নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে ১০ জন এ দলের শীর্ষ পদে আছেন। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আখতার হোসেন এ কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মধ্য, ডান, বাম, শিবির, কওমিপন্থি এবং আদিবাসী ও ১৫ নারী স্থান পেয়েছেন।

শীর্ষ ১০ পদে রয়েছেন– আহ্বায়ক মো.

নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা, প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
এ ছাড়া কমিটিতে ১৬ যুগ্ম আহ্বায়ক, ৩২ যুগ্ম সদস্য সচিব, ১২ যুগ্ম মুখ্য সংগঠক, ৪৪ সংগঠক, ১৪ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক এবং ৪৩ সদস্য রয়েছেন।
দলের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা করেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ইসমাঈল হোসেন রাব্বির বোন মীম আক্তার।

গত কয়েক দিন ধরে শীর্ষ পদগুলো নিয়ে বিরোধ চলছিল। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বাংলামটরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সভায় পদ বাড়িয়ে এর সমাধান করা হয়।
সমকালের বিশ্লেষণে কমিটিতে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অনিক রায় যুগ্ম আহ্বায়ক, কওমি মাদ্রাসা থেকে আসা আশরাফ উদ্দিন মাহাদী যুগ্ম আহ্বায়ক এবং রফিকুল ইসলাম আইনী উত্তরাঞ্চলের সংগঠক, আদিবাসী অলিক মৃ যুগ্ম মুখ্য সংগঠক, দলিত সম্প্রদায়ের কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস ও ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন।
এ ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিবির সেক্রেটারি, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর স্থান পেয়েছেন। কার্যনির্বাহী পদে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ, দুলাল খান, আব্দুল্লাহ শাফিল, শহীদ জাবির বাবা কবির হোসেন ও শহীদ আহনাফের মা জারতাজ পারভিন পদ পেয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পদ ছেড়ে অন্তত দু’জন এনসিপির কমিটিতে ঢুকেছেন। ছাত্র সংসদের সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব রিফাত রশীদ যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সংগঠক শ্যামলী সুলতানা জেদনীকে সদস্য করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন নাহিদ ইসলাম। ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা। এর আগে ছিলেন কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। বর্তমানে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। ২০১৯ সালে ডাকসুতে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। ২০২৩ সালে আহ্বায়ক আখতার হোসেনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব ছিলেন তিনি।

সদস্য সচিব আখতার হোসেন ২০১৯ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তাঁর হাত ধরে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকের রাজনৈতিক হাতেখড়ি। তিনি ২০২৩ সালে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গড়ে তোলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। ৫ আগস্টের পর তিনি মুক্তি পান।
সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতি করেছেন। এর পর রাজনীতিতে বিরতি দেন। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দর অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। আরেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। কিছুদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রায় ৪০ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে অনশন করেন। তিনি ছাত্র ফেডারেশন এবং এবি পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রপক্ষের রাজনীতি করতেন।
সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বিভাগে অধ্যয়নরত।

সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি শেষ করেন। এর পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ফল অর্জন করে ডিগ্রি শেষ করেছেন। ভ্যাকসিন নিয়ে সচেতনতায় অসামান্য অবদান রাখায় যুক্তরাজ্য সরকার তাঁকে ‘ভ্যাকসিন লুমিনারি’ সম্মাননা প্রদান করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ডাকসু আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাঠ পর্যায়ে এবং সমন্বয়কদের নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন।

মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের অমর একুশে হলের ছাত্র। ২০১৯ সালে ডাকসুতে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ডিবেটিং সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত মুখ এবং জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন।
মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অনশন করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অন্যায্যতার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।

