পালাবদলের পর রাজনীতিতে অনেকটা নতুন রূপে ফিরে এসেছে বিএনপির একসময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। সেই সঙ্গে নতুন দল নিয়ে এসেছেন গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা। তাই প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান না থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।

নির্বাচনে বিএনপিকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে—এমনটা ধরেই আগামী দিনের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক করছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল-সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ধিত সভায় মূলত এ ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতিরই পূর্বাভাস দিয়ে তৃণমূল নেতাদের সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তার প্রস্তুতি হিসেবে তৃণমূলের নেতাদের দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু নির্দেশনা।

দিনব্যাপী ওই সভায় বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় ১০৬ জন নেতা বক্তব্য দেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে রাত ১১টায় সমাপনী বক্তব্য দেন। তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের নেতা হিসেবে আমার নির্দেশনা, আজকে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এবং নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার পরে আপনারা উদ্যোগ গ্রহণ করুন। যে উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন, খারাপকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরিয়ে দিতে পারবেন, আপনি আপনার এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্ধিত সভায় মূলত তিনটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দলীয় ঐক্য ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, নেতা-কর্মীদের দখল-চাঁদাবাজিসহ সামাজিক অপরাধ থেকে বিরত থাকা। আর তৃতীয়ত, নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের বিষয়ে সতর্কতা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সম্ভাব্য এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই ঘুরেফিরে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ এসেছে। বিশেষ করে মানুষ বিরক্ত হয়, এ ধরনের যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নেতা-কর্মীদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

সভায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশেও একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে জুলাই-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-তরুণদের নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র আত্মপ্রকাশ ঘিরে এ ব্যাপারে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা সতর্ক। এই ছাত্র-তরুণদের একটি অংশ অন্তর্বর্তী সরকারে রয়েছে। ফলে সরকার নিরপেক্ষ নয়, এমন কিছু সামনে এলে যেকোনো সময় তা ‘ইস্যু’ হয়ে উঠতে পারে।

বিএনপির বর্ধিত সভার ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী (এ্যানি)। এ সভা নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঐক্যটাকেই বড় করে দেখছি। কারণ, বিগত ১৫-১৬ বছর শেখ হাসিনার অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি ছিল যে আমরা তেমন সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারিনি। ৫ আগস্টের পর আমরা ব্যাপকভাবে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছি। এখন ঐক্য সুদৃঢ় করার দিকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের (তারেক রহমান) নজর।’

তবে বর্ধিত সভার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতা বলেছেন, আগামী নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সভা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত মতামত আসেনি। সবার জন্য সময় বরাদ্দ ছিল তিন মিনিট। তৃণমূলের বেশির ভাগ নেতাই শীর্ষ নেতার মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত ছিলেন। এতে ঢালাও কিছু বক্তব্য ছাড়া নির্বাচনের কৌশল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কে মতামত আসেনি।

অবশ্য বর্ধিত সভা ধরে রাজপথ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির এই যাত্রাকে একটু ভিন্নভাবে দেখছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতি ফ‍্যাসিবাদের ফয়সালা করেছে রাজপথে। নির্বাচিত সরকার গঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনে। আর সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া সচল হবে সংসদে। এই হলো বিএনপির রোডম্যাপ (পথনকশা)। এই লক্ষ্যে রোডম্যাপের জাতীয় ঐক্য তৈরি করেছেন তারেক রহমান। জাতীয় নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত ব এনপ র র জন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

২০২৩ সালে কর ফাঁকি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, সিপিডির গবেষণা

কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ সালে (২০২২-২৩ অর্থবছর) আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে কর ফাঁকির এই পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।

আজ সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে ‘করপোরেট আয়কর সংস্কার ও কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হয়।

সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে, একদিকে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান কর দিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ কোম্পানি জানিয়েছে, করপোরেট কর দেওয়ার সময় কর কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়েছেন। এ ছাড়া বিদ্যমান কর হার অন্যায্য বলে দাবি করেছে ৮২ শতাংশ কোম্পানি।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে আলোচনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ।

করপোরেট আয়কর নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়-এমন মোট ১২৩টি কোম্পানির তথ্য নিয়েছে সিপিডি। এ ছাড়া তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চামড়া-এই পাঁচটি খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। জরিপটি পরিচালিত হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে।

সিপিডির মতে, ২০২৩ সালে আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি হয়েছে। এর মধ্যে করপোরেট কর ফাঁকির পরিমাণই অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ; সেই হিসাবে ২০২৩ সালে আনুমানিক ১ লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা করপোরেট কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সালের পর থেকে দেশে কর ফাঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০১২ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা-২০১৫ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায়। সিপিডি বলছে, উচ্চ করহার, দুর্বল নজরদারি, জটিল আইন-কানুন ও কর ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি কর ফাঁকির মূল কারণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক কর ফাঁকি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং আইনের প্রতি অনুগত নাগরিকদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় থাকা বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি বড় চ্যালেঞ্জ। এলডিসি উত্তরণের পর বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার ফলে কর ফাঁকি ও কর পরিহারের ঝুঁকিও বাড়বে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিপিডি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর ব্যবস্থার ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, কর ফাঁকি ছাড়াও প্রণোদনা ও কর ছাড়ের কারণে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। বিনিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন খাত ভিত্তিক কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। প্রণোদনা বা কর ছাড় বিনিয়োগের ভিত্তি হতে পারে না বলে তাঁর মত।

বাংলাদেশের প্রণোদনা কাঠামো পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় তৈরি বলে অভিযোগ করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তাঁর মত, এই কাঠামো থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, কর ফাঁকি ছাড়াও প্রণোদনা ও কর ছাড়ের কারণে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। বিনিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন খাত ভিত্তিক কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। প্রণোদনা বা কর ছাড় বিনিয়োগের ভিত্তি হতে পারে না বলে তাঁর মত।

বাংলাদেশের প্রণোদনা কাঠামো পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় তৈরি বলে অভিযোগ করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তাঁর মত, এই কাঠামো থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