ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দাঁড়াতে পারেনি
Published: 1st, March 2025 GMT
ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দেড় দশকের বেশি সময়েও দাঁড়াতে পারেনি। এ শিল্পের জন্য বরাদ্দ জমি ফাঁকা পড়ে আছে। চাহিদার ৯৫ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হলেও এর কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
১৭ বছর আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এ শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। সেখানে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করেছে। দুটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। ২৩টি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ জমি ফাঁকা পড়ে আছে।
সাধারণত ওষুধে দুই ধরনের উপাদান থাকে। একটি হলো মূল কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই)। অন্যটি হলো সহযোগী নিষ্ক্রিয় উপাদান (এক্সিপিয়েন্ট)। যেমন প্যারাসিটামল বড়ির এপিআইয়ের নাম ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’। এটা মানুষের শরীরে কাজ করে, রোগ সারায়। কিন্তু প্যারাসিটামল বড়িতে সেলুলোজ, ট্যাল্কসহ কিছু উপাদান থাকে। এগুলো হলো এক্সিপিয়েন্ট; যা এপিআইকে বড়ির আকার দিতে, বড়ি মানুষের শরীরে দ্রুত দ্রবীভূত হতে সহায়তা করে। তবে এক্সিপিয়েন্ট শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায় না।
ওষুধশিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার এপিআই আমদানি করে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে এপিআই আমদানি খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি এপিআই উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে। সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ তা বেশি কাজে লাগাতে পারেনি। কোম্পানিগুলো আগ্রহ কম দেখিয়েছে, সরকারেরও মনোযোগ কম ছিল।
ওষুধে পরনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে এপিআই তৈরির বিকল্প নেই। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের এপিআই তৈরির ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দেব। এ জন্য এই শিল্পের যে নিরাপত্তা ও প্রণোদনা দরকার, তা আমরা দেব। মো.সায়েদুর রহমান, বিশিষ্ট ওষুধবিজ্ঞানী
ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। দেশে ব্যবহৃত ওষুধের ৯৫ শতাংশ দেশেই তৈরি হয়, প্রয়োজনের ৫ শতাংশ শুধু আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিও করে। এত সবের পরও ওষুধের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মাত্র ১০ শতাংশ কাঁচামাল বা এপিআই দেশে তৈরি হয়। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো চীন ও ভারত থেকে বেশি এপিআই আমদানি করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সঠিক পদক্ষেপ নিলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি কমানো সম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতিগণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস ১৯৮৮ সালে দেশে প্রথম এপিআই তৈরি শুরু করে। তাদের প্রথম এপিআই ছিল এমোক্সসিলিন। এটি অ্যান্টিবায়োটিক। এরপর গণস্বাস্থ্য আরও দুটি এপিআই তৈরি করে।
এর পর থেকে অগ্রগতি তেমন হয়নি। দেশের ছোট ও বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো একটি বা দুটি করে এপিআই তৈরি করেছে। তবে যে ধরনের নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা দরকার, তা ওষুধ কোম্পানিগুলো পায়নি। এপিআই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএআইএমএ) বলছে, গত আট বছরে স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি ৪০টির বেশি এপিআই তৈরি করেছে।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে এপিআই তৈরি করে নিজের ওষুধ কোম্পানিতে তা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এপিআই তৈরি করে দেশের মধ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। দেশি কোম্পানিগুলো আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রণোদনা পেলে দেশের প্রয়োজনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এপিআই দেশেই তৈরি সম্ভব।
বিআইএমএর সভাপতি এস এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর—প্রতিটি দেশ এই শিল্পকে নিরাপত্তা দিয়েছে, ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে। আমাদের তা দিতে হবে। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা ও অনুমোদনপ্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ওষুধশিল্পের যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে, তা এই শিল্পকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে সহায়তা করবে।’
