ধামাইয়ে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ
Published: 1st, March 2025 GMT
এস এম ইমদাদুল হক ১৯৭১ সালে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। চাকরি করতেন সেনাবাহিনীতে। তিনি তখন লেফটেন্যান্ট। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন তাঁরা ১২ জন একসঙ্গে পালিয়ে ভারতে যান। এস এম ইমদাদুল হককে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টর এলাকায়, পরে জেড ফোর্সের অধীন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। ৭ নভেম্বর মৌলভীবাজারের ধামাই চা-বাগানে এক খণ্ডযুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
ধামাই চা-বাগানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর স্বল্প তৎপরতার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই এলাকায় ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ধামাই চা-বাগানের অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সেখানে আক্রমণ করা, চা-বাগানের দখল নেওয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই আক্রমণের দায়িত্ব পড়ে এস এম ইমদাদুল হকের ওপর। ৭ নভেম্বর রাতে তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত অতিক্রম করে চা-বাগান থেকে দূরে এক স্থানে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেন।
আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল ভোররাত। আক্রমণ শুরুর আগে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এগিয়ে যান পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান নিজ চোখে দেখার জন্য। এ সময় বাগানে থাকা কয়েকটি কুকুর ডেকে উঠলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি শুরু করে। তাঁর সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করেন। তিনি নিজে পাকিস্তানি ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়েন। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। এর মধ্যে দূরে থাকা সহযোদ্ধারাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ইমদাদুল হক সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং যুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে ঢুকে পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের একদম ভেতরে। এ সময় আহত হন তাঁর এক সহযোদ্ধা। তাঁকে উদ্ধার করতে তিনি নিজেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। শহীদ হন এই সাহসী যোদ্ধা। সে যুদ্ধে আরও দুজন শহীদ হন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর এবং অন্য দুই সহযোদ্ধার মরদেহ উদ্ধার করে সমাহিত করেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের চল্লিশধন কদমতলায়।
# এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তম
গ্রাম: মাটলা, সদর, গোপালগঞ্জ। বাবা আবদুল মালেক, মা রওশন নেছা। অবিবাহিত। খেতাবের সনদ নম্বর ২৬। শহীদ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। প্রথম খণ্ড। প্রথমা প্রকাশন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শুধু রণাঙ্গনের যোদ্ধারাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’, বাকিরা সহযোগী: উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম
অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, ১৯৭১ সালে যারা রণাঙ্গনে সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন, শুধু তারাই মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পাবেন। এ ছাড়া দেশ ও বিদেশে থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, কূটনৈতিক তৎপরতা ও অন্যান্য সহযোগিতা করেছেন, তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
ফারুক-ই-আজম বলেন, বর্তমান প্রচলিত আইনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি, এমন আট ধরনের ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে পরিবর্তন আনার জন্য ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া করে এ বিষয়ে অংশীজনদের মতামতও নেওয়া হয়েছে। খসড়াটি মার্চের প্রথম সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
সনদধারী অমুক্তিযোদ্ধাদের অপসারণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি রয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনে আমরা কিছু সংশোধন আনতে চাচ্ছি। বড় ধরনের সংশোধন আসবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে।
নতুন আইনের মূল দিকগুলো হলো-
১. রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা: যারা ১৯৭১ সালে সরাসরি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই কেবল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
২. মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী: জনমত গঠন, কূটনৈতিক সহায়তা, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, চিকিৎসা সহায়তাকারী ব্যক্তিদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৩. বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পর্যালোচনা: অতীতে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ যদি নতুন সংজ্ঞার আওতায় না পড়েন, তবে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
৪. বয়সসংক্রান্ত নীতি: মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ বছর ৬ মাস। এটি নিয়ে মামলা থাকায় আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর নতুন আইন কার্যকর হবে।
৫. ভুল তথ্য প্রদানকারীদের জন্য সুযোগ: যারা ভুল তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা নিয়েছেন, তাদের ২৬ মার্চের মধ্যে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, বর্তমান আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’ তবে নতুন খসড়ায় এই অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন আইনে কেবল রণাঙ্গনে লড়াই করা ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ উপাধি প্রবর্তন করা হচ্ছে।
বিএইচ