কমিটিতে ১৬ জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। তারা হলেন– নুসরাত তাবাসসুম, মনিরা শারমিন, মাহবুব আলম, সারোয়ার তুষার, অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন, তাজনুভা জাবীন, সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া, ড. আতিক মুজাহিদ, আশরাফ উদ্দীন মাহাদী, অর্পিতা শ্যামা দেব, তানজিল মাহমুদ, অনিক রায়, খালেদ সাইফুল্লাহ, জাবেদ রাসিন, এহতেশাম হক ও হাসান আলী।
যুগ্ম সদস্য সচিব করা হয়েছে ৩২ জনকে। এরা হচ্ছেন– আব্দুল্লাহ আল আমিন, আরিফ সোহেল, রশিদুল ইসলাম রিফাত, মাহিন সরকার, নিজাম উদ্দিন, আকরাম হুসাইন সিএফ, এসএম সাইফ মোস্তাফিজ, সালেহ উদ্দিন সিফাত (দপ্তরে সংযুক্ত), আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, ফরিদ উদ্দিন, ফরহাদ আলম ভূঁইয়া, মিরাজ মিয়া, লুৎফর রহমান, মঈনুল ইসলাম তুহিন, মুশফিক-উস সালেহীন, জাহিদুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম মুসা, হুমায়ুরা নূর, মুশফিকুর রহমান জোহান, মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান, সাগুফতা বুশরা মিশমা, আহনাফ সাঈদ খান, আবু সাঈদ মো. সুজাউদ্দিন, মীর আরশাদুল হক, ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, তারেক রেজা, মশিউর রহমান, জয়নাল আবেদীন শিশির, মুনতাসির রহমান, গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর, তামিম আহমেদ এবং তাহসিন রিয়াজ।

যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন ১৪ জন। তারা হলেন– অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম (যুব), ডা. আব্দুল আহাদ, দিলশানা পারুল, আবু হানিফ, আব্দুজ জাহের, মাজহারুল ইসলাম ফকির, কৃষিবিদ গোলাম মোর্তজা সেলিম, আশেকীন আলম, ডা. জাহিদুল বারী, কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস, ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু, শেখ মোহাম্মদ শাহ মঈনুদ্দিন, মারজুক আহমেদ ও সাদ্দাম হোসেন।
দক্ষিণাঞ্চলের ৫ যুগ্ম মুখ্য সংগঠক পদে আছেন মো. আতাউল্লাহ, ডা. মাহমুদা মিতু, মোল্লা রহমতউল্লাহ, এসএম শাহরিয়ার ও জোবায়ের আরিফ।

দক্ষিণাঞ্চলে ২৬ সংগঠক হয়েছেন– আকরাম হোসাইন রাজ, হামজা মাহবুব, ওয়াহিদুজ্জামান, আসাদ বিন রনি, মোহাম্মদ রাকিব, আরমান হোসাইন, রাসেল আহমেদ, মনজিলা ঝুমা, শওকত আলী, ডা. আশরাফুল ইসলাম সুমন, মুনতাসীর মাহমুদ, ডা. মিনহাজুল আবেদীন, সাকিব শাহরিয়ার, মেজবাহ কামাল মুন্না, অ্যাডভোকেট সাকিল আহমাদ, ইমন সৈয়দ, আজিজুর রহমান রিজভী, আব্দুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ, নয়ন আহমেদ, কাউছার হাবিব, রকিব মাসুদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন ফয়সাল, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জিহান, মাওলানা সানাউল্লাহ খান ও আরিফুল ইসলাম।
উত্তরাঞ্চলে ৭ যুগ্ম মুখ্য সংগঠক হলেন– সাইফুল্লাহ হায়দার, আলী নাসের খান, সাকিব মাহদী, মেজর (অব.) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, সাদিয়া ফারজানা দিনা, অলিক মৃ ও হানিফ খান সজীব।
উত্তরাঞ্চলের ১৮ সংগঠক হলেন– আসাদুল্লাহ আল গালিব, রাসেল আহমদ, মেহেরাব সিফাত, ইমরান ইমন, আবু সাঈদ লিওন, ফরহাদ সোহেল, রফিকুল ইসলাম আইনী, আজাদ খান ভাসানী, দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী, এস এম শোয়াইব, আব্দুল্লাহ আল মনসুর, মিয়াজ মেহরাব তালুকদার, মোস্তাক শিশির, নাহিদ উদ্দিন তারেক, অ্যাডভোকেট শিরীন আক্তার শেলী, আবুল বাশার, আব্দুল্লাহ আল মুহিম ও প্রীতম সোহাগ।