পড়ে আছে জমিসরকার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে ২০০৮ সালে এপিআই শিল্প গড়ে তোলার জন্য মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বাউসিয়া এলাকায় ২০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। এর নাম ‘এপিআই শিল্পপার্ক’। স্থানীয় বিসিক কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জমি ৪২টি প্লটে ভাগ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্লটগুলো দেওয়া হয়েছে ২৭টি ওষুধ কোম্পানিকে। কোনো কোনো কোম্পানি একাধিক প্লট নিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি সবারই এখানে প্লট আছে।
১১ ফেব্রুয়ারি এপিআই শিল্পপার্কে গিয়ে দেখা যায়, শিল্প গড়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। সিংহভাগ জমি পড়ে আছে। ঝোপঝাড়ে ভরা। চারটি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এগুলো হলো হেলথকেয়ার কেমিক্যালস, এক্মি, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও ইবনে সিনা। এর মধ্যে হেলথকেয়ার কেমিক্যালস ও এক্মি এপিআই তৈরি করছে। ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও ইবনে সিনা খুব শিগগির এপিআই তৈরি শুরু করবে।
ইবনে সিনার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ও এপিআই প্ল্যান্টের প্রধান মো. শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি প্রধান সমস্যার মুখে পড়েছেন শিল্পপার্কে প্লট নেওয়া ব্যবসায়ীরা। এপিআই উৎপাদনের জন্য ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দরকার হয়। কিন্তু শিল্পপার্ক এলাকায় সব সময় বিদ্যুৎ থাকে না, থাকলেও বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম থাকে। দ্বিতীয়ত, পার্ক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ নেই। তৃতীয়ত, ছাড়পত্রের জটিলতা। একটি এপিআই কারখানার জন্য ১৮ থেকে ২০ ধরনের ছাড়পত্রের দরকার হয়। এক একটি ছাড়পত্রের জন্য মাসের পর মাস বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয়।
আরও একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেছেন। এসব সমস্যার কারণে অনেক ওষুধ কোম্পানি জমি নিলেও কারখানা তৈরিতে উৎসাহ পাচ্ছে না। কাজ শুরুর পর একটি কারখানা উৎপাদনের পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগে।
বিশিষ্ট ওষুধবিজ্ঞানী ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার সম্ভাব্য সর্বক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা অর্জনে গুরুত্ব দিচ্ছে। পরনির্ভরতা কমানো তার অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে। ওষুধে পরনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে এপিআই তৈরির বিকল্প নেই। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের এপিআই তৈরির ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দেব। এ জন্য এই শিল্পের যে নিরাপত্তা ও প্রণোদনা দরকার, তা আমরা দেব।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই শ ল প ই আমদ ন বর দ দ র জন য ব যবস সরক র দরক র ধরন র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
কেশবপুরের প্রিয়া খাতুন এবারও সাইকেলিংয়ে দেশসেরা
৫৩তম শীতকালীন জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাইকেলিংয়ে নারীদের মধ্যে দেশসেরা হয়েছে যশোরের কেশবপুরের প্রিয়া খাতুন। সে কেশবপুরের গড়ভাঙা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এর আগে ৫২তম আসরেও সে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল।
২৫ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রিয়া ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও অঞ্চল পেরিয়ে সাইকেলিং প্রতিযোগিতায় সেরার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হয় প্রিয়া। তার হাতে ট্রফি তুলে দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ।
গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে কেশবপুরে এসে পৌঁছায় প্রিয়া খাতুন। তখন তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এলাকার মানুষ।
গড়ভাঙা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভাত বসু বলেন, ‘প্রিয়ার সাফল্যে আমরা গর্বিত।’ ক্রীড়া শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, কঠোর অনুশীলন ও একাগ্রতা প্রিয়াকে সাফল্যের শেষ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।
গরিব পরিবারের সন্তান প্রিয়া খাতুন ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রচণ্ড রকমের আগ্রহী। সব খেলাতে সে পারদর্শী। তবে সাইকেলের প্রতি তার আগ্রহটা বেশি। সে কারণে ছোটবেলা থেকেই সে গ্রামে সাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। সেই সাইকেলিংয়ে এখন সে দেশসেরা। প্রিয়ার মা লাকি বেগম সন্তানের সাফল্যে খুবই খুশি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রিয়া খাতুনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, প্রিয়ার সাফল্যে কেশবপুরবাসী গর্বিত। গড়ভাঙা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে প্রমাণ করেছে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েও যদি ইচ্ছা শক্তি থাকে তাহলে অবশ্যই সেরা হওয়া যায়।