সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট বাড়ার হার কোনোভাবেই কমছে না। বরং মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে এ জট। গত আগস্ট থেকে বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি অধ্যাদেশ জারি এবং উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আইন কর্মকর্তাও বদল করে সরকার। তারপরও ২০২৪ সালে আদালতে মামলাজট বেড়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার ৪টি। এরমধ্যে শেষ ছয় মাসে বেড়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৬৪১টি। দেশের সব আদালতে বর্তমানে মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। মামলা বাড়ার তথ্য অনুযায়ী এ হার গত এক যুগে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের দুই মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দুই লাখ ১৫ হাজার মামলা বেড়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মামলার জট আপিল বিভাগে, ৩১ হাজার ১২০টি। ৬ মাসে এটি বেড়েছে তিন হাজার ৬৪৩টি। সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরীণ শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করার পর প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এরপর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনটি বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হবে। বার্ষিক প্রতিবেদন সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের গত ১৮ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণের সময় দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭টি। তথ্য পর্যালোচনা বলছে, দেড় যুগে মামলাজট হয়েছে তিনগুণ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও বিচার বিভাগের কিছু উদ্যোগের কারণে আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তা দায়ের অপেক্ষা পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সাল থেকে মামলাজট অপেক্ষাকৃত কমতে শুরু করে। ২০২২ সালে প্রথম ও সবশেষ মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বেশি হয়। এরপর মামলাজট বাড়ার লাগাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বিদায়ী বছরের শেষ ৬ মাসে বিচার বিভাগে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এ সময় মামলা বেড়েছে এক লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি। অথচ প্রথম ৬ মাসে মামলা ছিল ৮১ হাজার ৩৬৩টি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা পদে নতুন মুখ এসেছে। হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতেও বিচারিক পদগুলোতে হয়েছে ব্যাপক রদবদল।
মামলাজট কমানোসহ বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও গঠন করেছিল সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওই কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে। তাতেও মামলাজট কমানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড.
তাঁর মতে, আপাতত বিচারপতি নিয়োগ অধ্যাদেশকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ করা মোটেই জটিল পদক্ষেপ নয়। একইভাবে হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারপতির সংখ্যা বাড়াতে হবে।
বিচার বিভাগের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, কমিশনের যেসব সুপারিশ এসেছে এগুলো স্বল্প মেয়াদেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে ব্যাপারেও সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। তাতে কিছুটা হলেও সুফল আসবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মামলাজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে সংকট বাড়ছেই। অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারের যে কমিশন গঠন করেছে তাতে কাঠামোগত সংস্কারকেই জোর দেওয়া হয়েছে। অতীতেও এ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল। তাঁর মতে, লঘু অপরাধ বা অর্থদণ্ডের মতো মামলাগুলোকে সংস্কারের আওতায় বাছাই করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হলে বিপুলসংখ্যক বিচারাধীন মামলা কমে আসবে। মামলাজট নিরসনে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মতামত গ্রহণও জরুরি।
তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতে বর্তমানে ৯৯ জন বিচারপতি রয়েছেন। এরমধ্যে আপিল বিভাগে পাঁচজন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯৪ জন। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা দুই হাজার ১৪৯ জন।
বর্তমান অবস্থা ও তুলনামূলক চিত্র
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ১২০টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৯ হাজার ২৯১টি, ফৌজদারি ১১ হাজার ৬১৯টি ও অন্য ২১০টি। একই বছরের জুনে আপিল বিভাগে মামলা ছিল ২৭ হাজার ৪৭৭টি। অথচ ২০১৫ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১২ হাজার ৭৯২টি। এক দশকে মামলা বেড়েছে ১৮ হাজার ৩২৮টি।
