নেতারা দেশে গণতন্ত্র চান, দলে চান না
Published: 1st, March 2025 GMT
অনেক বছর পর মুক্ত পরিবেশে বিএনপি একটি বর্ধিত সভা করতে পারায় নিশ্চয়ই দলের নেতা–কর্মীরা আনন্দিত। এই বর্ধিত সভাটি এমন এক সময়ে হলো, যখন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সেনাসমর্থিত সরকারের আমল থেকে সেখানে অবস্থান করছেন। তাঁরা দুজনই ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিয়েছেন এবং দলীয় নেতা–কর্মীদের প্রতি দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা দিয়েছেন।
বর্ধিত সভায় বিভিন্ন স্তরের শ খানেক নেতা বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁদের বক্তৃতায় সরকারের সংস্কার ও দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বিষয় উঠে এসেছে। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ ও একদা জোটসঙ্গী জামায়াতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছেন নেতারা। আন্দোলনের সময়ে যেসব নেতা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাঁরা যাতে নতুন করে নেতৃত্বে না আসতে পারেন, মনোনয়নের ক্ষেত্রে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সে বিষয়েও আকুতি প্রকাশ পেয়েছে তৃণমূলের প্রতিনিধিদের কথায়।
তবে বিএনপির নেতারা রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন ও রাজনীতির গতিবিধি নিয়ে কথা বললেও দলের সংস্কার নিয়ে কিছু বলেননি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংকটের মূলে দলীয় একনায়কত্ব। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিষয়েও সংস্কার কমিশন গঠন করেছে; কিন্তু দলে গণতন্ত্র ফেরাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দলে গণতন্ত্র না এলে দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতা–কর্মীরা দৌড়ের ওপর ছিলেন। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে হাজার হাজার মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। মামলার কারণে অনেক নেতাকে দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হতো ।
এখন সেই পরিস্থিতি নেই। কিন্তু মুক্ত পরিবেশে বিএনপিকে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একশ্রেণির নেতা–কর্মী চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও দলের নেতা–কর্মীরা অভ্যন্তরীণ সংঘাতেও লিপ্ত। এটা ভালো লক্ষণ নয়।
বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে অনেক আগেই ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি দিয়েছে। দলের মিত্ররাও এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপির ৩১ দফায় বেশ কিছু ভালো প্রস্তাব আছে। যেমন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এক ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। এ ছাড়া নির্বাহী বিভাগের ওপর আইনসভার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা ও নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসনের কথাও আছে তাদের প্রস্তাবে।
কিন্তু ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দল সংস্কারের কোনো কথা নেই। তারা দেশে সংসদীয় শাসনপদ্ধতি চালু করেছে। কিন্তু দলীয় কাঠামোটি পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক। এটা কেবল বিএনপিতে নয়। ছোট–বড় প্রায় সব দলেই। দলের প্রধানই সব। তিনি যা বলবেন, সেটাই আইন।
এখানে তিনটি দল—বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র বিচার করলে আমরা দেখতে পাব, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারার খ উপধারায় চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্বের কথা বলা আছে যথাক্রমে:
১.
