সৃজনশীল মানুষের প্রস্থান এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে। এই তালিকায় যুক্ত হলো জাহিদুর রহিম অঞ্জনের নাম। তিনি ছিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার, বড় পর্দার চলচ্চিত্র পরিচালক ও সংগঠক। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী জাহিদুর রহিম অঞ্জনের স্বপ্ন চিন্তা, সৃষ্টি, অনন্য পরিকল্পনা তাঁর সমসাময়িক নির্মাতাদের থেকে পৃথক করে রাখবে। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ছিল আনন্দ-বেদনায় ভরপুর। তিনি আধুনিক ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অগ্রগামীদের অন্যতম। আজিজ মার্কেট, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা অনুষদ ও জাতীয় জাদুঘরে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল নজর-কাড়া। আড্ডা, হইহুল্লোড় ও প্রাণখোলা হাসি, পোশাক, অলংকার ধারণ ছিল নিজস্বতা প্রকাশের বাহক। তিনি সবার মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছিলেন। ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। তাঁর আনন্দ-বেদনার কত কাহিনি আজও অজানা থেকে গেল!
ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শ্রুতিচিত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তাঁর পূর্বসূরি ছিলেন মিশুক মুনীর। মিশুক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন, আর জাহিদুর রহিম অঞ্জন লিভারের জটিলতায় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিরঅনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া অ্যান্ড স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবেও সংযুক্ত হন। ফিল্ম তৈরির নেশায় জড়িয়ে পড়েন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ফিল্ম তৈরিতে তাঁর সৃজন ও দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন।
তিনি শর্টফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিন দশক শর্টফিল্ম নির্মাণে তাঁর অসামান্য অবদান স্মরণীয়। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
অঞ্জন ১৯৯০ সালে আন্তন চেকভের গল্প অবলম্বনে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মর্নিং’ পরিচালনা করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র হলেও তা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। পরে তিনি বিশিষ্ট চিন্তক অতীশ দীপংকরের জীবনীকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন ‘শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর’ নির্মাণ করে।
তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে পরিচালনা করেন ‘মেঘমল্লার’। পটভূমি ১৯৭১। কলেজ শিক্ষক নুরুল হুদার জীবনের ঘটনা, মনোস্তত্ত্ব ও সমাজ-বাস্তবতা নিয়ে চলচ্চিত্রের আখ্যানভাগ নির্মিত। মূল চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় দর্শকদের মুগ্ধ করেন। ‘মেঘমল্লার’ ২০১৫ মালের ১৫ সেপ্টেম্বর কানাডার টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০১৬ সালে ৩৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। সরকারি অনুদানে তাঁর নির্মিত ‘চাঁদের অমাবস্যা’ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। দেশের সার্বিক অবস্থা ও নিজের অসুস্থতার কারণে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়নি। তাঁর বন্ধু, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কুশলতা ও কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণ করেছেন। ‘চাঁদের অমাবস্যা’ মুক্তির অপেক্ষায়।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন ৬১ বছর এই পৃথিবীর সৌন্দর্য, আনন্দ-বেদনাকে স্পর্শ করেছেন। তাঁর প্রতিটি সময় ছিল সৃজনমুখর। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, একজন ভালো মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর পরিমণ্ডল ছেড়ে পরিচিত মানুষের প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন; বেঁচে থাকবেন স্মরণে, স্মৃতিতে। প্রকাশক, গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের রচনাসমগ্র প্রকাশের অনুরোধ জানাচ্ছি। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মাণ করা হোক বিশেষ ডকুমেন্টারি।
জাহিদুর রহিম অঞ্জন অসংখ্য নির্মাতার পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবনসংগ্রাম, সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে ‘স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশিত হবে। তিনি আর থাকবেন না বাস্তবে; অবচেতনে তাঁর অবস্থান অমোচনীয়। জাহিদুর রহমান অঞ্জনকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সাইফুজ্জামান: প্রাবন্ধিক; জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র ন র ম ত র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
কান চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যালিস
বিশ্ব চলচ্চিত্রের মর্যাদাপূর্ণ আসর ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ক্যামেরা দ’অর পুরস্কারের জুরি সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ইতালির খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার অ্যালিস রোরওয়াচার। এ পুরস্কারটি দেওয়া হয় উৎসবে নির্বাচিত সেরা প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে, যা কান উৎসবের অফিশিয়াল সিলেকশন, ক্রিটিকস উইক, অথবা ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
অ্যালিস বলেন, ‘‘প্রথম অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের সেরা স্মৃতিগুলোর একটি। যেভাবে কেউ প্রথমবার ভালোবাসায় পড়ে, অথবা অজানা কোনো ভূখণ্ডে পা রাখে–সেই সোনালি অনুভূতি আমাদের মনে গেঁথে থাকে। হয়তো এজন্যই এ পুরস্কারটির নাম ক্যামেরা দ’অর, অর্থাৎ সোনার ক্যামেরা।”
এর আগে, ২০২৪ সালের ক্যামেরা দ’অর জিতেছিলেন নরওয়ের পরিচালক হাফদান উলমান টন্ডেল, তাঁর ছবি ‘আরমান্ড’-এর জন্য।
অ্যালিসের কান উৎসবে যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। সে বছর ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে প্রদর্শিত তাঁর নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘কর্পো সেলেস্তে’। এরপর ২০১৪ সালে ‘দ্য ওয়ান্ডারার্স’ কানে প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়ে জিতে নেয় সম্মানজনক সম্মাননা ‘গ্রাঁ প্রি’।
২০১৮ সালে ‘হ্যাপি এজ লাজারো’ দিয়ে কানে সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পান এবং ২০২৩ সালে তাঁর সর্বশেষ ছবি ‘লা সিনেমা’ প্রতিযোগিতা বিভাগে স্থান পায়। তাঁর নির্মাণশৈলীতে বাস্তবতার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি থাকে রূপকধর্মী এক জাদুবাস্তবতা, যা তাঁকে ফেদেরিকো ফেলিনি ও ভিট্টোরিও দে সিকোর উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনায় আনে।
চলতি বছরের কান উৎসব অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৩ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত, ফ্রান্সের কান সৈকতে। ২০২৫ সালের এই আসরে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে ২২টি চলচ্চিত্র।