নাগরিক পার্টি রাজনীতিতে ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটাবে?
Published: 28th, February 2025 GMT
মার্কিন পদার্থবিদ ও দার্শনিক টমাস কুন (১৯২২-১৯৯৬) তাঁর ‘দ্য স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রেভলিউশন’ (১৯৬২) বইয়ে প্রথম ‘প্যারাডাইম শিফট’-এর ধারণা দেন। কুনের মতে, বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় একটি আদিকল্পকে আশ্রয় করে বিজ্ঞানের নানা শাখায় মৌলিক অগ্রগতি হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে জ্ঞানকাণ্ডে নতুন কিছু প্রশ্ন ওঠে, যা সেই আদিকল্প সুরাহা দিতে পারে না। এ অবস্থায় নতুন আদিকল্পের দরকার পড়ে। প্রগতির দাবি মেটাতে পারে না বলেই পুরোনো আদিকল্পের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘নতুন আদিকল্প তার অগ্রজকে হটিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাতে নামে’ (রণজিৎ গুহ, দেখুন: গৌতম ভদ্র সম্পাদিত নিম্নবর্গের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
টমাস কুন তাঁর ধারণাটি বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও অনেকে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। যেমন মশহুর ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ (১৯২৩-২০২৩) ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চায় কুনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। একইভাবে রাজনীতি শাস্ত্র কিংবা রাজনীতির মাঠে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন কিংবা জিজ্ঞাসার উদ্রেক হয়, যা বিদ্যমান আদিকল্পকে চ্যালেঞ্জ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ উপড়ে ফেলার যে ডাক উঠেছে, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি ‘প্যারাডাইম শিফট’, যা নতুন একটি আদিকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে।
ইতিহাসবিদ জোসেফ কনবিটজ মনে করেন, বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘এক শতাব্দীতে একবার বা দু’বার একটি বড় সংকট পরিবর্তনকে উস্কে দেয়।’ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মতোই বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। জ্ঞানকাণ্ডের মতোই রাজনীতিতে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন কোনো কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয় কিংবা যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা বিশেষ কোনো পরিবার, বংশ কিংবা গোষ্ঠীর পতন ঘটতে পারে। জোসেফের মতে, একটি প্যারাডাইম শিফট ঘটতে অন্তত বিশ-ত্রিশ বছরের একটি বিপর্যয়কর প্রক্রিয়া হাজির থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা সে রকমই একটি প্যারাডাইম শিফট দেখছি। অন্তত গত পাঁচ দশকের রাষ্ট্র কাঠামো কিংবা গণতন্ত্রের মিথ্যা বুলি বা আদিকল্প ব্যর্থ হওয়ায় নতুন করে এই দাবি উঠেছে।
টমাস কুনের কয়েকশ বছর আগে ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) তাঁর মুকাদ্দিমা (১৩৭৭) গ্রন্থে প্যারাডাইম শিফটের মতোই আসাবিয়ার ধারণা দিয়েছিলেন। খালদুন দেখিয়েছেন, ইতিহাসের চক্রে আসাবিয়া বা সামাজিক সংহতি গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে তার শক্তি হারিয়ে পতনও ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল সাম্রাজ্যের অধিকারী রাজবংশ ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। একটি আদিকল্প উদ্ভবের মধ্য দিয়ে পুরোনো আদিকল্প ক্ষীণ হয়ে পড়ে। জ্ঞানবিদ্যায় যেভাবে পুরোনো ধারণা সেকেলে হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে রাজনীতিতেও পুরোনো বন্দোবস্ত কিংবা ব্যবস্থা আকর্ষণ হারায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো গুটিকয়েক মানুষের সংহতি নিয়ে গড়ে ওঠে, যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। গত অর্ধশত বছরের সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য তারই পরিণতি। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আদিকল্প ঘিরে সংহতি গড়ে উঠেছিল, তা সম্প্রতি ভয়াবহভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেই এই রাষ্ট্র কাঠামোতে কেবল ক্ষমতার হাতবদল ঘটে বলে চিহ্নিত করেছেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নতুন আদিকল্পের উত্থান ঘটেছে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ জাতীয় নাগরিক পার্টি।
নতুন আদিকল্পের মূল ভিত্তি ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’র বিলোপ ঘটানো। অর্থাৎ বিশেষ কোনো পরিবার কিংবা গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত থাকতে পারে না। অতীতে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র উপড়ে ফেলতে এত শক্তিশালী আওয়াজ কখনও দেখা যায়নি। এরই মধ্য দিয়ে প্রজন্মগত ফারাকের ব্যাপারটিও পরিষ্কার হয়েছে। কুন যেভাবে বলেছেন, ‘নতুন আদিকল্প তার অগ্রজকে হটিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাতে নামে।’ এই অভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে তার প্রভাব পড়বে।
