বুয়েটের ফল প্রকাশ, শিক্ষার্থীদের ভর্তিপ্রক্রিয়া তিন ধাপে
Published: 1st, March 2025 GMT
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মেধাতালিকায় স্থান পাওয়াদের ভর্তি কার্যক্রম আগামী ১০ মার্চ থেকে শুরু হবে। ভর্তির বিস্তারিত তথ্য বুয়েটের ওয়েবসাইট তে মিলবে।
আসন কত
কেমিক্যাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস কৌশল, পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল এবং স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদসমূহের অধীন ১৩টি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হবে। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত প্রার্থীদের জন্য প্রকৌশল বিভাগগুলো এবং নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের জন্য মোট ৩টি ও স্থাপত্য বিভাগে ১টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট আসন ১ হাজার ৩০৯টি।
এদিকে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত এবং অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের তালিকা বুয়েটের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মেধাতালিকা ও পছন্দক্রম অনুসারে প্রার্থীদের বিভাগ বণ্টনও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত এবং অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের করণীয় কী, তা–ও জানিয়েছে বুয়েট। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। এগুলো হলো—
প্রথম ধাপ: স্বাস্থ্য পরীক্ষা
দ্বিতীয় ধাপ: ভর্তি ফি প্রদান
তৃতীয় ধাপ: মূল সনদ, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট এবং ভর্তি ফির রসিদ জমা সাপেক্ষে ভর্তি নিশ্চিতকরণ
প্রথম ধাপ: স্বাস্থ্য পরীক্ষা
ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের বুয়েটের ওয়েবসাইটে ‘Medical Screening Form for Admission’–এর পিডিএফ ফাইলটি প্রিন্ট করার পর হাতে পূরণ করতে হবে। ফরমের প্রথম অংশটি প্রার্থী নিজেই পূরণ করবেন। দ্বিতীয় অংশটি প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরির রিপোর্ট মূল্যায়নপূর্বক একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক পূরণ করতে হবে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় অংশের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য চিকিৎসক অথবা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ফি এবং ল্যাবরেটরি রিপোর্টের ফি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকেই বহন করতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যদি দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে সাত দিনের মধ্যে পুনঃপরীক্ষা করা যেতে পারে। অন্য অস্থায়ী অনুপযুক্ততা যথা: হাইড্রোসিল, হার্নিয়া ইত্যাদি এক মাসের মধ্যে পুনঃপরীক্ষার জন্য বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের অসুস্থতা পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন হলে প্রার্থীর নিজস্ব খরচে যেকোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামতের জন্য বুয়েটের প্রধান চিকিৎসক সুপারিশ করতে পারেন। তবে এই সুপারিশ ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কমিটির সভাপতি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ: ভর্তি ফি প্রদান
প্রকৌশল অনুষদের বিভাগগুলোর এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ভর্তির জন্য ৭ হাজার ১৫০ টাকা এবং স্থাপত্য বিভাগে ভর্তির জন্য ৭ হাজার ২০০ টাকা ফি জমা দিতে হবে। সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ডিমান্ড ড্রাফট অথবা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ‘কম্পট্রোলার, বুয়েট-ঢাকা’ বরাবর ভর্তি ফি দিতে হবে। ডিমান্ড ড্রাফট/পে-অর্ডারের মূল কপিসহ নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে তিনটি কপিসহ সশরীরে উপস্থিত হয়ে জমা দিতে হবে।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের দেশের যেকোন শাখার মাধ্যমে ডিমান্ড ড্রাফট করা যাবে। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় অবস্থিত সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের যেকোনো শাখার মাধ্যমে পে-অর্ডার করা যাবে।
তৃতীয় ধাপ: মূল সনদ, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট এবং ভর্তি ফির রসিদ জমা প্রদান সাপেক্ষে ভর্তি নিশ্চিতকরণ
ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের নোটিশে উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান, তারিখ ও সময়ে সশরীরে উপস্থিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে যা যা অনুসরণ করতে হবে, তা হলো—
(ক) সনদ ও দলিলাদি যাচাই এবং জমা প্রদান
(ক.
