ভারতে মুসলিমদের অবস্থা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের থেকে ভিন্ন নয়: সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার
Published: 1st, March 2025 GMT
ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়কে এমন একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থার থেকে খুব একটা ভিন্ন নয় বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের বিশিষ্ট সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার। গত বৃহস্পতিবার দিল্লি প্রেসক্লাবে এক স্মরণসভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
হর্ষ মান্দার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে করলেন, যখন এপ্রিলে দলীয় কংগ্রেসের আগে চূড়ান্ত প্রস্তাবের খসড়ায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া—মার্ক্সবাদী (সিপিআই–এম) বলেছে, মোদি সরকারের মধ্যে ‘নব্য ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য’ থাকলেও এটিকে ‘ফ্যাসিবাদী বা নব্য ফ্যাসিবাদী’ শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
দিল্লির মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস জাকিয়া জাফরির স্মরণে বৃহস্পতিবারের ওই সভার আয়োজন করেছিল। কংগ্রেসদলীয় লোকসভার সংসদ সদস্য (১৯৭৭-৮০) এহসান জাফরির স্ত্রী হচ্ছেন জাকিয়া জাফরি। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় আহসান জাফরিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
স্বামীকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় দীর্ঘ ২০ বছর আইনি লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টে হেরে যান জাকিয়া। এহসানকে পুড়িয়ে হত্যার পেছনে কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ছিল না বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। জাকিয়া জাফরি মারা গেছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি।
জাকিয়ার স্মরণসভায় বৃহস্পতিবার হর্ষ মান্দার বলেন, ‘আমি নাৎসি জার্মানি নিয়ে অনেক দিন ধরে পড়াশোনা করেই বলছি, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়কে এমন একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। এটা অত্যন্ত ভয়ের পরিস্থিতি। অবশ্যই জার্মানির “হলোকাস্ট” বা গণহত্যা আক্ষরিক অর্থে এখানে সম্ভব নয়, কারণ মুসলমানদের সংখ্যাটা এখানে অনেক বড়, ২০ কোটি।’ ১৯৩৩ সালে যখন নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসে, তখন জার্মানিতে ইহুদিদের সংখ্যা ১ শতাংশের কম ছিল।
ভারতের ভবিষ্যৎ কী
এখন প্রশ্ন হলো, ভারতে ভবিষ্যতে কী হবে? এই প্রসঙ্গে জন্মসূত্রে ইহুদি ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক হ্যানা আরেন্ডটকে উদ্ধৃত করে হর্ষ মান্দার বলেন, ওই জার্মান দার্শনিক বলেছিলেন, নাগরিকত্ব হলো ‘অধিকার পাওয়ার অধিকার’ (রাইট টু হ্যাভ রাইটস)।
হর্ষ মান্দারের কথায়, ‘ভারতীয় মুসলিমদের এমন একটা কোণে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এই অধিকার পাওয়ার অধিকার তাদের জন্য ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।’
নিজের মতো করে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন মান্দার। তিনি বলেন, একটি অল্পবয়সী ছেলে নাকি একটি ক্রিকেট ম্যাচের সময় পাকিস্তানের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিল। কিছু লোক নাকি সেটি শুনেছে। কিছু লোকের সেই সম্ভবত শোনার ভিত্তিতে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়নি। তাঁর মা–বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগটি কি? অভিযোগ হলো, আরেকটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—আজকের ভারতে এই ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
মান্দার আরও বলেন, আজকের ভারতে প্রার্থনা করাও একটা অপরাধ। সে কারণেই আমি বলছিলাম, আজকের ভারতে মুসলমানরা সমাজের এমন একটা কোনায় চলে গেছে, যেখানে তাদের অধিকার থাকারই আর কোনো অধিকার নেই। এই রোহিঙ্গাদেরই দেখুন। এরাও এখন সেই ধরনের মানুষ, যাদের অধিকার থাকার অধিকার আর নেই।
বিশিষ্ট এই ভারতীয় সমাজকর্মী বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি এখন মনে করি, ভারতে যাঁরা বিশ্বাস করেন যে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার আছে, তাঁরা সবাই এক অন্ধকার সময়ে প্রবেশ করেছেন। ভারতে সব রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা—সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা সংখ্যালঘু কমিশন বলে যে কিছু আছে, সেটা তো আমরা ভুলেই গেছি। শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’
বক্তৃতার একেবারে শেষে সামান্য আশার কথা বলেন সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার। তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় আমাদের সাধারণ মানুষকে লড়াই করতে হবে। ফিরে আসার লড়াই। সেটা আমি দেখতেও পাচ্ছি। এই যে কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে এত মানুষ যখন মারা গেলেন, তখন আমরা কী দেখলাম…মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন? আমরা দেখলাম তাঁরা মসজিদে আশ্রয় নিলেন। এটাই আমার ভারত। আর এটাকে ফিরে পেতেই আমাদের লড়াই করতে হবে। আমরা ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসা দিয়ে লড়ব।’