হাইকোর্টে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি মামলা। এরমধ্যে দেওয়ানি ৯৮ হাজার ৬১৯ ও ফৌজদারি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮১টি। এ ছাড়া রিট এক লাখ ১৫ হাজার ২১২ ও আদিম মামলা (অন্যান্য) ২০ হাজার ৮৩৯টি। গত জুন পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯টি মামলা। অথচ ২০১৫ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ ৯৯ হাজার ৩০৩টি। অর্থাৎ এক দশকে হাইকোর্টে মামলাজট বেড়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৩৪৮টি।
অধস্তন আদালতে মামলাজট বাড়ার হার ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ ও ফৌজদারি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৫টি। ওই বছরের জুন পর্যন্ত দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৬টি। অন্যদিকে ২০১৫ সালে দেশের সব অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ছিল ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২টি। ফলে এক দশকে মামলা বেড়েছে ১১ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬০টি।
অগ্রগতি সামান্য
প্রতি বছরই গড়ে সোয়া লাখ করে বাড়ছে মামলার জট। বিচার বিভাগে বিচারকের সংখ্যা কিছুটা বাড়ানোর ফলে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা গত এক দশক ধরে বাড়লেও তা দায়েরের তুলনায় পিছিয়ে। ২০১৬ সাল থেকে মামলাজট বাড়ার হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ওই বছর দেশের সব আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল তিন লাখ ৭৬ হাজার ৮২০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৬৪টি। তারপরেও ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে মামলাজট বাড়ে ৪৬ হাজার ৯১১টি। অবশ্য মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বাড়ার প্রথম ও সবশেষ ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। ওই বছর আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। অথচ তার আগের বছর ২০২১ সালে মামলার জট ছিল ৪২ লাখ ৩ হাজার ৫১৬টি। ফলে ২০২২ সালে মামলাজট কমেছিল ছয় হাজার ৯১৩টি। বিদায়ী বছর ২০২৪ সালে দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলা হয়েছে তিন লাখ ৮৪ হাজার ৭৪টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয় দুই লাখ ৭৪ হাজার ৭৪৯টি। এর সঙ্গে একই বছর বদলি মামলা ছিল এক লাখ ৮১ হাজার ৮৬টি মামলা।
বিচার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
বিচার বিভাগ সংস্কারে গত বছরের ৩ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে সরকার। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এ কমিশন গঠন করা হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাজট নিরসন ও বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশসহ ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে ওই কমিশন। এতে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। অন্য সুপারিশগুলোর মধ্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন; অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, বিচার বিভাগকে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা, বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
এতে পুরোনো মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে নতুন কোনো সুপারিশ উঠে আসেনি। অবশ্য প্রতিবেদনে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা কমপক্ষে ছয় হাজারে উন্নীত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আইন কমিশনের সুপারিশ
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন দাখিল করে আইন কমিশন। প্রতিবেদনে মামলাজটের পাঁচটি মূল কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে– পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো। এছাড়াও প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে চার বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়। ২০১২ সালেও মামলাজট নিরসনে ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধিসহ পুরোনো আইনগুলো সংশোধন, পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের উদাসীনতায় অধিকাংশ সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মামলাজট প্রকট হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরেও মামলাজট থেকে বিচারপ্রার্থীরা রেহাই পাবেন না। অবিলম্বে লঘু অপরাধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলা, পারিবারিক বিরোধসংক্রান্ত মামলা এবং ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার তালিকা করে আদালতের বাইরে সময়সীমা উল্লেখ করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দুই-তিন মাস সময় দিয়ে দুই পক্ষের আইনজীবীকেও এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া যায়। তাহলে অন্তত ১০-১৫ লাখ মামলাজট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, মামলা ঝুলিয়ে না রাখার বিষয়ে বার ও বেঞ্চের মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় প্রয়োজন। যেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পুরোনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এ উদ্যোগ নিতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও গণসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। এর আলোকে সরকার বিচারক নিয়োগে জুডিশিয়াল অ্যাপয়নমেন্ট কাউন্সিল গঠন করেছে। এই কাউন্সিল কার্যক্রম শুরু করেছে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে মামলাজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স প র শ কর ২০১৫ স ল ২০২৪ স ল সরক র র আইনজ ব অন য য় ন পর য এক ল খ বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের বিভাজন নীতি