১) প্রথমত, নির্ধারিত বুথে নিম্নলিখিত দলিলাদি জমা দিতে হবে—
মূল সনদ এবং অন্যান্য: (i) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট/দাখিল অথবা সমমানের পরীক্ষার মূল সনদ এবং ফটোকপি (১ কপি)। (ii) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট/দাখিল অথবা সমমানের পরীক্ষার মূল ট্রান্সক্রিপ্ট বা গ্রেড শিট এবং ফটোকপি (১ কপি)।
(iii) উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট/আলিম অথবা সমমানের পরীক্ষার মূল ট্রান্সক্রিপ্ট বা গ্রেড শিট এবং ফটোকপি (১ কপি)।
বি.দ্র.: ফটোকপি সত্যায়ন করার প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, প্রদানকৃত ছাত্রছাত্রীদের মূল ট্রান্সক্রিপ্ট/গ্রেড শিট ও সনদ ভর্তি কমিটিগুলোর সভাপতির অফিসে জমা রাখা হবে। জমা গ্রহণের পর ভর্তি/ভর্তির যোগ্যতা বাতিল ছাড়া এসব কাগজপত্র সাময়িকভাবে ফেরত কিংবা ফটোকপি প্রদান করা হবে না।
আরও পড়ুনচীনের এআইআইবি গ্লোবাল ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম, দিনে ৯০ ডলারের সঙ্গে নানা সুযোগ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫(ক.২) সংরক্ষিত আসনের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত তালিকাভুক্ত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত প্রার্থীদের তাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত প্রমাণস্বরূপ নিম্নোক্ত দলিলাদি জমা দিতে হবে—
(i) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সনদ (মূল কপি ও এক কপি সত্যায়িত ফটোকপি)।
(ii) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত গোত্রের মোড়ল/হেডম্যান/গোত্রপ্রধান প্রদত্ত সনদ, যা স্থানীয় থানা নির্বাহী অফিসার/জেলা প্রশাসক প্রতিস্বাক্ষরিত হতে হবে (মূল কপি ও এক কপি সত্যায়িত ফটোকপি)।
(খ) স্বাস্থ্য পরীক্ষার ছাড়পত্র গ্রহণ: সনদ, ট্রান্সক্রিপ্ট এবং অন্য দলিলাদি জমার পর নির্দিষ্ট মেডিকেল বুথে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ‘Medical Screening Form for Admission’–এর পূরণকৃত কপি, ল্যাবরেটরি রিপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র (প্রয়োজন সাপেক্ষে) জমা দিতে হবে।
(গ) ভর্তি ফি জমা প্রদান: মেডিকেল অফিসারের ছাড়পত্র পাওয়ার পর ভর্তি ফির পে–অর্ডারের/ডিমান্ড ড্রাফটের মূল কপি এবং দুটি ফটোকপি নির্ধারিত বুথে জমা দিতে হবে।
আরও পড়ুনইউনিভার্সিটি অব ব্রুনেই দারুসসালামে বৃত্তি, মাসে ২ লাখের সঙ্গে নানা সুযোগ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উপরোক্ত প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন করার পর ভর্তি নিশ্চিত করা হবে।
অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের জন্য করণীয়: প্রয়োজন অনুযায়ী সময়সূচি পরে জানানো হবে (বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে এ–সংক্রান্ত নোটিশ প্রকাশ করা হবে।) উপরোক্ত প্রক্রিয়াসমূহ সঠিকভাবে সম্পাদন করার পর ভর্তি নিশ্চিত করা হবে।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কমিটিগুলোর সভাপতির পূর্ব অনুমতি না নিয়ে উপস্থিতির দিন নির্ধারিত সময়ে অনুপস্থিত প্রার্থীর ভর্তির যোগ্যতা বাতিল বলে গণ্য হবে।
আরও পড়ুনজাপান ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ, ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে করুন আবেদন২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব স থ য পর ক ষ র র জন য প র চ ক ৎসক ম ল সনদ কর র প দল ল দ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
আদালতে মামলার জট সব রেকর্ড ছাড়িয়ে
সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট বাড়ার হার কোনোভাবেই কমছে না। বরং মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে এ জট। গত আগস্ট থেকে বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি অধ্যাদেশ জারি এবং উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আইন কর্মকর্তাও বদল করে সরকার। তারপরও ২০২৪ সালে আদালতে মামলাজট বেড়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার ৪টি। এরমধ্যে শেষ ছয় মাসে বেড়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৬৪১টি। দেশের সব আদালতে বর্তমানে মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। মামলা বাড়ার তথ্য অনুযায়ী এ হার গত এক যুগে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের দুই মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দুই লাখ ১৫ হাজার মামলা বেড়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মামলার জট আপিল বিভাগে, ৩১ হাজার ১২০টি। ৬ মাসে এটি বেড়েছে তিন হাজার ৬৪৩টি। সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরীণ শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করার পর প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এরপর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনটি বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হবে। বার্ষিক প্রতিবেদন সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের গত ১৮ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণের সময় দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭টি। তথ্য পর্যালোচনা বলছে, দেড় যুগে মামলাজট হয়েছে তিনগুণ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও বিচার বিভাগের কিছু উদ্যোগের কারণে আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তা দায়ের অপেক্ষা পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সাল থেকে মামলাজট অপেক্ষাকৃত কমতে শুরু করে। ২০২২ সালে প্রথম ও সবশেষ মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বেশি হয়। এরপর মামলাজট বাড়ার লাগাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বিদায়ী বছরের শেষ ৬ মাসে বিচার বিভাগে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এ সময় মামলা বেড়েছে এক লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি। অথচ প্রথম ৬ মাসে মামলা ছিল ৮১ হাজার ৩৬৩টি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা পদে নতুন মুখ এসেছে। হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতেও বিচারিক পদগুলোতে হয়েছে ব্যাপক রদবদল।
মামলাজট কমানোসহ বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও গঠন করেছিল সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওই কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে। তাতেও মামলাজট কমানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, মামলাজট যত বাড়ছে তত বেশি মানুষ বিচারবঞ্চিত হচ্ছে। এটি প্রতিটি সমাজেই অস্থিরতা তৈরি করছে। মামলার জট নিরসনে এখনই স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তত স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ এ সরকারের কাছে আমরা এখনই প্রত্যাশা করছি।
তাঁর মতে, আপাতত বিচারপতি নিয়োগ অধ্যাদেশকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করা মোটেই জটিল পদক্ষেপ নয়। একইভাবে হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারপতির সংখ্যা বাড়াতে হবে।
বিচার বিভাগের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, কমিশনের যেসব সুপারিশ এসেছে এগুলো স্বল্প মেয়াদেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে ব্যাপারেও সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। তাতে কিছুটা হলেও সুফল আসবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মামলাজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে সংকট বাড়ছেই। অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারের যে কমিশন গঠন করেছে তাতে কাঠামোগত সংস্কারকেই জোর দেওয়া হয়েছে। অতীতেও এ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল। তাঁর মতে, লঘু অপরাধ বা অর্থদণ্ডের মতো মামলাগুলোকে সংস্কারের আওতায় বাছাই করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হলে বিপুলসংখ্যক বিচারাধীন মামলা কমে আসবে। মামলাজট নিরসনে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মতামত গ্রহণও জরুরি।
তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতে বর্তমানে ৯৯ জন বিচারপতি রয়েছেন। এরমধ্যে আপিল বিভাগে পাঁচজন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯৪ জন। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা দুই হাজার ১৪৯ জন।
বর্তমান অবস্থা ও তুলনামূলক চিত্র
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ১২০টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৯ হাজার ২৯১টি, ফৌজদারি ১১ হাজার ৬১৯টি ও অন্য ২১০টি। একই বছরের জুনে আপিল বিভাগে মামলা ছিল ২৭ হাজার ৪৭৭টি। অথচ ২০১৫ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১২ হাজার ৭৯২টি। এক দশকে মামলা বেড়েছে ১৮ হাজার ৩২৮টি।
হাইকোর্টে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি মামলা। এরমধ্যে দেওয়ানি ৯৮ হাজার ৬১৯ ও ফৌজদারি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮১টি। এ ছাড়া রিট এক লাখ ১৫ হাজার ২১২ ও আদিম মামলা (অন্যান্য) ২০ হাজার ৮৩৯টি। গত জুন পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯টি মামলা। অথচ ২০১৫ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ ৯৯ হাজার ৩০৩টি। অর্থাৎ এক দশকে হাইকোর্টে মামলাজট বেড়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৩৪৮টি।