দলটির সদস্যপদে অভ্যুত্থানে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনসহ ৪৩ জনকে রাখা হয়েছে। সদস্যরা হলেন– খোকন চন্দ্র বর্মন (আহত), মো. দুলাল খান (আহত), আব্দুল্লাহ শাফিল (আহত), কবির হোসেন (শহীদ জাবিরের বাবা), জারতাজ পারভিন (শহীদ আহনাফের মা), মো. আরিফুর রহমান তুহিন, মাহবুব আলম, মো. ফাহিম রহমান খান পাঠান, রাফিদ ভূঁইয়া, ইমরান নাঈম, মশিউর আমিন শুভ, আল আমিন শুভ, ওমর ফারুক, জোবায়ের হোসেন, আসাদুল ইসলাম মুকুল, ফিহাদুর রহমান দিবস, সাইদ উজ্জ্বল, আব্দুল্লাহ আল মুঈন, নাজমুল হাসান সোহাগ, ইমামুল হক রামিম, এস আই শাহীন, আসাদুজ্জামান হৃদয়, শ্যামলী সুলতানা জেদনী, তানহা শান্তা, মোস্তফা আল হোসেইন আকিল, কাউসার হাবিব, মশিউর রহমান, নেসার উদ্দিন, ইমরান শাহরিয়ার, আহসানুল মাহবুব জোবায়ের, নাহিদা বুশরা, আব্দুল্লাহিল মামুন নিলয়, আজাদ আহমেদ পাটওয়ারী, জাহিদুল ইসলাম সৈকত, ইমরান তুহিন, আবুল বাশার, আরজু আহমাদ, মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান, তাওহিদ তানজিম, তারিক আদনান মুন, তৌহিদ হোসেন মজুমদার, নফিউল ইসলাম ও নীলা আফরোজ।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এনস প য গ ম ম খ য সমন বয়ক য গ ম ম খ য স গঠক গণত ন ত র ক ছ ত র শ ক ষ বর ষ র আখত র হ স ন দ ল ইসল ম ফ ল ইসল ম র র জন ত র রহম ন কম ট ত হয় ছ ন হ স ইন আবদ ল ইমর ন ল আহম আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ ও আশপাশে বাড়ছে ভূমিকম্প, শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

স্ত্রী-সন্তান শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় বাড়িতে একাই ছিলেন পঞ্চগড় শহরের মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা আশিক রায়হান। তিনি রাত জেগে স্মার্টফোনে ফেসবুক দেখছিলেন। তাঁর একটা অভ্যাস, বসে থাকলে পা ঝাঁকান। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ অনুভব করেন বিছানাটা কাঁপছে।

আশিক রায়হান বলছিলেন, ‘প্রথমে ভেবেছি পা নাড়ানোর কারণে হয়তো ঝাঁকুনি খাচ্ছে। পরে পা ঝাঁকানো বন্ধ করার পরও দেখি বিছানা কাঁপছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বের হই আর মাকে ডাকতে শুরু করি। পরে আমার ডাকাডাকিতে মা–সহ পরিবারের সবার ঘুম ভাঙে, তারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।’ 

উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহরের অনেকেই বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ভূমিকম্পের এ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

 আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র সূত্র বলছে, দিবাগত রাত ৩টা ৬ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল নেপালের কোদারি এলাকা। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এটি মাঝারি মাপের ভূমিকম্প।

এর আগে বুধবার মধ্যরাতে সিলেটে এবং মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূকম্পন অনুভূত হয়। 

প্রথমে ভেবেছি পা নাড়ানোর কারণে হয়তো ঝাঁকুনি খাচ্ছে। পরে পা ঝাঁকানো বন্ধ করার পরও দেখি বিছানা কাঁপছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বের হই আর মাকে ডাকতে শুরু করি। পরে আমার ডাকাডাকিতে মা–সহ পরিবারের সবার ঘুম ভাঙে, তারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসেআশিক রায়হান

