গত সোমবার পর্যটন কেন্দ্র সাজেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা স্থানীয় অধিবাসীদের পাশাপাশি সেখানকার পর্যটন শিল্পের জন্য এক বড় ধাক্কা। রাঙামাটির জেলার এই পর্যটন শিল্প গত কয়েক বছরে বিস্তৃত হয়েছে এবং সারাবছরই পর্যটকের ভিড়ে মুখর থাকে। সাজেকে আমি একবারই গিয়েছি ২০১৯ সালে। সেখানকার অপার সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ। একই সঙ্গে একজন দুর্যোগ পেশাজীবী হিসেবে অবাক হয়েছি সেখানে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় কোনো ব্যবস্থা অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের উপস্থিতি না দেখে। প্রসঙ্গটি আমি কোনো কোনো আলোচনায় তুললেও কারও মাথাব্যথা দেখিনি। অবশ্য এমনটাই স্বাভাবিক। কারণ, আমাদের সংস্কৃতিতে দুর্ঘটনা না ঘটলে টনক নড়ে না। তাই সাজেকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সূচনার জন্য হয়তো এ দুর্ঘটনা দরকার ছিল। 

সোমবারের দুর্ঘটনায় ৩২টি রিসোর্ট, ৩৫টি বাড়িসহ ৯৪টি স্থাপনা পুড়ে গেছে (সমকাল, ২৫ ফেব্রুয়ারি), যার অর্থনৈতিক ক্ষতি এখনও নির্ণয় হয়নি। সাজেকের নিকটতর ফায়ার স্টেশন রাঙামাটির লংগদু এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালায়। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ। সঙ্গে রয়েছে পানি সমস্যা। কারণ, সমতল ভূমি থেকে রিসোর্টসহ সব স্থাপনার অবস্থান অনেক ওপরে।

সাজেক অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে গতানুগতিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি দুর্ঘটনার কারণসহ কিছু সুপারিশ দাখিল করবে, এটিই প্রচলিত ধারা। অভিজ্ঞতা থেকে সংশয় থাকবেই– ভবিষ্যৎ অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অনেকের মনে আছে নিশ্চয়, গত ১৫ জানুয়ারি আরেক পর্যটন কেন্দ্র বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্টমার্টিনে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকটি রিসোর্ট পুড়ে যায়। সেখানেও স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, তবে কোস্টগার্ড ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অগ্নিনির্বাপণ সম্ভব হয়েছিল। সে দুর্ঘটনার পরও গতানুগতিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং কমিটি নিশ্চয় তাদের রিপোর্ট দাখিল করেছিল।  রিপোর্টের তথ্য (ফাইন্ডিংস) এবং কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যৎ অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। গত বছরের ৪ মে সুন্দরবনেও এক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, যা নেভাতে নেভি, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৩ দিন সময় লাগে। তাই ভাবনার বিষয়, ৬ হাজার ১৭ (ভারতের অংশসহ ১০ হাজার ২৭৭) বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনে দাবানল বা বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা নির্বাপণে আমাদের সক্ষমতা আছে তো? 

প্রসঙ্গত, দাবানলের অনেক কারণই আমাদের বনভূমিতে বিরাজমান। যেমন– তাপদাহ, অনাবৃষ্টিজনিত কারণে গাছের পাতা শুষ্ক হওয়া ও সৃষ্ট প্রচুর ঝরাপাতা, শুষ্ক পাতার ঘর্ষণ, মাটি অতিমাত্রায় শুকিয়ে যাওয়া, মৌসুমি বাতাস ইত্যাদি। 

পেশাগত সূত্র এবং ব্যক্তিগত ভ্রমণে এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড; আফ্রিকার কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে এবং ইউরোপের কোনো কোনো দেশের প্রত্যন্ত এলাকা ভ্রমণে দেখেছি, অগ্নিকাণ্ডসহ স্থানীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যক্তি, সামাজিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে তাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিদুর্ঘটনা একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আমাদের সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনা হতাশাব্যঞ্জক। 

অবশ্য যেখানে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বাসাবাড়ি, বহুতল ভবন, শিল্প স্থাপনা, মার্কেট ও বস্তিতে, সেখানে দুর্গম পর্যটন কেন্দ্রের অগ্নিনিরাপত্তা দুর্বল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে প্রতি মাসে গড়ে দুই হাজারের অধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বলাবাহুল্য, শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) অগ্নিদুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। এ বছরও ঢাকাসহ সারাদেশে ছোট-বড় অনেক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বুধবারও ঢাকার নয়াপল্টনের জামান টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল চাঞ্চল্যকর। তবে ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের খবর অনেক সময় আড়ালেই থেকে যায়। যেমন– মঙ্গলবার ভোরে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠির মিয়ারহাট বন্দরে অগ্নিকাণ্ডে ৪০টি দোকান ভস্মীভূত। 
তবে পর্যটনকে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হলে পর্যটন স্পটগুলোতে অগ্নিকাণ্ডসহ স্থানীয় দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক (হোটেল, রিসোর্ট, দোকান/মার্কেট, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি) পর্যায়ে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা এবং তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় জলাধার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) অনুসারে স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির (ডিএমসি) সদস্য তথা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে স্থানীয়ভাবে সচেতনতায় প্রস্তুতি মনিটরিংয়ে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। 

এম.

এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট
সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক-বিষয়ক বিশ্লেষক 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন র ব যবস থ আম দ র ত হয় ছ

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিটি পরিচয়েই ভালো কাজকে প্রাধান্য দিতে চাই: ফাহমিদা নবী

ফাহমিদা নবী। নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার। সম্প্রতি আজব রেকর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক গান ‘না হয় শুধু এতটুকুই হোক’। নতুন এ আয়োজন, বর্তমান ব্যস্ততা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
 
অনেকে বলছেন, ‘না হয় শুধু এতটুকুই হোক’ গানটি মেলেডি সুরের হলেও আপনার আগের সব আয়োজন থেকে কিছুটা আলাদা। তাদের এই কথার সঙ্গে কী আপনি একমত?
দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। কারণ সুরকার জয় শাহরিয়ার এ গান যখন শোনায়, তখনই মনে হয়েছে এর সুর একটু আলাদা ধরনের। মেলোডি গান যারা পছন্দ করেন, তাদের হৃদয় স্পর্শ করার মতো ম্যাজিক্যাল কিছু এতে আছে। তানবীর সাজিবের লেখা এর গীতিকথাও একটু আলাদা ধরনের, যা গানের শিরোনাম থেকেই অনুমান করা যায়। তাই আনন্দ নিয়েই গানটি গেয়েছি।

বাংলাঢোল স্টুডিওর অ্যাকুস্টিক টেলস অনুষ্ঠানে গাওয়া ‘দিনলিপি’ গানটিও প্রকাশিত হলো। এই আয়োজনে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া কী?
সবার কথা জানি না, তবে যারা অনাপ্লাগড ভার্সনের গান পছন্দ করেন, তাদের অনেকের কাছে অ্যাকুস্টিক টেলসের ‘দিনলিপি’ গানটি ভালো লেগেছে। অ্যাকুস্টিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গাওয়া যে কোনো গানই একটু অন্যরকম শোনায়, যার আলাদা শ্রোতা আছে।

গত কয়েক বছরে বেশ কিছু গানের সুর করে শ্রোতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এ বছর আপনার সুরের কোনো গান কি প্রকাশ পাবে?
নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা কঠিন। তার পরও সম্ভাবনা যে একেবারে নেই, তা নয়। সুর করা এখন অনেকটা নেশায় পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর আগেও ভাবিনি, এই কাজটি নিয়মিত করব। যখনই কারও লেখা গানের কথা ভালো লেগে যাচ্ছে, তখনই তাতে সুর বসানোর চেষ্টা করছি। এখন মনে হয়, সুরকার হিসেবে থেমে থাকার আর সুযোগ নেই। গান যেমন গাইতে হবে, তেমনি সৃষ্টি করতে হবে নতুন সুর। কিছু গানের সুর করে রেখেছি, দেখা যাক এ বছর সেগুলো প্রকাশ করা যায় কিনা।

কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যেমন মেলোডি গান প্রাধান্য দিয়ে আসছেন, সুরকার হিসেবেও কী একই চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করেন?
মেলোডি সুরের আবেদন চিরকালই ছিল। হয়তো সে কারণেই আমার কণ্ঠে শ্রোতারা সবসময় এ ধরনের গানই শুনতে চান। তাই যখন কোনো গানের সুর করি, তখন মেলোডিকেই প্রাধান্য দেই। অন্য শিল্পী গাইলেও সেখানে যেন আমার কাজের ছাপ থাকে, সে দিকে লক্ষ রাখি।

সংগীত প্রযোজক হিসেবে আপনার ভাবনা জানতে চাই, আপনার চ্যানেলে কোন ধরনের গান তুলে ধরতে চান?
গান যদি শ্রুতিমধুর হয়, তাহলে সেটি কোন ঘরনার তা নিয়ে ভাবতে চাই না। সংগীত প্রযোজক হিসেবে এ বিষয়টা প্রাধান্য দিচ্ছি। কারণ সুরের বাইরে গিয়ে কাজ করা কখনই সমর্থন করি না। নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল থাকা মানে কাজের অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু অবাধ স্বাধীনতা পেলেও কখনও স্রোতে গা ভাসাব না। শিল্পী, সুরকার, প্রযোজক– প্রতিটি পরিচয়েই ভালো কাজকে প্রাধান্য দিতে চাই। এর চেয়ে বড় কথা হলো আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের চ্যানেল চালু করা কিংবা গানের প্রযোজনা শুরু করিনি। ভিউর দৌড়ে অংশ না নিয়ে ভালো কাজই শ্রোতার কাছে তুলে ধরতে চাই। শিল্পী, সংগীতায়োজকরা তারকাদের কাজই বেছে নেবে, বিষয়টা এমনও নয়। শিল্পী হিসেবে যেমন, তেমনই প্রযোজক হিসেবে তরুণ শিল্পীদের পাশে আছি সবসময়। 

গানের প্রকাশনা ধরে রাখলেও স্টেজ শোতে অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। এ নিয়ে কখনও ভাবেন?
এটি সত্যি যে অন্য শিল্পীদের চেয়ে আমাকে স্টেজে কম দেখা যায়। অনুষ্ঠান আয়োজকদের কারণেই এটা হয়েছে। বেশির ভাগ আয়োজকই চান, এমনভাবে অনুষ্ঠান সাজাতে যেখানে দর্শকরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারেন। সেসব অনুষ্ঠানে শিল্পীদের যে ধরনের গান গাইতে হয়, সে ধরনের গান আমার গাওয়া হয়ে ওঠে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