জাকিয়া জাফরির দুই সন্তান তানভীর ও নিশরিন জাফরি ছাড়াও স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ভাষা সিং, সমাজকর্মী জন ডায়াল, সাবেক সংসদ সদস্য কুমার দানিশ আলী, অধ্যাপক নন্দিতা নারাইন, আইনজীবী নিত্যা রামকৃষ্ণান ও শিক্ষাবিদ সৈয়দা হামিদ।
সভা পরিচালনার সময় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রশান্ত ট্যান্ডন বলেন, ‘২০০২ সালে গুজরাটে যে ধরনের মানুষদের আমরা দেখেছিলাম, তাঁরা সমাজে এখনো বিদ্যমান। গুজরাটের সেই সহিংসতা আমরা আখলাক বা পেহলু খানের বিরুদ্ধে ঘটতে দেখেছি। গত কয়েক বছরে আখলাক বা পেহলু খানের মতো ভারতে আরও অনেককে পিটিয়ে মারা হয়েছে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এমন একট এমন এক ন একট অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ঢেকে রাখা সেই মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালে শেখ মুজিবের স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে ফেলা হলো
লালমনিরহাট শহরের শিশুপার্ক সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমঞ্চে স্থাপিত ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে জেলা প্রশাসন। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন ওই ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কাপড় দিয়ে ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম পার না হতেই রোববার জেলা প্রশাসন মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিচিহ্ন ম্যুরাল ভাঙার কাজে হাত দেয়।
এর আগে শনিবার দুপুুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মঞ্চে দু’টি পক্ষ একই সময়ে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুপুর সাড়ে ১১টায় ওই এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ব স্মৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লালমনিরহাট শাখার প্রধান সমন্বয়ক হামিদুর রহমান ম্যুরাল অপসারণ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরাতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এ সময় তিনি দাবি করে বলেন, ‘এই ম্যুরালটি স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বহন করে না। বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিরঞ্জিত উপস্থাপন ও ইতিহাস বিকৃতি করায় এর আগেও ১৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ম্যুরালটি ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫২, ৭১ এর সকল সত্য ইতিহাস অক্ষুণ্ণ রেখে অতিরঞ্জিত অংশ ও স্বৈরাচারের চিহ্ন ঢেকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো দেয়াল ঢেকে দেয়, যা অনাকাঙ্খিত। কিছু স্বৈরাচারের দোসর তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ, স্বার্থ উদ্ধার ও বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমকে ভুলভাবে প্রচার করতে থাকে এবং বিদ্বেষবশত মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবগত ছিল না, তাঁরা এমন কোনো দাবিও করে নাই। স্বৈরাচারের সকল চিহ্ন ও ম্যুরাল অপসারণ ছাত্রজনতার দাবি ও গণআকাঙ্খা।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধ এলাকায় যান। সেখানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, ম্যুরালের মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানে যেমন অবদান রয়েছে তেমনি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানেরও অবদান রয়েছে। অথচ ম্যুরালে জিয়াউর রহমানের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এটা বৈষম্য। এই ম্যুরাল রাখা ঠিক নয়।
শনিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রাসেল আহমেদ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গেলে তোপের মুখে পড়েন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই ম্যুরালে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, ৭১ এর গণহত্যা, বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন ঢেকে দিয়ে চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন জেলা প্রশাসন। পরে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর দায় চাপিয়েছেন। ৭১ ও ২৪কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতিকে বিভাজিত করে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭১ এর অস্তিত্ব ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাদ দিয়ে অন্যগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো মতানৈক্য নেই।
২৬ মার্চ বুধবার সকালে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দিতে গেলে কাপড় দিয়ে মুরাল ঢেকে রাখার বিষয়টি চোখে পড়ে। সনাক সদস্যরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিরে যান। পরে লালমনিরহাট রেলওয়ে শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দেন তাঁরা। গত ১৬ ডিসেম্বরও একই রকম ঘটনা ঘটায় জেলা প্রশাসন। ১৪০ ফুট দীর্ঘ ওই ম্যুরালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, উদিত সূর্য, ৭১ এর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানি, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের বক্তব্য জানতে তাঁর ফোনে মেসেজ এবং ফোন দিলে কোনো সাড়া মেলেনি।