যখন নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসে, তখন জার্মানিতে ইহুদিদের সংখ্যা ১ শতাংশের কম ছিল।

ভারতের ভবিষ্যৎ কী

এখন প্রশ্ন হলো, ভারতে ভবিষ্যতে কী হবে? এই প্রসঙ্গে জন্মসূত্রে ইহুদি ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক হ্যানা আরেন্ডটকে উদ্ধৃত করে হর্ষ মান্দার বলেন, ওই জার্মান দার্শনিক বলেছিলেন, নাগরিকত্ব হলো ‘অধিকার পাওয়ার অধিকার’ (রাইট টু হ্যাভ রাইটস)।

হর্ষ মান্দারের কথায়, ‘ভারতীয় মুসলিমদের এমন একটা কোণে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এই অধিকার পাওয়ার অধিকার তাদের জন্য ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।’

নিজের মতো করে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন মান্দার। তিনি বলেন, একটি অল্পবয়সী ছেলে নাকি একটি ক্রিকেট ম্যাচের সময় পাকিস্তানের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিল। কিছু লোক নাকি সেটি শুনেছে। কিছু লোকের সেই সম্ভবত শোনার ভিত্তিতে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়নি। তাঁর মা–বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগটি কি? অভিযোগ হলো, আরেকটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—আজকের ভারতে এই ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

মান্দার আরও বলেন, আজকের ভারতে প্রার্থনা করাও একটা অপরাধ। সে কারণেই আমি বলছিলাম, আজকের ভারতে মুসলমানরা সমাজের এমন একটা কোনায় চলে গেছে, যেখানে তাদের অধিকার থাকারই আর কোনো অধিকার নেই। এই রোহিঙ্গাদেরই দেখুন। এরাও এখন সেই ধরনের মানুষ, যাদের অধিকার থাকার অধিকার আর নেই।

বিশিষ্ট এই ভারতীয় সমাজকর্মী বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি এখন মনে করি, ভারতে যাঁরা বিশ্বাস করেন যে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার আছে, তাঁরা সবাই এক অন্ধকার সময়ে প্রবেশ করেছেন। ভারতে সব রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা—সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা সংখ্যালঘু কমিশন বলে যে কিছু আছে, সেটা তো আমরা ভুলেই গেছি। শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’

বক্তৃতার একেবারে শেষে সামান্য আশার কথা বলেন সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার। তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় আমাদের সাধারণ মানুষকে লড়াই করতে হবে। ফিরে আসার লড়াই। সেটা আমি দেখতেও পাচ্ছি। এই যে কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে এত মানুষ যখন মারা গেলেন, তখন আমরা কী দেখলাম…মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন? আমরা দেখলাম তাঁরা মসজিদে আশ্রয় নিলেন। এটাই আমার ভারত। আর এটাকে ফিরে পেতেই আমাদের লড়াই করতে হবে। আমরা ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসা দিয়ে লড়ব।’

জাকিয়া জাফরির দুই সন্তান তানভীর ও নিশরিন জাফরি ছাড়াও স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ভাষা সিং, সমাজকর্মী জন ডায়াল, সাবেক সংসদ সদস্য কুমার দানিশ আলী, অধ্যাপক নন্দিতা নারাইন, আইনজীবী নিত্যা রামকৃষ্ণান ও শিক্ষাবিদ সৈয়দা হামিদ।

সভা পরিচালনার সময় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রশান্ত ট্যান্ডন বলেন, ‘২০০২ সালে গুজরাটে যে ধরনের মানুষদের আমরা দেখেছিলাম, তাঁরা সমাজে এখনো বিদ্যমান। গুজরাটের সেই সহিংসতা আমরা আখলাক বা পেহলু খানের বিরুদ্ধে ঘটতে দেখেছি। গত কয়েক বছরে আখলাক বা পেহলু খানের মতো ভারতে আরও অনেককে পিটিয়ে মারা হয়েছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এমন একট এমন এক ন একট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণ প্রজন্ম পড়াশোনা করলেও সাংবাদিকতায় আসছে না: প্রেস সচিব

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘‘অনেক তরুণ সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করছেন, যারা সাংবাদিকতায় আসেন না।’ 

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রাজশাহীর সাংবাদিক মাসুমা ইসলামের স্মরণসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। 

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিকালে নগরের একটি রেস্তোরাঁয় রাজশাহী টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এ স্মরণসভার আয়োজন করে।

এসময় প্রেস সচিব বলেন, ‘‘মাসুমা একজন নারী হয়ে তৃণমূল সাংবাদিকতায় যে উদাহরণটা তৈরি করেছেন, তা সামনে রেখে অনেক তরুণ সাংবাদিকতা পেশায় আসতে উৎসাহিত হবেন।’’ তিনি সাংবাদিক মাসুমার স্মৃতি রক্ষার্থে নারী জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড চালুর আহ্বান জানান।

স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, ‘‘সাংবাদিক মাসুমার শুন্যতা কখনই পূরণ হওয়ার নয়। উত্তরাঞ্চলে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাসুমা যে সাংবাদিকতা করে গেছেন তা স্মরণীয়। মাসুমা তার জীবদ্দশায় সাংবাদিকতায় অনেক বড় ভূমিকা রেখে গেছেন।’’

শোকসভায় রাজশাহী টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী হাসান শ্যামল, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, এনটিভির রাজশাহী প্রতিনিধি শ. ম সাজু, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান আহসান হাবীব অপু, দেশ টিভির রাজশাহী প্রধান কাজী শাহেদ, এসএ টিভির ব্যুরো প্রধান জিয়াউল গনি সেলিমসহ রাজশাহীতে কর্মরত বিভিন্ন টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/কেয়া/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করেছিলেন শুভাগত চৌধুরী
  • তরুণ প্রজন্ম পড়াশোনা করলেও সাংবাদিকতায় আসছে না: প্রেস সচিব