দলের চেয়ারম্যানই যদি সর্বময় কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয় করেন এবং জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিষয় কমিটিসমূহের ওপর কর্তৃত্ব করেন, তাহলে অন্য কোনো পদ থাকা না থাকার মধ্যে খুব ফারাক থাকে না।
জাতীয় পার্টির (এরশাদ) গঠনতন্ত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পার্টির সর্বপ্রধান কর্মকর্তা হইবেন। তিনি পার্টির ঐক্য, সংহতি ও মর্যাদার প্রতীক। গঠনতন্ত্রের অন্য ধারায় যাহাই উল্লেখ থাকুক না কেন—জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত থাকিবেন। এই ক্ষমতাবলে তিনি প্রয়োজনবোধে প্রতিটি স্তরের কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, বাতিল, বিলোপ করিতে পারিবেন। তিনি যেকোনো পদ সৃষ্টি ও বিলোপ করিতে পারিবেন। চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, যেকোনো পদ হইতে যেকোনো ব্যক্তিকে অপসারণ ও যেকোনো ব্যক্তিকে তাহার স্থলাভিষিক্ত করিতে পারিবেন।’
চেয়ারম্যানের এই ক্ষমতা বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে। এ নিয়ে দল ভেঙেছে। অনেক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এরশাদ সাহেব যেই গঠনতন্ত্র রেখে গেছেন, সেটা এখনো বহাল আছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সভাপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘সভাপতি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে গণ্য হইবেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল, জাতীয় কমিটির সব অধিবেশন, কার্যনির্বাহী সংসদ ও সভাপতিমণ্ডলীর সভায় সভাপতিত্ব করিবেন এবং প্রয়োজনবোধে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের যেকোনো ধারা ব্যাখ্যা করিয়া রুলিং দিতে পারিবেন। তিনি ১৯ ধারামতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যদের মনোনয়ন ঘোষণা করিবেন। সভাপতিমণ্ডলীর সহিত আলোচনাক্রমে তিনি বিষয় নির্ধারণী কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন দান করিবেন।’
বিষয় নির্ধারণী কমিটির সদস্যদের মনোনয়নের বিষয়ে দলীয় প্রধান সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। কিন্তু কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের মনোনয়নের বিষয়ে আলোচনা করবেন কি না, সেটা বলা নেই।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে কিছুটা গণতন্ত্রের কথা আছে। তারপরও দলটি ৪২ বছর ধরে একনায়কতান্ত্রিকভাবে চলেছে। আর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রেই দলীয় প্রধানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আমাদের নেতারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান কিন্তু দলে গণতন্ত্র চান না। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ বড় দল বলে এসব দলের ‘একক কর্তৃত্ব’ বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় সব দলেই একনায়কত্ব আছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আগে যে দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা এই সত্য কথাটি বুঝতে চান না।
রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রসঙ্গে যখন একই ব্যক্তির দুবারের বেশি দলীয় প্রধানের পদে থাকা উচিত নয় বলে পণ্ডিতেরা মত দেন, তখন সব দলের নেতা তা ‘বাস্তবতাবর্জিত’ বলে নাকচ করে দেন। একই ব্যক্তির সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা কতটা সমীচীন, সেই বিষয়েও তাঁরা প্রশ্ন তোলা পছন্দ করেন না। কিন্তু একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হলে যে দল ও সরকার একাকার হয়ে যায়, তা অস্বীকার করবেন কীভাবে?
আমরা কি ভবিষ্যতে এমন গণতন্ত্র আশা করতে পারি, যেখানে দলীয় প্রধান ও সংসদপ্রধান ভিন্ন হবেন? যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি সংসদ নেতার আসনে বসবেন না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র গঠনতন ত র গঠনতন ত র র র জন ত ক কর ত ত ব ব এনপ র র কর ত কম ট র সরক র র ওপর ক ষমত আওয় ম করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশে ভারত-পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না: নাহিদ
সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রাখার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমরা তা ভেঙে দিয়েছি। বাংলাদেশকে আর কখনো বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থী বা পাকিস্তানপন্থী কোনো রাজনীতির ঠাঁই হবে না।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জুলাই অভ্যুত্থানকালে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের এক দফার ঘোষক নাহিদ বলেন, আজকে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেছি। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা কেবল সামনের কথা বলতে চাই। আমরা পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সামনের স্বপ্নের কথা বলতে চাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্লোগান উঠেছিল, ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প বিকল্প’। সে জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়েছে।
এরপর তিনি নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তিনি বলেন, জুলাই ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এই মর্মে ঘোষণা করছি—
‘আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে— এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে। ’
নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিলো, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছি। এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।
এম জি