বুধবারের (২৬ ফেব্রুয়ারি) ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। 

আর মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। 

এভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরেও ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এভাবে ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করছেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা। ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পরম্পরা বিশ্লেষণ এবং দিন দিন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই এমনটা মনে করছেন তাঁরা।

ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেড়ে গেলেও তাকে মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাব আছে বলেই তাঁরা মনে করেন। এখনো ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ভূমিকম্প-পরবর্তী সম্ভাব্য উদ্ধার প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর জন্য নাগরিক শিক্ষা ও মহড়া—উভয়েরই অভাব আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরেও ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।ভূমিকম্প বাড়ছে আশপাশে

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগের প্লেটগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। এগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর সেখানে পৌঁছানোর পর শক্তি অটুট থাকলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই ভূমিকম্প। 

এই প্লেটের নানা ভূগর্ভস্থ চ্যুতি আছে। সেগুলোই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। 

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তর–পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের এলাকাগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। দেখা যাচ্ছে, এসব স্থানে ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪১। গত বছর তা বেড়ে হয় ৫৪।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলছিলেন, ‘আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিট বেড়েছে। আগে ছিল চারটি। ২০০৭ সাল থেকে ১৩টির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হয়। তবে শুধু প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এখন পর্যবেক্ষণ বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যা বাড়ছে তা নয়। আসলে বাংলাদেশ ও কাছাকাছি এলাকায় ভূমিকম্প বাড়ছে। বৈশ্বিক তথ্যও সে বিষয়টি সমর্থন করে।’

কেন বাড়ছে ভূমিকম্প আর বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তের ভারত ও মিয়ানমারে ভূমিকম্পপ্রবণ। কিন্তু এখন এর প্রবণতা বৃদ্ধি কেন?

ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার কারণ বোঝাতে একখণ্ড কাঠের টুকরার উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলছিলেন, কাঠের টুকরার দুই পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, তবে এর ভেতরে একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। একসময় উভয়মুখী চাপে কাঠটি চিড়ে যেতে পারে। একসময় টুকরাটা ভেতরে তৈরি হওয়া শক্তির চাপে ফেটে যাবে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের চিড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে। 

ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের মাত্রাগত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত দুই ধরনের ভূমিকম্পের কথা বলছেন তাঁরা। একধরনের ভূমিকম্প হলো রিখটার স্কেলে ৮ বা এর চেয়ে বেশি। আরেক ধরনের হলো ৭ বা এর চেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার মধ্যে সাধারণত ৮ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর ফিরে আসে। আর ৭ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে।

বাংলাদেশ বা এই ভূখণ্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী এমনটি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার।

১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার একটি সময় হয়ে গেছে।

আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিট বেড়েছে। আগে ছিল চারটি। ২০০৭ সাল থেকে ১৩টির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হয়। তবে শুধু প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এখন পর্যবেক্ষণ বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যা বাড়ছে তা নয়। আসলে বাংলাদেশ ও কাছাকাছি এলাকায় ভূমিকম্প বাড়ছে। বৈশ্বিক তথ্যও সে বিষয়টি সমর্থন করে।ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর ঢাকা আছে বিপদে, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি  

গত বছর হওয়া ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। 

ভূমিকম্প মোকাবিলায় ২০২৪-২৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ১১টি ভূমিকম্পপ্রবণ শহর নির্ণয় এবং কনটিনজেনসি পরিকল্পনা হয় বলে জানান দুর্যোগবিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জরুরি সাড়া দান পদ্ধতিও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়াও থমকে গেছে। 

দেশের ভূমিকম্প প্রস্তুতি অনেকটাই ক্ষতি-পরবর্তী তৎপরতাকেন্দ্রিক বলে মনে করেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ভবন রাতারাতি ভেঙে ফেলা কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নয়। সেটা মাথায় রেখে শিক্ষাদান এবং সচেতনতা বাড়ানো দরকার। মানসিক মনোবল বৃদ্ধিতে মহড়া বাড়ানো যেতে পারে। সেগুলো দেখা যায় না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