অধস্তন আদালতে মামলাজট বাড়ার হার ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ ও ফৌজদারি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৫টি। ওই বছরের জুন পর্যন্ত দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৬টি। অন্যদিকে ২০১৫ সালে দেশের সব অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ছিল ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২টি। ফলে এক দশকে মামলা বেড়েছে ১১ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬০টি।
অগ্রগতি সামান্য
প্রতি বছরই গড়ে সোয়া লাখ করে বাড়ছে মামলার জট। বিচার বিভাগে বিচারকের সংখ্যা কিছুটা বাড়ানোর ফলে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা গত এক দশক ধরে বাড়লেও তা দায়েরের তুলনায় পিছিয়ে। ২০১৬ সাল থেকে মামলাজট বাড়ার হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ওই বছর দেশের সব আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল তিন লাখ ৭৬ হাজার ৮২০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৬৪টি। তারপরেও ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে মামলাজট বাড়ে ৪৬ হাজার ৯১১টি। অবশ্য মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বাড়ার প্রথম ও সবশেষ ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। ওই বছর আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। অথচ তার আগের বছর ২০২১ সালে মামলার জট ছিল ৪২ লাখ ৩ হাজার ৫১৬টি। ফলে ২০২২ সালে মামলাজট কমেছিল ছয় হাজার ৯১৩টি। বিদায়ী বছর ২০২৪ সালে দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলা হয়েছে তিন লাখ ৮৪ হাজার ৭৪টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয় দুই লাখ ৭৪ হাজার ৭৪৯টি। এর সঙ্গে একই বছর বদলি মামলা ছিল এক লাখ ৮১ হাজার ৮৬টি মামলা।
বিচার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
বিচার বিভাগ সংস্কারে গত বছরের ৩ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে সরকার। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এ কমিশন গঠন করা হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাজট নিরসন ও বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশসহ ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে ওই কমিশন। এতে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। অন্য সুপারিশগুলোর মধ্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন; অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, বিচার বিভাগকে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা, বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
এতে পুরোনো মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে নতুন কোনো সুপারিশ উঠে আসেনি। অবশ্য প্রতিবেদনে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা কমপক্ষে ছয় হাজারে উন্নীত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আইন কমিশনের সুপারিশ
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন দাখিল করে আইন কমিশন। প্রতিবেদনে মামলাজটের পাঁচটি মূল কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে– পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো। এছাড়াও প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে চার বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়। ২০১২ সালেও মামলাজট নিরসনে ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধিসহ পুরোনো আইনগুলো সংশোধন, পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের উদাসীনতায় অধিকাংশ সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মামলাজট প্রকট হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরেও মামলাজট থেকে বিচারপ্রার্থীরা রেহাই পাবেন না। অবিলম্বে লঘু অপরাধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলা, পারিবারিক বিরোধসংক্রান্ত মামলা এবং ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার তালিকা করে আদালতের বাইরে সময়সীমা উল্লেখ করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দুই-তিন মাস সময় দিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীকেও এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া যায়। তাহলে অন্তত ১০-১৫ লাখ মামলাজট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, মামলা ঝুলিয়ে না রাখার বিষয়ে বার ও বেঞ্চের মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় প্রয়োজন। যেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পুরোনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এ উদ্যোগ নিতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও গণসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। এর আলোকে সরকার বিচারক নিয়োগে জুডিশিয়াল অ্যাপয়নমেন্ট কাউন্সিল গঠন করেছে। এই কাউন্সিল কার্যক্রম শুরু করেছে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে মামলাজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।