লুটেরাতন্ত্র থেকে পুরোপুরি শ্রেণিগত রূপান্তর না ঘটায় নতুন আদিকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আশঙ্কাও কম নয়। তবে আদিকল্পটি যতটা আশঙ্কার, তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনার। নতুন আদিকল্পে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবেই এবং নতুন শ্রেণি-গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। ফলে এখানে অর্থনৈতিক, আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ কারণে নিকট ভবিষ্যতে শ্রেণিস্বার্থের দ্বন্দ্বে সংঘাত, খুনোখুনি বাড়তে পারে। বিশেষত নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে ততই সংঘাতের আশঙ্কা বাড়বে। তবে এসব ঘটনায় নতুন সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নাকচ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জ্ঞানকাণ্ডে যেমন একটি আদিকল্প জায়গা নেওয়ার আগে বহু তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার ঝড় ওঠে; তেমনি রাজনৈতিক মাঠে বিদ্যমান ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে বহু সংঘাত, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নতুন আদিকল্প যতটা সামাজিক সংহতি গড়ে তুলতে পারবে, ততটাই সংঘাত ও সহিংসতার মাত্রা কমে আসবে। সম্প্রতি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রবক্তা অধ্যাপক মুসতাক খান নতুন বন্দোবস্ত কায়েমে সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তরুণদের মাঠে হাজির থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন।
আদিকল্পের শক্তি যেমন তার পাটাতনের ওপর নির্ভর করে– যা বিভিন্ন প্রতিকল্প, ধারণা ও বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়; তেমনি রাজনীতিতে আদিকল্পের শক্তি নির্ভর করে সামাজিক সংহতির প্রশ্নে তা কতটা শক্তিশালী। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সামনে রেখে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই আদিকল্পের শক্তির ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের রাজনীতি। সামাজিক সুবিচার তথা ইনসাফ কায়েম, বৈষম্য নিরসন এবং জনগণকে ক্ষমতায়িত করার মধ্য দিয়ে একমাত্র ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সম্ভব। সেই লক্ষ্যে অটুট থাকলে নতুন আদিকল্প শক্তিশালী হবে। আর বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিনের পরিবারতন্ত্র, বণিকতন্ত্র ও সব ধরনের গোলামি থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজির হবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক র জন ত ত র র জন ত ব যবস থ বন দ ব পর ব র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার চাঁদ দেখলে কী দোয়া পড়বেন
রহমতের মাস রমজানের নতুন চাঁদ দেখলে; বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পড়া সেই দোয়া পড়বেন। যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রার্থনা রয়েছে। হাদিসে আছে-হজরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন বলতেন-
উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াসসালামাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত্তাওফিকি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ: আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদয় কর। আর তুমি যা ভালোবাস এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, সেটাই আমাদের তৌফিক দাও। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের প্রতিপালক।’ (তিরমিজি, মিশকাত)
রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করতেন। এমনকি সাহাবিদের চাঁদ দেখতে বলতেন। রমজানের নতুন চাঁদ দেখলে প্রিয় নবী (সা.) কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করতেন।
আরও পড়ুনইফতারের দোয়া২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪নতুন চাঁদকে আরবিতে বলে ‘হিলাল’। ‘হিলাল’ হচ্ছে এক থেকে তিন তারিখের চাঁদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো, ইফতার করো বা ঈদ করো।’ যে সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ দেখা যায়, সে রাত হলো ‘চাঁদরাত’। আরবি চান্দ্র বছরের নবম মাস রমজান এবং দশম মাস শাওয়াল।
যে কোনো মাসের নতুন চাঁদ, এমনকি রোজা ও ঈদের চাঁদ দেখার দোয়া একটিই। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নতুন চাঁদ দেখলে এই দোয়া পড়তেন—
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল-য়ুমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াসসালামাতি ওয়াল ইসলামি- রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য এই চাঁদকে সৌভাগ্য ও ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করুন।আল্লাহই আমার ও তোমার রব। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫১)
এ ছাড়াও রমজানের চাঁদ দেখার খবর শুনে দোয়া করা হয়।
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি লিরমাদান, ওয়া সাল্লিম রামাদানা লি, ওয়া তাসলিমাহু মিন্নি মুতাক্বাব্বিলা। (তাবারানি)
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে শান্তিময় রমজান দান করুন। রমজানকে আমার জন্য শান্তিময় করুন। রমজানের শান্তিও আমার জন্য কবুল করুন।
আরও পড়ুনরোজার কাজা, কাফফারা ও ফিদিয়া কী০২ মার্চ ২০২৪