যুক্তরাষ্ট্র কি চীন-রাশিয়া বিভক্তির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে? ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর ডানপন্থি পণ্ডিত টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র না বুঝে চীন ও রাশিয়াকে জোট বাঁধার দিকে ঠেলে দিয়েছে। দুটি শক্তিকে বিভক্ত করাকে তাঁর প্রশাসন অগ্রাধিকার দেবে।
হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তিনি আশা করছেন, দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটবে। ইউরোপীয় সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, এমনকি যদি এর অর্থ ইউক্রেনকে নিজের সুবিধার জন্য বিপদেও ঠেলে দেওয়া হয়, তবে এটি চীনা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ স্থানান্তরের প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক ফোনালাপের পর ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি দেখেছি, আপনি প্রথমেই যা শিখবেন তা হলো, আপনি রাশিয়া ও চীন একত্র হোক– তা চাইবেন না।’
ট্রাম্প যে ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছেন তা হলো, নিক্সন যুগের কৌশল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধতে চেয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় দুটি কমিউনিস্ট সত্তার মধ্যে বিভাজনকে প্ররোচিত করা হয়েছিল। যদি মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়; আমার বিশ্বাস, ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি নির্বোধ ও অদূরদর্শী।
আজকের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে আলাদা, যেখানে চীন-সোভিয়েত বিভক্তি ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের প্রধান কৌশলগত লক্ষ্যগুলো অভিন্ন করে নিয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা উদারপন্থি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া উভয়েই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। যেমন দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান ঘিরে চীন, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে ঘিরে রাশিয়া। এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা সরকারগুলোর গঠিত ঐক্যবদ্ধ অবস্থান শুধু দুটি দেশকে একে অপরের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন পুতিন ও শি জিনপিং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ ঘোষণা করেন। তখন থেকে চীন রাশিয়ার জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই দেশটি শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার।
২০২৪ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করেছে। রাশিয়া নিজেদের তেল ও গ্যাসের প্রধান ক্রেতা হিসেবে এখন চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা চীনকে রাশিয়ার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে এবং মস্কোকে বেইজিং থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার যে কোনো মার্কিন প্রচেষ্টা অর্থনৈতিকভাবে অবাস্তব করে তোলে।
এর অর্থ এই নয়, রাশিয়া-চীন সম্পর্ক নষ্ট হবে না। মতবিরোধ ও ভিন্ন নীতির ক্ষেত্রগুলোও রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে ফাটল তৈরিতে সফল হতে ট্রাম্প কাজে লাগাতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মার্কিন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা এবং বেইজিংয়ের যে কোনো সম্প্রসারণবাদী প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা রাশিয়ার স্বার্থে কাজ করতে পারে। যেমন ভারতের সঙ্গে মস্কোর কৌশলগত সম্পর্ক, যা চীন কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গে দেখে। বিশেষ করে যেহেতু চীন-রাশিয়া সীমান্তে এখনও বিতর্কিত অঞ্চল রয়েছে।
ট্রাম্পের লেনদেনমূলক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পররাষ্ট্রনীতি ইউরোপে ডানপন্থি দলগুলোকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ইইউ মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। আর তা মার্কিন প্রশাসনের দেওয়া নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির ওপর অন্যদের আস্থা দুর্বল করে দিতে পারে। অন্যদিকে বেইজিং এটিকে মার্কিন প্রভাব হ্রাসের লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারে, যা চীনকে কৌশল অবলম্বনের জন্য আরও সুযোগ করে দেবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষত তাইওয়ানের কথা বলা যায়।
লিংগং কং: যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি প্রার্থী; দ্য কনভারসেশন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম